এই অধ্যায়ে আমরা রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল নিয়ে আলোচনা করব। ইন্টারেস্টিং একটি টপিক। একমাত্র হাইড্রোজেন ছাড়া অন্য যে কোন মৌল ইলেকট্রন প্রোটন নিউট্রন এই তিনটি মূল কণা দিয়ে গঠিত। সাধারণ হাইড্রোজেনের মধ্যে নিউট্রন কণিকা থাকে না।
ক্যাথোড রশ্মি পরমাণুর থেকে সৃষ্টি হয়। দেখা যায় ওই ক্যাথোড রশ্মির মধ্যে নেগেটিভ তড়িৎ গ্রস্ত কণায় ইলেকট্রন থাকে। কিন্তু পরমাণুর তড়িৎ নিরপেক্ষ। স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন আসে তাহলে ইলেকট্রনের সমান পজিটিভ কনাও থাকবে। পরবর্তীতে প্রমাণ হয় , পরমাণু থেকে যে পজেটিভ রশ্মি বের হয় তাতে প্রোটন কণা থাকে।
বিজ্ঞানী টমসনের পরমাণু মডেল
1901 সালে টমসন বলেন যে, পরমাণুর ধনাত্মক চার্জগুলো পরমাণুর মধ্যে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে এবং মাঝে মাঝে অনেকটা তরমুজের লাল অংশের মধ্যে কালো বিচিগুলির অবস্থানের মত ইলেকট্রনগুলি সুসজ্জিত আছে। কিন্তু বিজ্ঞানী রাদারফোর্ডের আলফা কণার বিক্ষেপণ পরীক্ষা টমসনের পরমাণু মডেলের অসারতা প্রমাণ করে।
রাদারফোর্ডের পরীক্ষা
1911 খ্রিস্টাব্দে পরমাণুর কোন অংশে প্রোটন কণা অবস্থান করে তা জানার জন্য বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড এই পরীক্ষাটি করেন। তিনি একটি বায়ুশূন্য নলের মধ্যে 0.0004 মিলিমিটার বেধ বিশিষ্ট সোনার পাতের উপর তীব্র গতি সম্পন্ন আলফা রশ্মি চালনা করেন। এর ফলে দেখা গেল যে——-
১. বেশিরভাগ আলফা-কণাই সোনার পাত ভেদ করে সোজাসুজি চলে যায় এবং অল্প সংখ্যক আলফা-কণা গতিপথ থেকে সামান্য বিচ্যুত হয়।
২. অতি অল্প সংখ্যক আলফা-কণা 90° বা তার চেয়ে বেশি কোন বিক্ষিপ্ত হয়।
৩. এদের মধ্যে দু একটি আলফা কণা ( প্রায় কুড়ি হাজার আলফা কণার মত একটি) যে পথে যায় আবার সেই পথে ফিরে আসে।
রাদারফোর্ডের সিদ্ধান্ত
এই পরীক্ষাটি থেকে রাধার পোর্ট সিদ্ধান্ত করেন কে,
১. যেহেতু অধিকাংশ আলফা কনা সোনার পাতটিকে ভেদ করে সোজা চলে যায়, সেজন্য বলা যায়, পরমাণুর ভেতরের বেশিরভাগ অংশ ফাঁকা। অর্থাৎ পরমাণু নিরেট নয়।
২. আলফা কণার ভর ইলেকট্রনের ভরের চেয়ে প্রায় 7500 গুণ, কাজেই পরমাণুর মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় এই ভারী আলফা কণার গতিপথ, আলফা কণার তুলনায় নগণ্য ভরবিশিষ্ট ইলেকট্রন কণা দ্বারা প্রভাবিত হয় না। ফলে পরমাণুর ইলেকট্রন কণাগুলির সঙ্গে ধাক্কা লাগলে আলফা কণাগুলো উল্টোদিকে ফেরেনা গিয়ে অথবা বেশি করে বেঁকে না গিয়ে ধাতুর পাত ভেদ করে সরলরেখায় বেরিয়ে যায়। এইজন্য আলফা কণার সঙ্গে ইলেকট্রন কণার সংঘর্ষে আলফা কণাগুলো বেঁকে যায় না।
