দৈনন্দিন জীবনে আমরা প্রতিটি মুহূর্তে শব্দ শুনতে পাই। কখনো কল-কারখানার তো কখনো মানুষের কথাবার্তার, কখনো পাখির কলতান, গান-বাজনা আবার কখনো বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ, এরকম বিভিন্ন ধরনের শব্দ প্রতিমুহূর্তে শ্রুতিগোচর হয়।
আসলে কোন বস্তু থেকে উৎপন্ন হওয়া শব্দ আমাদের মস্তিষ্কে পৌঁছায় এবং একটি বিশেষ অনুভূতির সৃষ্টি করে। তখন আমরা শব্দটি শুনতে পাই। আসলে শব্দ হলো কোন বস্তুর কম্পন। বস্তুর কম্পন দ্রুত হলে তা আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না কিন্তু স্পর্শ করলে বুঝতে পারি। স্কুলের ঘন্টা বাজালে যে শব্দ শোনা যায়, ওই ঘন্টায় হাত দিলে, আমরা ওই ঘন্টার কম্পন অনুভব করতে পারি।
এসব থেকে বোঝা যায় কোন বস্তুর কম্পন এর গতি শক্তি শব্দ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। অর্থাৎ, শব্দ এক প্রকারের শক্তি এবং শব্দ হলো কম্পন রূপে যান্ত্রিক শক্তির প্রকাশ।
শব্দ কাকে বলে বা কি (সংজ্ঞা)
কোন কম্পনশীল বস্তু থেকে কোন জড় মাধ্যমের ভেতর দিয়ে যে শক্তি আমাদের কানে এসে পৌঁছায় এবং মস্তিষ্কে এক বিশেষ অনুভূতি সৃষ্টি করে তাকে শব্দ বলে।
শব্দ বিস্তারের জন্য জড় মাধ্যমের প্রয়োজন হয়। কারণ জড় মাধ্যমের মধ্য দিয়েই তরঙ্গ আকারের শব্দ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। শূন্য স্থানের মধ্যে দিয়ে শব্দ সঞ্চালিত হতে পারে না।
শব্দ শুনতে গেলে তিনটি জিনিসের প্রয়োজন হয়।
১. কম্পনশীল স্বনক বা শব্দ উৎস
২. স্থিতিস্থাপক মাধ্যম (যেমন বায়ু জল লোহা কাঠ ইত্যাদি) এবং
৩. শব্দের গ্রাহক (কানের পর্দা)
শব্দ একরকমের শক্তি
শব্দ শ্রুতিগোচর হতে গেলে শব্দকে কিছু কার্য করতে হয়। আবার বিজ্ঞানের পরিভাষায় আমরা জানি কার্য করার সামর্থ্যকে শক্তি বলে। অর্থাৎ, কার্য করতে গেলে শক্তির প্রয়োজন হয়। বোমা ফাটার আওয়াজে কাচের জানালা ভেঙে যায়। অর্থাৎ বস্তুর মধ্যে কম্পনের সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ স্বনকের কম্পনের যান্ত্রিক শক্তি শব্দ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের শক্তি শব্দ শক্তিতে এবং শব্দ শক্তিকে অন্যান্য প্রকাশকদের রূপান্তরিত করা যায়। এ থেকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে শব্দ একরকমের শক্তি।
শব্দের বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম
প্রত্যেক শক্তির মতো শব্দের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম আছে। নিচে শব্দের বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম সম্বন্ধে জেনে নেব।
১. কম্পনশীল বস্তু থেকে শব্দ উৎপন্ন হয়।
২. শব্দ এক প্রকার শক্তি।
৩. শূন্য মাধ্যম দিয়ে বিস্তার লাভ করতে পারে না।
৪. স্থিতিস্থাপক মাধ্যম অবলম্বন করে তরঙ্গের আকারে বিস্তার লাভ করে।
৫. শব্দের বিস্তারের সময় মাধ্যম স্থানচ্যুত হয় না।
শব্দের উৎস কাকে বলে (সংজ্ঞা)
কম্পনশীল যে বস্তু থেকে শব্দ উৎপন্ন হয় সেটি হল শব্দের উৎস। শব্দের উৎসকে স্বনক বলা হয়।
শব্দের উৎস কঠিন তরল ও গ্যাসীয় হতে পারে। গিটারের তার টেনে ছেড়ে দিলে মিষ্টি শব্দ উৎপন্ন হয়, এক বালতি জলের মধ্যে একটি কয়েন ফেলে দিলে শব্দ শোনা যায়, একটি টিউনিং ফর্ক হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করলে মিষ্টি শব্দ উৎপন্ন হয়। এখানে গিটারের তার বা বালতির জল বা টিউনিং ফর্ক এগুলি হল শব্দের উৎস বা স্বনক।
শব্দ উচ্ছের কম্পনের ফলে উৎপন্ন শব্দই আমরা শুনতে পাই না।
শ্রুতিগোচর শব্দ কি (সংজ্ঞা)
কোন বস্তুর কম্পন সেকেন্ডে কুড়ি থেকে কুড়ি হাজার বারের মধ্যে হলে সেই বস্তু থেকে উৎপন্ন শব্দ আমরা শুনতে পাই।
