আলোকশক্তি বোঝার সময় আমরা আলোর প্রতিফলন সম্পর্কে জেনেছিলাম। আলোর প্রতিফলনের মত শব্দ তরঙ্গেরও প্রতিফলন ঘটে । কিন্তু শব্দতরঙ্গ আলোক তরঙ্গের থেকে অনেক বড় হওয়ায় প্রতিফলনের জন্য অনেক বড় প্রতিফলক প্রয়োজন হয়; যেমন- বড় গাছ, পাহাড়, ঘরবাড়ি ইত্যাদি আমরা এই অধ্যায়ের শব্দের প্রতিফলন সম্বন্ধে জানবো।
শব্দের প্রতিফলন কাকে বলে (সংজ্ঞা)
শব্দতরঙ্গ যখন এক মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে বিভেদ আপতিত হয়, তখন শব্দের কিছু অংশ মাধ্যমের পেপাল থেকে প্রতিফলিত হয়ে পুনরায় প্রথম মাধ্যমে ফিরে আসে, এই ঘটনাকে শব্দের প্রতিফলন বলে।
এক্ষেত্রে অবশ্যই মনে রাখতে হবে প্রতিফলনের সময় শব্দতরঙ্গ ১. প্রতিফলক দ্বারা কিছুটা প্রতিফলন হয়,
২. শব্দের বাকি অংশ কিছুটা মাধ্যমদ্বয়ের বিভেদ তল দ্বারা শোষিত হয় এবং
৩. বাকি অংশটি দ্বিতীয় মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে চলে যায়।
শব্দের প্রতিফলন বলতে কি বুঝায়
শব্দের প্রতিফলন বলতে কি বুঝায় তা একটি পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা জানব।
শব্দের প্রতিফলনের পরীক্ষা ১: সমতল পৃষ্ঠ শব্দের প্রতিফলনের পরীক্ষা
সরঞ্জাম:
এই পরীক্ষার জন্য একটি টেবিল, দুটি সমান ব্যাসের ফাঁপা নল E F, একটি সমতল কাঠের ফলক, একটি ঘড়ি এবং একটি শব্দ নিরোধক পর্দা প্রয়োজন হয়।
পদ্ধতি:
একটি সমতল কাঠের ফলক ABকে খাড়াভাবে একটি টেবিলের উপর বসিয়ে বালকটির সামনে ফাঁপা নল দুটি ( E ও F) এমনভাবে বসানো হলো যেন নল দুটির অক্ষ কাঠের ফলকের উপর P বিন্দুতে মিলিত হয়। এরপর ফাঁপা নল দুটির মাঝে একটি শব্দ নিরোধক পর্দা বা পার্টিশন ( CS) এমন ভাবে রাখা হল যাতে CS পার্টিশানের সঙ্গে E ও F নল দুটি সমান কোণ উৎপন্ন করে, অর্থাৎ, ∠EPS এবং ∠FPS হয়।
এই অবস্থায় E নলের মুখে একটি চালু ঘড়ি রেখে F নলের মুখে কান পাতলে টিকটিক শব্দ শোনা যাবে। নল দুটির মধ্যে শব্দ নিরোধক পর্দা CS ঢাকায় ঘড়ির শব্দ সোজাসুজি এখানে আসতে পারে না। সুতরাং, ঘড়ির শব্দ E নলের মধ্যে দিয়ে গিয়ে কাঠের ফলকে প্রতিফলিত হয় F নলের মধ্যে দিয়ে গিয়ে কানে প্রবেশ করে। এই অবস্থায় শব্দের আপতন কোণ ∠EPS এবং প্রতিফলন কোণ ∠FPS সমান হবে।
এবার F নাল টিকেট ডান বা বাদিকে সামান্য সরিয়ে দেওয়া হলো যাতে শব্দের আপতন কোণ এবং প্রতিফলন কোণ সমান হয়ে যায়। এই অবস্থায় F নলের মুখে কান পাতলে ঘড়ির টিকটিক শব্দ শোনা যাবে না। কারণ এক্ষেত্রে প্রতিফলন কোণ, আপাতন কনের থেকে ছোট বা বড় হয়েছে। ফলে শব্দ প্রতিফলিত হয় এখানে পৌঁছাতে পারেনি। অর্থাৎ শব্দের প্রতিফলন এর ক্ষেত্রে আপতন কোণ এবং প্রতিফলন কোণ পরস্পর সমান হওয়া দরকার।
আবার E এবং F নল দুটি কক্ষ এবং C বিন্দুতে অঙ্কিত অভিলম্ব CS একই সমতলে না থাকলে F নলে কান পাতলে প্রতিফলিত শব্দ শোনা যাবে না।
