পুকুরের জলে ঢিল ফেললে জলে তরঙ্গের সৃষ্টি হয়। যে স্থানে ঢিলকে ফেলা হয়, সেখানে জলকনার মধ্যে আন্দোলনের সৃষ্টি হয় এবং ওই আন্দোলিত জলকণাগুলি তাদের কম্পন পাশের জলকণাগুলির মধ্যে সঞ্চালিত করে। ওরা আবার ওদের পাশের জলকনাগুলিকে আন্দোলিত করে। এইভাবে জলে কোন বিন্দুতে আন্দোলন সৃষ্টি হলে ওই আন্দোলন জলের উপর তল বরাবর এগিয়ে যায়। সুতরাং বলা যায়, ঢিলটি জলে পড়ে সেই জায়গার জলকনাগুলির মধ্যে যে শক্তি দিয়েছিল, সেই শক্তি, তরঙ্গের আকারে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বিস্তার লাভ করে। এখন মজার বিষয় হলো, জলের মধ্যে আন্দোলন শুরু হওয়ার আগে একটি কর্ককে ভাসিয়ে রেখে দিলে দেখা যাবে, তরঙ্গ কর্কটিকে আন্দোলিত করছে, কিন্তু কর্কটির স্থান পরিবর্তন হচ্ছে না। অর্থাৎ ঢিলটি জলে পড়ে জলকণাগুলিতে যে শক্তি সরবরাহ করে তা তরঙ্গাকারে সঞ্চালিত হওয়ার সময় মাধ্যমের কণাগুলোর স্থানচ্যুতি করে না।
তরঙ্গ কাকে বলে (সংজ্ঞা)
স্থিতিস্থাপক মাধ্যমের কণাগুলোর সমষ্টিগত কম্পনের ফলে উৎপন্ন যে আন্দোলন এগিয়ে গিয়ে মাধ্যমের একস্থান থেকে অন্যস্থানে শক্তি সঞ্চালিত করে অথচ মাধ্যমের কণাগুলোকে স্থানচ্যুতি করে না, তাকে তরঙ্গ বলে।
যে পদ্ধতিতে শক্তি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বিস্তার লাভ করে, তাকে তরঙ্গগতি বলে।
তরঙ্গ কত প্রকার ও কি কি
তরঙ্গ দুই প্রকারের হয়। যথা
১. অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ এবং
২. তির্যক তরঙ্গ।
অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ কাকে বলে (সংজ্ঞা)
কোন সমসত্ত্ব স্থিতিস্থাপক মাধ্যমের কণাগুলোর সমষ্টিগত কম্পনের ফলে, মাধ্যমে যে তরঙ্গের সৃষ্টি হয় এবং তরঙ্গ বিস্তারের সময় মাধ্যমের কণাগুলো যদি তরঙ্গের গতির অভিমুখের সঙ্গে সমান্তরালভাবে কম্পিত হয়, তবে ওই তরঙ্গকে অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ বলে।
অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গের উদাহরণ
এটি লম্বা জ্বালানো স্প্রিংএর নিচের প্রান্ত টেনে ছেড়ে দিলে দেখা যাবে,স্প্রিংএর প্রত্যেক অংশ ওঠানামা করে স্প্রিংএর বিভিন্ন অংশে সংকোচন-প্রসারণের সৃষ্টি করছে। এই সংকোচন-প্রসারণ স্প্রিংএর দৈর্ঘ্য বরাবর অগ্রসর হয়ে তরঙ্গ সৃষ্টি করে। এইভাবেই স্প্রিংএ যে তরঙ্গের সৃষ্টি হয় সেই তরঙ্গ হলো অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ।
বাতাসের মধ্য দিয়ে শব্দ সঞ্চালনের সময় স্থিতিস্থাপক বায়ুস্তরগুলোর পর্যায়ক্রমে সংকোচন প্রসারণ ঘটে। ফলে শব্দ অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গের আকারে বিস্তার লাভ করে এবং আমাদের কানের পর্দায় এসে পৌঁছায়, ফলে আমরা শুনতে পাই। তাই শব্দ তরঙ্গকে এক রকমের অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ বলা হয়।
তির্যক তরঙ্গ কাকে বলে (সংজ্ঞা)
কোন স্থিতিস্থাপক মাধ্যমে তরঙ্গ বিস্তারের সময় মাধ্যমের কণাগুলোর যদি তরঙ্গের গতির অভিমুখে সঙ্গে লম্বভাবে কম্পিত হয়, তবে ওই তরঙ্গকে তির্যক তরঙ্গ বলে।