৩. প্রায় কুড়ি হাজারটি আলফা কণার মধ্যে মাত্র একটি আলফা কণার যে পথে যায় সেই পথে ফিরে আসায় রাদারফোর্ড সিদ্ধান্ত করেন যে, পজিটিভ তড়িৎগ্রস্ত এবং যথেষ্ট ভারি আলফা কণাটি পরমাণুর ভিতরের অপর কোনো পজিটিভ চার্জের দ্বারা বিকর্শিত হয়ে ফিরে এসেছে। যে পজেটিভ চার্জ পরমাণুর খুব কম আয়তন অধিকার করে রয়েছে এবং পরমাণু সমস্ত ভরই ওই স্থানে কেন্দ্রীভূত হয়েছে।
রাদারফোর্ড পরমাণুর এই স্থানটির নাম দিলেন নিউক্লিয়াস। যেসব আলফা কণার বিচ্যুতির 90° এর বেশি সেগুলি নিউক্লিয়াসকে সরাসরি আঘাত করে 90° কোণে বিক্ষিপ্ত হয়েছে।
এই পরীক্ষার ফলাফল দেখে 1911 সালে রাদারফোর্ড পরমাণুর গঠনের যে মডেল উপস্থিত করেন নিচে তার আলোচনা করা হলো।
রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল
সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা ও সিদ্ধান্তের পর বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড পরমাণু মডেল প্রকাশ করেন। রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল নিম্নে বর্ণিত হলো।
১. প্রতিটি পরমাণুতে পজেটিভ আধান বিশিষ্ট একটি নিউক্লিয়াস আছে।
২. পরমাণুর নিউক্লিয়াসের আকার সমগ্র পরমাণুর তুলনায় খুবই ছোট। পরমাণুর ব্যাস যেখানে প্রায় 10-8 সেন্টিমিটার সেখানে নিউক্লিয়াসের ব্যাস 10-13 থেকে 10-12 সেন্টিমিটার হয়। অর্থাৎ নিউক্লিয়াসের ব্যাসের চেয়ে পরমাণুর ব্যাস প্রায় এক লক্ষ গুণ বড়।
৩. পরমাণুর অধিকাংশ স্থানই ফাকা এবং পরমাণু সমস্ত ভরই নিউক্লিয়াসে কেন্দ্রীভূত অবস্থায় থাকে।
৪. পরমাণুর তড়িৎ নিরপেক্ষ হাওয়ায় নিউক্লিয়াসের পজেটিভ তড়িৎগ্রস্ত প্রোটন সংখ্যা পরমাণুর বাইরের নেগেটিভ তড়িৎগ্রস্ত ইলেকট্রন সংখ্যা সমান থাকে।
৫. নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে পরমাণুর ইলেকট্রনগুলি কয়েকটি সুনির্দিষ্ট কক্ষপথে তীব্রবেগে নিউক্লিয়াসকে প্রদক্ষিণ করে। সাধারণ নিয়ম অনুসারে এই সময় পজিটিভ তড়িৎ গ্রস্ত কণা প্রোটন এবং নেগেটিভ তড়িৎগ্রস্ত কণা ইলেকট্রনের মধ্যে পারস্পারিক আকর্ষণের ফলে ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের উপর আছড়ে পড়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটে না। কারণ নিউক্লিয়াসকে বেষ্টন করে তীব্র গতিতে ঘোরার ফলে একদিকে ইলেকট্রন গুলিতে কেন্দ্রবহির্মুখী বলে সৃষ্টি হয়। আবার অন্যদিকে বিপরীতধর্মী আকর্ষণ বল ইলেকট্রন গুলোকে নিউক্লিয়াসের দিকে আকর্ষণ করে।
এই দুই সমান ও বিপরীতমুখী বলের ক্রিয়ায় ইলেকট্রনগুলি নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে অবিরাম ঘুরতে থাকে। রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলটি অনেকটা সৌরজগতের গঠনের মতো।
সৌরজগৎ ও পরমাণুর গঠনের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য বা পার্থক্য
সৌরজগৎ ও পরমাণুর গঠনের সাদৃশ্য