সিদ্ধান্ত:
১. আলোর মতো শব্দ প্রতিফলিত হয়।
২. শব্দের প্রতিফলন এর ক্ষেত্রে আপতন কোণ এবং প্রতিফলন কোণ পরস্পর সমান হয়। এবং
৩. আপতিত শব্দ তরঙ্গ, প্রতিফলিত শব্দতরঙ্গ এবং আপাতন বিন্দু প্রতিফলকের উপর অঙ্কিত অভিলম্ব একই সমতলে থাকবে।
এই সিদ্ধান্তকে শব্দের প্রতিফলনের সূত্র বলা হয়ে থাকে।
শব্দের প্রতিফলনের পরীক্ষা ২: অবতল প্রতিফলকে শব্দের প্রতিফলনের পরীক্ষা
P এবং Q দুটি ধাতুর তৈরি অবতল প্রতিফলক। এদের পরস্পরের মুখোমুখি করে একই অক্ষের উপর বসানো হলো। P প্রতিফলকের ফোকাসে একটি চালু ঘড়ি রেখে Q প্রতিফলকের ফোকাসে শব্দগ্রাহক R রাখলে তাতে ঘড়ির টিকটিক শব্দ শোনা যাবে। কিন্তু শব্দগ্রাহককে ফোকাস থেকে সামান্য সরালে শব্দ অস্পষ্ট হয়ে পড়বে।
ঘড়ি থেকে নির্গত শব্দতরঙ্গ প্রথমে P প্রতিফলকের উপর আপতিত হয়। পরে ওই প্রতিফলক থেকে প্রতিফলিত হয়ে শব্দতরঙ্গ প্রতিফলক অক্ষের সমান্তরালে এসে Q প্রতিফলকে আপতিত হয়। এই সমানতরাল শব্দ তরঙ্গ Q প্রতিফলক থেকে প্রতিফলিত হওয়ার পর Q প্রতিফলকটির ফোকাসে কেন্দ্রীভূত হয়। এইজন্য Q প্রতিফলকের ফোকাসে শব্দগ্রাহককে রাখলে সবচেয়ে জোরালো শব্দ শোনা যাবে।
এই পরীক্ষা দুটির মাধ্যমে শব্দের প্রতিফলনের সূত্র প্রতিষ্ঠা করা যায়।
শব্দের প্রতিফলনের সূত্র
শব্দের প্রতিফলন নির্দিষ্ট দ্বিতীয় সূত্র মেনে চলে। নিচের শব্দের প্রতিফলনের সূত্র দেওয়া হল।
১. আপতিত শব্দ তরঙ্গ, প্রতিফলিত শব্দতরঙ্গ এবং আপাতন বিন্দু প্রতিফলকের উপর অঙ্কিত অভিলম্ব একই সমতলে অবস্থান করে।
২. আপতন কোণ এবং প্রতিফলন কোণ পরস্পর সমান হয়।
খেলার মাঠে বক্তৃতা দিতে গেলে বক্তাকে খুব জোরে কথা বলতে হয় কেন
খেলার মাঠে বা খোলা মাঠে বক্তৃতা দিতে বক্তাকে সবসময় জোরে কথা বলতে হয়। এর কারণ হলো ঘরের মধ্যে বা আবদ্ধ জায়গায় আস্তে কথা বললেও শব্দের প্রতিফলনের মাধ্যমে তা ঘরের মধ্যে থাকা প্রত্যেক ব্যক্তির কাছে পৌঁছে যায়। কিন্তু খোলা মাঠে প্রতিফলনের এই সুবিধা পাওয়া যায় না। সেই কারণে বক্তাকে সর্বদা খোলা মাঠে জোরে কথা বলতে হয়।
আলোর প্রতিফলনের সঙ্গে শব্দের প্রতিফলনের পার্থক্য কি
শব্দতরঙ্গ এবং আলোক তরঙ্গের মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। তাই আলোর প্রতিফলন এবং শব্দের প্রতিফলনের মধ্যে পার্থক্য আছে বিস্তর।
নিচে আলোর প্রতিফলন এবং শব্দের প্রতিফলনের পার্থক্য আলোচনা করা হলো।
শব্দের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের তুলনায় অনেক বড় হওয়ায় শব্দের নিয়মিত প্রতিফলনের জন্য বিস্তৃত দরকার।
অপরপক্ষে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য খুব ছোট হওয়ায় আলোকরশ্মি প্রতিফলন ক্ষুদ্র হলেও আলো প্রতিফলিত হতে পারে।
