জিংক বা দস্তার ব্যবহার, ধর্ম, সংকেত এবং যোজ্যতা

0
931

জিংক বা দস্তা প্রকৃতিতে মুক্ত অবস্থায় পাওয়া যায় না কিন্তু এর অনেক খনিজ আকরিক প্রকৃতিতে বর্তমান।
জিংকব্লেন্ড আকরিক থেকে কার্বন বিজারণ দ্বারা ধাতব জিংক নিষ্কাশন করা হয়।

সূচীপত্র দেখতে ক্লিক করুন show

জিঙ্ক বাদস্তার প্রধান খনিজ

জিংকের প্রধান খনিজ গুলো হল জিংক ব্লেন্ড, জিংকেট, ক্যালামাইন, উইলেমাইট। এর মধ্যে জিংকের প্রধান আকরিক হল জিংকব্লেন্ড এবং অপর আকরিক হল ক্যালামাইন।

যৌগখনিজ পদার্থ
সালফাইডজিংক ব্লেন্ড ZnS
অক্সাইডজিংকাইট বা লাল জিংক আকরিক ZnO
ফ্রাঙ্কলিনাইট ZnO, Fe2O3
কার্বনেটক্যালামাইন ZnCO3
সিলিকেটউইলেমাইট 2ZnO, SiO2

আকরিক থেকে জিংকের প্রস্তুতি

জিংকব্লেন্ড হল দস্তার প্রধান আকরিক। এই আকরিক থেকেই প্রধানত দস্তা নিষ্কাশন করা হয়। জিংকব্লেন্ড আকরিক থেকে তাপ জারণ প্রক্রিয়ায় প্রথমে জিংক অক্সাইড উৎপন্ন করা হয়ে থাকে। পরে জিংক অক্সাইড এর সঙ্গে কোক চূর্ণ মিশিয়ে 1300°C থেকে 1400°C উষ্ণতায় উত্তপ্ত করলে জিংক অক্সাইড বিজারিত হয়ে ধাতব জিংকে পরিণত হয়।

জিংক বা দস্তার ব্যবহার

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে জিঙ্ক বা দস্তার ব্যবহার বহুল। নিচে জিঙ্ক বা দস্তার ব্যবহার আলোচনা করা হল।
১. লৌহ দ্রব্যের উপর জিংকের প্রলেপ দিয়ে মরিচা নিবারণ করা হয়।
২. নানান রকম বৈদ্যুতিক ব্যাটারি এবং ড্রাইসেল প্রস্তুতিতে দস্তা ব্যবহার করা হয়
৩. সিক্ত পদ্ধতিতে সিলভার এবং গোল্ড ধাতু নিষ্কাশনে দস্তা ব্যবহার করা হয়।
৪. পরীক্ষাগারে হাইড্রোজেন গ্যাস উৎপাদনে এবং বিজারকরূপে জিংকের ছিবরা ব্যবহার করা হয়।
৫. জিংক হোয়াইট নামক সাদা রঙ প্রস্তুতিতে দস্তা ব্যবহার করা হয়
৬. জিংক লেপন হিসাবে লোহার তৈরি বস্তুকে মরিচার হাত থেকে রক্ষা করতে বস্তুগুলির উপর দস্তার পাতলা প্রলেপ দেওয়া হয়। একে জিংক লেপন বা গ্যালভানাইজেশন পদ্ধতি বলে। টিন, বালতি, কৌটো প্রভৃতি লোহার তৈরি জিনিসের উপর জিংকের প্রলেপ দেওয়া হয়।
৭. পিতলের তৈরি যন্ত্রপাতি, টেলিস্কোপ, জলের কল, বাসনপত্র, অলংকার, ফুলদানি সৌখিন আসবাবপত্র প্রভৃতি প্রস্তুতিতে ব্যবহার করা হয়।
৮. জার্মান সিলভারের তৈরি ফুলদানি, মুদ্রা ও সৌখিনদ্রব্য প্রস্তুতিতে ব্যবহার করা হয়।
৯. ইলেকট্রন দিয়ে তৈরি মোটরগাড়ি ও বিমানের যন্ত্রাংশ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
১০. ডাচ মেটাল দিয়ে তৈরি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতিতে জিংক ব্যবহার করা হয়।
১১. বন্দুকের মেটাল তৈরি করার জন্য এবং বন্দুক ও সামরিক যন্ত্রপাতি তৈরি করার জন্য দস্তা ব্যবহার করা হয়।
১২. জাহাজের প্রোপেলার, বিয়ারিং, ভাল্ব প্রভৃতি প্রস্তুতিতে ডেল্টা মেটাল ব্যবহৃত হয়। এই ডেল্টা মেটাল তৈরি করতে দস্তা প্রয়োজন হয়।
১৩. বিভিন্ন রকম ধাতুসংকর প্রস্তুতিতে দস্তা ব্যবহার করা হয়।