১. সৌরজগতের ঠিক কেন্দ্রে সূর্য থাকে। সূর্যকে কেন্দ্র করে অনেক দূরে থেকে বিভিন্ন কক্ষে বিভিন্ন গ্রহগুলির সূর্যের আবর্তন করে চলেছে। পরমাণুর কেন্দ্রে নিউক্লিয়াস থাকে আর নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কক্ষে এক বা একাধিক ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসকে আবর্তন করে চলেছে।
২. সমগ্র সৌরজগতের তুলনায় সূর্য এবং গ্রহগুলির আয়তন খুবই কম। অর্থাৎ সৌরজগতের বেশিরভাগ স্থানই ফাকা। পরমাণুর গঠনেও সেই রকম দেখা যায় যে পরমাণুর বেশিরভাগ স্থান ফাকা। সমগ্র পরমাণুর আয়তনের তুলনায় নিউক্লিয়াসে ইলেকট্রন কুলের মোট আয়তন অত্যন্ত নগণ্য।
৩. গ্রহগুলির তুলনায় সূর্যের ভর বহুগুণ বেশি। ইলেকট্রনের তুলনায় নিউক্লিয়াসের ভর বহুগুণ বেশি।
৪. সৌরজগতের গ্রহগুলির আবর্তন পথটি বৃত্তাকার নয়। সামান্য উপবৃত্তাকার আর সূর্য ওই উপবৃত্তের ফোকাসে থাকে। ইলেকট্রনের কক্ষপথ বৃত্তাকার এবং উপবৃত্তাকার দুইই হয়। নিউক্লিয়াস থাকে বৃত্ত বা বৃত্তের কেন্দ্র বা ফোকাসে।
৫. সূর্য এবং গ্রহ গুলির মধ্যে মহাকর্ষ বল ক্রিয়া করে, যার ফলে বিভিন্ন গ্রহগুলির নিজে নিজে কক্ষপথ থেকে ছিটকে বেরিয়ে যায় না। ঠিক তেমনি নিউক্লিয়াস এবং ইলেকট্রন গুলির মধ্যে তড়িৎ আকর্ষণ বল ক্রিয়া করে। তাই বিভিন্ন কক্ষের ইলেকট্রন কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয় না।
৬. সূর্যকে কেন্দ্র করে আবর্তন করার সময় গ্রহগুলির নিজের অক্ষের চারদিকে আবর্তন করে। ইলেকট্রনগুলি ও নিজ অক্ষের চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে আবর্তন করে।
সৌরজগত পরমাণু গঠনের বৈসাদৃশ্য
১. সৌরজগতের গ্রহগুলি মহাকর্ষ বলের প্রভাবে সূর্যের চারিদিকে নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরছে। কিন্তু পরমাণুতে ইলেকট্রন গুলি তড়িৎ আকর্ষণ বলের প্রভাবে নিউক্লিয়াসের চারদিকে ঘুরছে।
২. সৌরজগতে কোন একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে কেবলমাত্র একটি গ্রহ আবর্তন করে। কিন্তু পরমাণুতে একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে এক বা একাধিক ইলেকট্রন আবর্তন করতে পারে।
৩. সৌরজগতের সূর্য ও গ্রহ গুলি তড়িৎ গ্রস্ত নয় কিন্তু পরমাণুতে নিউক্লিয়াস পজিটিভ তড়িৎগ্রস্ত এবং ইলেকট্রনগুলি নেগেটিভ তড়িৎ গ্রস্ত কনিকা।
৪. সৌরজগতের গ্রহগুলি মহাকর্ষ বলের দরুন পরস্পরকে আকর্ষণ করে কিন্তু পরমাণুতে ইলেকট্রনগুলি সমজাতীয় তড়িৎগ্রস্ত কনা হওয়ায় পরস্পরকে বিকর্ষণ করে।
৫. সৌরজগতের বিভিন্ন গ্রহের ভর ও আয়তন আলাদা। কিন্তু পরমাণুর ইলেকট্রনগুলির ভর, আয়তন ও ধর্মে একই হয়।
৬. সৌরজগতের কোন কোন গ্রহের উপগ্রহ আছে যেমন পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদ কিন্তু ইলেকট্রনগুলির ঐরকম কোন ইলেকট্রন নেই।
৭. সৌরজগতের গ্রহগুলির কক্ষপথ মোটামুটি একই তলে অবস্থিত। কিন্তু পরমাণুতে ইলেকট্রন এর কক্ষপথগুলি একই তলে থাকে না।