মানব শিশুরা কুড়ি হাজার কম্পাঙ্কের শব্দ স্পষ্ট শুনতে পায়, কিন্তু বয়স্ক ব্যক্তিরা 15 হাজারের বেশি কম্পাঙ্কের শব্দ শুনতে পায় না।
শব্দোত্তর শব্দ কি বা কাকে বলে (সংজ্ঞা)
কোন বস্তুর কম্পন সেকেন্ডের কুড়ি হাজার বারের বেশি হলে ঐ বস্তু থেকে উৎপন্ন শব্দ আমরা শুনতে পাই না। অর্থাৎ এই ধরনের শব্দ শ্রুতিগোচর হয় না। এই শব্দকে শব্দোত্তর শব্দ বলে। ওই কম্পনশীল বস্তু দ্বারা জড় মাধ্যমে সৃষ্ট তরঙ্গকে শব্দোত্তর তরঙ্গ বলে।
কুকুর বিড়াল বাঁদর প্রভৃতি প্রাণীরা মানুষের তুলনায় উচ্চতর কম্পাঙ্কের শব্দ শুনতে পায়।
শব্দেতর শব্দ কাকে বলে (সংজ্ঞা)
কোন বস্তুর কম্পন সেকেন্ডে কুড়ি বারের কম হলে বস্তু থেকে উৎপন্ন শব্দ আমরা শুনতে পাই না। এই শব্দকে আমরা শব্দেতর শব্দ বলি। এবং ঐ বস্তু দ্বারা জড় মাধ্যমে সৃষ্ট তরঙ্গকে শব্দতর তরঙ্গ বলে।
বস্তুর কম্পনের ফলে শব্দ সৃষ্টি হয়
কোন বস্তুকে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করলে, ঢাক বাজালে, বাঁশিতে ফুঁ দিলে শব্দ শোনা যায়। শব্দ উৎপন্ন হওয়ার সময় ওই পদার্থের কম্পনের সৃষ্টি হয় এবং কম্পন থেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শব্দ থেমে যায়। সুরশলাকার পরীক্ষার মাধ্যমে দিয়ে আমরা প্রমান করতে পারব যে বস্তুর কম্পন এর ফলেই শব্দের সৃষ্টি হয়।
সুরশলাকা দ্বারা শব্দ সৃষ্টি
টিউনিং ফর্ক বা সুরশলাকা হলো হাতলযুক্ত U আকৃতির একটি ইস্পাত দন্ড। দন্ডটির বাঁকের নিচে একটি ইস্পাতের হাতল আছে। এর কোন এক বাহুতে আঘাত করলে বাহুতে পর্যাবৃত গতিতে কাঁপতে থাকে এবং একটি মিষ্টি শব্দ উৎপন্ন হয়।
সুরশলাকার কম্পনের বৈশিষ্ট্য হল এই যে, এর একটি নির্দিষ্ট কম্পাঙ্ক আছে। তাই সুরশলাকা থেকে নির্গত শব্দ হলো সুর। শব্দ বিজ্ঞানের বিভিন্ন পরীক্ষায় সুরশলাকা ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
উৎসের কম্পনে যে শব্দ সৃষ্টি হয় তা দেখাতে পরীক্ষাগারে একটি সুরশলাকা, একটি শোলার বল, স্ট্যান্ড ও রবারের হাতুড়ির প্রয়োজন হয়। কাঠের তৈরি কোন পাপা বাক্সের ওপর একটি সুরশলাকার সোজাভাবে বসানো থাকে। ওই সুরশলাকাটির কাছাকাছি একটি উলম্ব দন্ডের সঙ্গে অনুভূমিকভাবে যুক্ত অপর কোন দন্ড থেকে সরু সুতোর সাহায্যে একটি শোলার বলকে সুরশলাকার একটি বাহু স্পর্শ করে ঝুলিয়ে রাখা হয়।
এই অবস্থায় সুরশলাকার বিপরীত বাহুতে রবারের হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করলে শব্দ সৃষ্টি হবে। এবং দেখা যাবে যে, শোলার বলটি সুরশলাকার বাহুতে বারবার ধাক্কা খেয়ে দূরে ছিটকে যাচ্ছে। এ থেকে বোঝা যায় সুরশলাকার বাহু দুটি কম্পিত হয়ে শব্দ সৃষ্টি করছে।
এবার সুরশলাকার বাহুকে হাত দিয়ে স্পর্শ করলে, সুরশলাকার বাহুর কম্পন বন্ধ হয়ে যাবে এবং সেই সঙ্গে শব্দ থেমে যাবে। কম্পন বন্ধ হওয়ায় শোলার বলটিও সুরশলাকার বাহু কে স্পর্শ করে স্থির হবে।
উপরের এই পরীক্ষাটি প্রমাণ করে যে জড় বস্তুর কম্পনের ফলে শব্দ সৃষ্টি হয়।
শব্দ সম্পর্কিত প্রশ্নোত্তর
মশা উড়লে তার ডানার কম্পনের শব্দ শোনা যায় কিন্তু পাখি উড়লে তার শব্দ শোনা যায় না কেন
মশার ডানার কম্পাঙ্ক ও সেকেন্ডের পুরি থেকে কুড়ি হাজারের মধ্যে। এই কারণে মশা করলে তার ডানার কম্পন আমরা শুনতে পাই। কিন্তু অপরপক্ষে পাখির ডানার কম্পাঙ্ক সেকেন্ডে কুড়ির কম হওয়ায় আমরা পাখির ডানার শব্দ শুনতে পাই না।
ঠিক এই একই কারণে হাতপাখা নাড়ার শব্দ আমরা শুনতে পাই না
একটি দোলক (পেন্ডুলাম) দুলতে থাকলে কোন শব্দের উৎপত্তি হয় না কেন
শব্দের উৎসের কম্পাঙ্ক কুড়ির কম হলে, আমরা সেই শব্দ শুনতে পাই না। দোলকের দোলনের কম্পাঙ্ক কুড়ি কম হওয়ার জন্য দোলনের ফলে উৎপন্ন শব্দ আমাদের শ্রুতিগোচর হয়না।
এইরকম শব্দকে শব্দেতর শব্দ বলে।