১৪. এছাড়াও মানব দেহেও প্রচুর পরিমানে জিঙ্ক বা দস্তা প্রয়োজন হয়।

দস্তার বা জিংকের ধর্ম

জিংকের ধর্ম বিষয়ে সহজে জানার জন্য আমরা জিংকের ধর্মকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করব।
১. জিংকের ভৌত ধর্ম
২. জিংকের রাসায়নিক ধর্ম

প্রথমে আমরা ভৌত ধর্ম এবং পরে রাসায়নিক ধর্ম সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানবো।

জিংকের ভৌত ধর্ম

১. জিংক একটি নীলাভ সাদা ধাতু।
২. জিংক তাপ ও বিদ্যুতের সুপরিবাহী
৩. দস্তা বা জিঙ্কের আপেক্ষিক গুরুত্ব 7.14
৪. সাধারণ উষ্ণতায় দস্তা ভঙ্গুর,কিন্তু 110°C থেকে 150°C উষ্ণতায় মধ্যে দস্তা ঘাতসহ এবং প্রসার্য।
৫. জিংকের গলনাঙ্ক 419°C এবং স্ফুটনাঙ্ক 920°C।

জিঙ্ক বা দস্তার রাসায়নিক ধর্ম

১. বায়ুর সাথে ক্রিয়া
ক) দস্তা শুষ্ক বায়ুর সঙ্গে বিক্রিয়া করে না।
খ) কিন্তু আর্দ্র বায়ুতে দস্তা দীর্ঘদিন ফেলে রাখলে দস্তার উপর ক্ষারীয় জিংক কার্বনেটের পাতলা আস্তরণ পড়ে। এর ফলে দস্তার স্বাভাবিক ধাতব উজ্জলতা নষ্ট হয়ে যায়।
গ) বায়ুতে অক্সিজেনের মধ্যে দস্তা দহন করলে সবুজ আভাযুক্ত সাদার শিখার সঙ্গে জ্বলতে থাকে এবং সাদা জিংক অক্সাইডে পরিণত হয়। উৎপন্ন জিংক অক্সাইড সাদা ঝুলের আকারে জমা হয়, একে দার্শনিকের উল বলে। 2Zn+O2=2ZnO, একে জিংক হোয়াইট (সাদা জিংকও) বলা হয়।
২. জলের সঙ্গে বিক্রিয়া
ক) সাধারণ অবস্থায় বিশুদ্ধ জলের সঙ্গে কোনো রকম বিক্রিয়া করতে পারেনা।
খ) কিন্তু অবিশুদ্ধ জিঙ্ককে জলে ফোটালে জিংক হাইড্রোক্সাইড এবং হাইড্রোজেন পাওয়া যায়।Zn+2H2O=Zn(OH)2+H2
গ) লোহিত তপ্ত জিংকের উপর দিয়ে স্টিম চালনা করলে জিংক অক্সাইড এবং হাইড্রোজেন উৎপন্ন হয়।Zn+H2O=ZnO+H2
৩. অ্যাসিডের সঙ্গে বিক্রিয়া
ক) লঘু কিংবা গাঢ় হাইড্রোক্লোরিক এসিডের সঙ্গে জিংকের বিক্রিয়া ঘটে জিংক ক্লোরাইড এবং হাইড্রোজেন উৎপন্ন করে।
Zn+2HCl=ZnCl2+H2
খ) লঘু H2SO4 এসিডের সঙ্গে জিংক এর বিক্রিয়ায় হাইড্রোজেন এবং জিংক সালফেট লবনের উৎপন্ন হয়।
ZN+H2SO4=ZNSO4+H2
গ) উত্তপ্ত ও গাঢ় H2SO4 এর সঙ্গে জিংকের বিক্রিয়ায় জিংক সালফেট এবং সালফার ডাই অক্সাইড উৎপন্ন হয়।
ZN+2H2SO4=ZNSO4+SO2+2H2O
ঘ) নাইট্রিক এসিডের সঙ্গে জিংকের বিক্রিয়ায় জিংক নাইট্রেট উৎপন্ন হয় এবং নাইট্রিক এসিডের গাঢ়ত্ব ও তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে নাইট্রোজেনের বিভিন্ন অক্সাইড উৎপন্ন হয়।
৪. ক্ষারের সঙ্গে বিক্রিয়া
জিংককে কস্টিক সোডা বা কস্টিক পটাশ দ্রবণে ফেলে উত্তপ্ত করলে যথাক্রমে সোডিয়াম জিংকেট বা পটাশিয়াম জিংকেট উৎপন্ন হয় এবং হাইড্রোজেন গ্যাস নির্গত হয়।
Zn+2KOH=K2ZnO2+H2
Zn+2NaOH=Na2ZnO2+H2
৫. বিজারণ ধর্ম
লঘু সালফিউরিক অ্যাসিড যুক্ত হলুদ রংয়ের ফেরিক সালফেট দ্রবণে জিঙ্কচূর্ণ যুক্ত করলে হলুদ রঙের ফেরিক সালফেট বিজারিত হয়ে বর্ণহীন ফেরাস সালফেটে পরিণত হয়। এবং দ্রবণটি বর্ণহীন হয়ে পড়ে।
Zn+Fe2(SO4)3=2FeSO4+ZnSO4