৮. গ্রহগুলি নিজও নিজও কক্ষপথ পরিবর্তন করতে পারে না। কিন্তু পরমাণুর মধ্যে একটি ইলেকট্রন একটি স্থির কক্ষপথ থেকে অন্য কোন স্থির কক্ষপথে যেতে পারে।
রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলের ত্রুটি
রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলের প্রধানত দুটি ত্রুটি দেখা যায় যেমন
১. রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল অনুসারে নিউক্লিয়াসের চারিদিকে বৃত্তাকারে কক্ষে ইলেকট্রন গুলি ঘুরতে থাকে। এই ঘূর্ণনের ফলে যে কেন্দ্রাতিগ বলের সৃষ্টি হয় তা নিউক্লিয়াস দ্বারা স্থির তড়িৎ আকর্ষণ বলের সমান ও বিপরীত। কিন্তু তড়িৎ গতিবিদ্যা অনুসারে নেগেটিভ তড়িৎ গ্রস্ত ইলেকট্রনগুলি পজিটিভ তড়িৎগ্রস্ত নিউক্লিয়াসের চারদিকে ঘুরতে থাকলে, ইলেকট্রনগুলি শক্তি বিকিরণ করবে। ফলে ইলেকট্রনগুলি শক্তি ক্রমশ কমতে থাকবে এবং ক্রমাগত শক্তিক্ষয়ের দরুন ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের দিকে এগিয়ে যাবে। একসময়ের নিউক্লিয়াসের উপর ইলেকট্রনগুলি গিয়ে আছড়ে পড়বে। সুতরাং পরমাণুতে ইলেকট্রন এর নিজস্ব অস্তিত্ব লোপ পাবে এবং পরমাণু অস্থায়ী হবে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে পরমাণু সুস্থিত। অতএব রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল পরমাণুর স্থায়িত্ব ব্যাখ্যা করতে পারে না।
২. রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল অনুসারে পরমাণুতে ঘূর্ণায়মান ইলেকট্রন অবিরাম শক্তি বিকিরণ করলে পরমানুর যে বর্ণালী পাওয়া যাবে তা নিরবিচ্ছিন্ন বর্ণালী হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে হাইড্রোজেন পরমাণুর ক্ষেত্রে রেখা বর্ণালী পাওয়া যায়। রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল এই রেখা বর্ণালী এর উৎপত্তি ব্যাখ্যা করতে পারে না।
1913 খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী নীলস বোর রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলের ত্রুটিগুলি সংশোধন করে নতুন পরমাণু মডেল উপস্থাপন করেন। এখানে কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রয়োগ করা হয়।
কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রয়োগ
নীলস বোর কোয়ান্টাম তত্ত্ব ও প্রয়োগ করে পরমাণুর গঠন ব্যাখ্যা করেন
১. পরমাণুর ভেতর এমন কয়েকটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে আছে যেগুলোর মধ্যে ইলেকট্রনগুলি আবর্তন করলে ওদের মধ্যে থেকে শক্তি বিকিরণ হয় না। অর্থাৎ ওরা শক্তি হারায় না। এর ফলে ইলেকট্রনগুলি শক্তি হারিয়ে নিউক্লিয়াসের উপর গিয়ে কখনো পড়তে পারেনা।
২. সুতরাং বলা যায়, পরমাণুর মধ্যে কেবল কয়েকটি নির্দিষ্ট শক্তিবিশিষ্ট কক্ষেই ইলেকট্রনগুলি আবর্তন করে।
৩. এই কক্ষপথগুলি বৃত্তাকার বৃত্তাকার দুই রকমের হতে পারে।