পুকুরের জলে ঢিল ফেললে জল আন্দোলিত হয় এবং তরঙ্গ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এখানে জলে তরঙ্গের সৃষ্টি হলেও জলকণাগুলি শুধু একই জায়গায় থেকে ওঠা নামা করতে থাকে এবং পাশের কনাগুলিতে আন্দোলন সঞ্চারিত করে — তরঙ্গের সঙ্গে কিন্তু কণাগুলি এগিয়ে যায় না। কণাগুলি তরঙ্গের অভিমুখে সঙ্গে তীর্যকভাবে ওঠানামা করে। তাই জলের মধ্যে উৎপন্ন এই তরঙ্গ হলো তির্যক তরঙ্গ।
তির্যক তরঙ্গের উদাহরণ
আলোক তরঙ্গ, বেতার তরঙ্গ, তাপ তরঙ্গ প্রভৃতি তরঙ্গ তির্যক তরঙ্গের উদাহরণ।
শব্দ বিস্তারের জন্য জড় মাধ্যমের প্রয়োজন হয় কেন
নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলির কারণে শব্দ বিস্তারের জন্য জড় মাধ্যমের প্রয়োজন হয়।
১. তরঙ্গ সৃষ্টির জন্য কোন বস্তুর কম্পনের প্রয়োজন, শব্দ সৃষ্টির জন্য একইভাবে বস্তুর কম্পনের প্রয়োজন।
২. তরঙ্গ যেমন মাধ্যম অবলম্বন করে চলে, শব্দও তেমনি মাধ্যম ছাড়া এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে পারে না।
৩. তরঙ্গ যখন বেগ আছে; শব্দ তেমনি বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্ন গতি বেগে প্রবাহিত হয়। এই গতিবেগ মাধ্যমের স্থিতিস্থাপকতা ও ঘনত্বের উপর নির্ভর করে।
৪. তরঙ্গ বিস্তারের সময় যেমন মাধ্যমের স্থায়ী স্থানচ্যুতি ঘটে না, তেমনি শব্দ বিস্তারের সময়ও মাধ্যমের স্থানীয স্থানচ্যুতি ঘটে না।
৫. তরঙ্গে দেওয়ার প্রতিফলন ও প্রতিসরণ হয় শব্দের ক্ষেত্রেও তেমনি প্রতিফলন ও প্রতিসরণ হয়ে থাকে।
৬. তরঙ্গ বিস্তারের জন্য সময়ের প্রয়োজন হয়, শব্দ বিস্তারের ক্ষেত্রেও সময়ের প্রয়োজন হয়।
এক কথায় বলা যায়, শব্দ বিস্তারের জন্য তরঙ্গ বিস্তারের প্রয়োজন হয়। তরঙ্গ বিস্তারের জন্য জড় মাধ্যমের প্রয়োজন হয়। ঠিক সেই কারণে শব্দ বিস্তারের জন্যও জড় মাধ্যমের প্রয়োজন হয়।
শব্দ তরঙ্গের প্রকৃতি বা ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য
শব্দ একরকমের শক্তি, যা উৎসের কম্পনের ফলে উৎপন্ন হয়ে তরঙ্গের আকারে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
কোন সুরশলাকাকে রাবারের হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করলে ওই সুরশলাকাতে যে কম্পনের সৃষ্টি হয়, তা থেকে উৎপন্ন শব্দ জড় মাধ্যমের মধ্য দিয়ে অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গের আকারে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ওই তরঙ্গগুলি শ্রোতার কানের পর্দায় আঘাত করলে শ্রোতা শব্দ শুনতে পায়।
শব্দ তরঙ্গের কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। নিচে শব্দ তরঙ্গের বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম বা প্রকৃতি সম্বন্ধে আলোচনা করা হলো।
১. কোন বস্তুর কম্পন ব্যতীত শব্দ তরঙ্গের সৃষ্টি হয় না।
২. শব্দ তরঙ্গের ক্ষেত্রে প্রতিফলন এবং প্রতিসরণ দুইই ঘটে।
৩. শব্দ তরঙ্গের বেগ আছে এবং বিভিন্ন মাধ্যমে গতিবেগের ভিন্নতা দেখা যায়।
৪. শব্দতরঙ্গ মাধ্যম অবলম্বন করে চলে। কোন মাধ্যম ছাড়া শব্দ তরঙ্গ বিস্তার লাভ করতে পারে না।
৫. শব্দতরঙ্গ বিস্তারের জন্য মাধ্যমের স্থানচ্যুতি ঘটে না।
উপরোক্ত আলোচনা শব্দ তরঙ্গের প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য হিসেবে আমরা ধরতে পারি।