জিংক বা দস্তা সম্পর্কিত প্রশ্নোত্তর

জিংক অক্সাইডকে উভধর্মী অক্সাইড বলে কেন

জিংক অক্সাইড এসিড ও ক্ষার উভয়ের সঙ্গে বিক্রিয়া করতে পারে। এই বিক্রিয়ার ফলে লবণ এবং জল উৎপন্ন হয়। এই কারণে জিংক অক্সাইড উভধর্মী অক্সাইড বলা হয়।

কপার সালফেটের নীল রংয়ের দ্রবণে জিঙ্কদন্ড ডোবালে দণ্ডটি বর্ণহীন হয়ে যায় কেন

কপার সালফেটের নীল রঙের দ্রবণে জিঙ্কদণ্ড ডোবালে বর্ণহীন জিংক সালফেট উৎপন্ন হয় এবং দ্রবন থেকে লাল রংয়ের কপার অধঃক্ষিপ্ত হয়। হলে দ্রবণটি বর্ণহীন হয়ে যায়।
CUSO4+Zn=ZNSO4+Cu

জিংকের বা দস্তার প্রধান আকরিক কি

জিংকের প্রধান আকরিক গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো জিংকব্লেন্ড এবং ক্যালামাইন। এছাড়াও জিংকাইট উইলেমাইট ইত্যাদি জিংকের অন্যতম খনিজ আকরিক ।

পিতল কি দিয়ে তৈরি এবং এর ব্যবহার

পিতল একটি সংকর ধাতু। পিতল তামা (Cu) এবং দস্তা (Zn) দিয়ে তৈরি হয়। পিতলের মধ্যে 70% তামা এবং 30% দস্তা ব্যবহার করা হয়।
পিতল বাসনপত্র নল টেলিস্কোপ প্রভৃতি তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়।

জার্মান সিলভার কি দিয়ে তৈরি এবং এর ব্যবহার

জার্মান সিলভার একটি সংকর ধাতু। তামা (Cu) দস্তা (Zn) এবং নিকেল (Ni) দিয়ে জার্মান সিলভার তৈরি করা হয়। জার্মান সিলভার এর মধ্যে 50% তামা 30% দস্তা এবং 20% নিকেল বর্তমান থাকে। বাসনপত্র, মুদ্রা, কাপ মেডেল, ফুলদানি প্রভৃতি প্রস্তুত করতে জার্মান সিলভার ব্যবহার করা হয়।

জিঙ্ক বা দস্তার সংকেত কি

জিঙ্ক বা দস্তার সংকেত হলো Zn

জিঙ্ক বা দস্তার পারমাণবিক গুরুত্ব বা ওজন কত

জিঙ্ক বা দস্তার পারমাণবিক গুরুত্ব বা ওজন হল 65.5

জিঙ্ক বা দস্তার পরমাণু ক্রমাঙ্ক কত

জিঙ্ক বা দস্তার পরমাণু ক্রমাঙ্ক হল 30

জিঙ্ক বা দস্তার যোজ্যতা কত

জিঙ্ক বা দস্তার যোজ্যতা হল 2

দস্তা কোথায় পাওয়া যায়

দস্তা প্রকৃতিতে মুক্ত অবস্থায় পাওয়া যায় না কিন্তু এর অনেক খনিজ আকরিক প্রকৃতিতে বর্তমান।
জিংকব্লেন্ড আকরিক থেকে কার্বন বিজারণ দ্বারা ধাতব দস্তা নিষ্কাশন করা হয়। জিংকের প্রধান খনিজ গুলো হল জিংক ব্লেন্ড, জিংকেট, ক্যালামাইন, উইলেমাইট। এর মধ্যে জিংকের প্রধান আকরিক হল জিংকব্লেন্ড এবং অপর আকরিক হল ক্যালামাইন।

গ্যালভানাইজেশন বা জিংক লেপন বা দস্তা লেপন কি

প্রকৃতিতে প্রতিমুহূর্তে এক মৌলের সঙ্গে আরেক মৌলের বিক্রিয়া ঘটে থাকে। ঠিক এ রকমই এক উদাহরণ লোহা। এই লোহা বাতাসের জলীয় বাষ্পের সঙ্গে বিক্রিয়া করে মরিচার সৃষ্টি করে। এবং ধীরে ধীরে ক্ষয়ীষ্ণু হয়ে যায়। লোহার তৈরি বস্তুকে মরিচার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ওই বস্তুগুলোর উপর জিংকের পাতলা প্রলেপ দেওয়া হয়। যে পদ্ধতিতে জিংকের পাতলা প্রলেপ দেওয়া হয় সেই পদ্ধতিকে গ্যালভানাইজেশন বা জিংক লেপন বা দস্তা লেপন বলা হয়।

আরও পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here