অমসৃণ তলে শব্দের প্রতিফলন হওয়া সম্ভব। যেমন গাছের সারি পাহাড় বাড়ির দেওয়াল বিস্তৃত মাঠ মেঘ প্রভৃতি শব্দের প্রতিফলকের কাজ করে।
কিন্তু আলোর প্রতিফলন হতে গেলে মসৃণ তল অবশ্যই প্রয়োজন হয়। অমসৃণ তলে বিক্ষিপ্ত প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। যদি মসৃণ তল না হয় তাহলে আলোর নিয়মিত প্রতিফলন হবে না।
শব্দের প্রতিফলনের(ব্যবহার) ব্যবহারিক প্রয়োগ
আমাদের দৈনন্দিন জীবনের শব্দের প্রতিফলনের (ব্যবহার) ব্যবহারিক প্রয়োগ দেখা যায়। নিচে শব্দের প্রতিফলনের ব্যবহার সম্বন্ধে আলোচনা করা হলো।
১. হলঘর বা অডিটোরিয়াম:
শব্দের প্রতিফলনের ব্যবহারিক প্রয়োগ হালগড়া অডিটোরিয়ামে দেখা যায়। গান বাজনার আসর সভায় বক্তৃতা প্রভৃতি অনুষ্ঠানের জন্য অডিটোরিয়াম বা হলঘরকে বেছে নেওয়া হয়। যখন বক্তা অবতল প্রতিপালকের কাছে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করেন তখন তরঙ্গ প্রতিফলিত হয় সমানতরাল তরঙ্গ করছে পরিণত হয়। ফলে ঘরের শেষ প্রান্ত থেকে ও বক্তার বক্তব্য শ্রুতিগোচর হয়। এছাড়াও হলঘরের ছাদ অবতল করা হয়। ফলে ওই ঘরের ছাদ থেকে প্রতিফলিত হয়ে শব্দ শ্রোতার কানে স্পষ্টভাবে পৌঁছায়। তবে এক্ষেত্রে ঘরের দেয়াল থেকে প্রতিফলিত শব্দ যাতে মন শব্দের সঙ্গে মিশে না যায় সে জন্য ঘরের দেওয়াল গুলি প্যাড দিয়ে ঢাকা থাকে।
২. হাতের তালু
দূর থেকে আসা কোন শব্দ ভালো করে শোনার জন্য আমরা হাতের তালু কানের কাছে ধরি। এক্ষেত্রে হাতের তালু বাঁকানো হলে অবতল প্রতিফলকের কাজ করে, এবং শব্দও প্রতিফলিত হয়ে আমাদের কানে পৌঁছায়। ফলে দূর থেকে আসা চেইন শব্দ আমরা শুনতে পাই।
ঠিক এর প্রয়োগ কুকুরও করে থাকে। ক্ষীণ শব্দ শোনার জন্য কুকুর তার কান খাড়া করে।
৩. স্টেথোস্কোপ
চিকিৎসকরা বুক পরীক্ষার জন্য যে স্টেথোস্কোপ যন্ত্র ব্যবহার করেন তার কার্যপ্রণালী শব্দের প্রতিফলনের উপর প্রতিষ্ঠিত। স্টেথোস্কোপ যন্ত্রের দুটি রাবারের নলের প্রান্ত একসঙ্গে পাতলা পর্দায় ঢাকা একটি ধাতব চাকরির সঙ্গে যুক্ত থাকে। নল দুটির মুক্ত প্রান্তদ্বয় দুই কানে লাগিয়ে পর্দা ঢাকা চাকতিকে বুকে চেপে ধরল বুকের স্পন্দনের শব্দযন্ত্রের ভেতরের দেয়ালে বারবার প্রতিফলিত হয়ে চিকিৎসকের কানে পৌঁছায়। ওই শব্দতরঙ্গ বাইরে বিস্তার লাভ করে না। ফলে চিকিৎসক স্পষ্টভাবে বুকের স্পন্দনের শব্দ শুনতে পান।
৪. কথা বলার নল বা স্পিকিং টিউব
দূর থেকে পরিষ্কার ভাবে কথা বলার জন্য এক ধরনের ফাঁপা নল ব্যবহার করা হয়। একে স্পিকিং টিউব বলে। এটি ধাতুর তৈরি একটি ফাঁপা নল যার এক প্রান্তে একটি ফানেল লাগানো থাকে। একে মাউথপিস বলে। এই প্রান্তে কথা বললে শব্দ চারিদিকে ছড়িয়ে না গিয়ে ঘরের ভেতরের দেয়ালে বারবার প্রচলিত হয়ে বেশ জোরালোভাবে অপরপ্রান্তে পৌঁছায়। স্টিমার, জাহাজ, বড় বাড়িতে কথা বলার জন্য এই নল ব্যবহার করা হয়।