লিভার এর যান্ত্রিক সুবিধা
লিভার হলো একটি সরল বা বাঁকান দণ্ড যার একটি নির্দিষ্ট বিন্দু থাকে এবং ওই বিন্দুকে কেন্দ্র করে দণ্ডটি ওই বিন্দুর চারিদিকে অবাধে ঘুরতে পারে।
যে স্থির বিন্দুকে কেন্দ্র করে লিভারটি চারপাশে ঘুরতে পারে তাকে আলম্ব বলে। এই আলম্বের একই দিকে বা বিপরীত দিকে অবস্থিত দুটি বিন্দুর একটিতে বল প্রয়োগ করা হয় এবং অন্যটিতে ভার থাকে।
আলম্ব থেকে বলের প্রয়োগ বিন্দুর দূরত্বকে বলবাহু বলে।
আলম্ব থেকে ভারের প্রয়োগ বিন্দুর দূরত্বকে রোধবাহু বলে।
প্রযুক্ত বল এবং ভারের ক্রিয়ায় যদি কোন লিভার অনুভূমিক অবস্থায় আসে তবে প্রযুক্ত বল ও বল বাহুর গুণফল এবং ভার এবং রোধবাহুর গুণফল পরস্পর সমান হয়।
অর্থাৎ, প্রযুক্ত বল×বলবাহু=ভার×রোধবাহু।
লিভারের শ্রেণীবিভাগ
আলম্ব বিন্দু, প্রযুক্ত বল, ভারের প্রয়োগ বিন্দুর বিভিন্ন অবস্থানের ভিত্তিতে লিভারকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়
১. প্রথম শ্রেণীর লিভার
২. দ্বিতীয় শ্রেণীর লিভার এবং
৩. তৃতীয় শ্রেণীর লিভার।
প্রথম শ্রেণীর লিভার
যে লিভারের আলম্ব বিন্দুর একদিকে ভার এবং অন্যদিকে বল ক্রিয়া করে, তাকে প্রথম শ্রেণীর লিভার বলে। প্রথম শ্রেণীর লিভারের যান্ত্রিক সুবিধা 1 এর বেশি হয়। কারণ এক্ষেত্রে বলবাহু রোধবাহুর চেয়ে বড় হয়।
ছবি দ্বারা বোঝার চেষ্টা করি…
এই ছবিতে C আলম্ব বিন্দু। এখানে AC বলবাহু এবং BC রোধবাহু। W ভার, P বিন্দুতে প্রযুক্ত বল।
প্রথম শ্রেণীর লিভারের যান্ত্রিক সুবিধা
লিভারের সাম্যবস্থায়
প্রযুক্ত বল × বল বাহু = ভার × রোধবাহু
প্রথম শ্রেণীর লিভারের সাধারণত বলবাহু AC, রোদ বাহু BC এর চেয়ে বড় হয়। তাই প্রথম শ্রেণীর লিভারের যান্ত্রিক সুবিধা 1 এর চেয়ে বেশি হয়, অর্থাৎ এই লিভারে কম বল প্রয়োগ করে বেশি যান্ত্রিক সুবিধা ভোগ করা যায়।
প্রথম শ্রেণীর লিভারের উদাহরণ
পেরেক তোলার যন্ত্র, রেললাইন উঁচু করার দন্ড, মাটির তলার বেলচা, কোদাল, সাঁড়াশি, ভারী বস্তু তোলার শাবল, তুলাদন্ড, ঢেঁকি, নলকূপের হাতল প্রভৃতি।
ব্যতিক্রম… সাঁড়াশি এবং কাঁচিতে প্রথম শ্রেণীর দুইটি লিভার একত্রে কাজ করে। প্রথম শ্রেণীর লিভারের প্রযুক্ত বলের অভিমুখ ভারের অভিমুখে হয়।
দ্বিতীয় শ্রেণীর লিভার
যে লিভারের এক প্রান্তে আলম্ব থাকে এবং অপর প্রান্তে বল প্রয়োগ করা হয় এবং আলম্ব ও বলপ্রয়োগ বিন্দুর মধ্যবর্তী কোন স্থানে ভার ক্রিয়া করে, তাকে দ্বিতীয় শ্রেণীর লিভার বলে।
অর্থাৎ দ্বিতীয় শ্রেণীর লিভারে আলম্বের একইদিকে ভার ও বল বিন্দু অবস্থান করে।
দ্বিতীয় শ্রেণীর লিভারের প্রযুক্ত বলের অভিমুখ ভারের অভিমুখের বিপরীতে হয়।
দ্বিতীয় শ্রেণীর লিভারের যান্ত্রিক সুবিধা
ধরা যাক AC দ্বিতীয় শ্রেণীর লিভার যারা আলম্ববিন্দু C। লিভারটির A বিন্দুতে প্রযুক্ত বল এবং B বিন্দুতে ভার W ক্রিয়া করছে। লিভারের বলবাহু AC এবং রোধবাহু BC।
এ ক্ষেত্রে প্রযুক্ত বল × বলবাহু = ভার × রোধবাহু
বা, P× AC= W×BC
বা, W/P=AC/BC
অতএব যান্ত্রিক সুবিধা = W/P = AC/BC = বলবাহু/রোধ বাহু
দ্বিতীয় শ্রেণীর লিভারের বলবাহু রোধবাহু থেকে বড় হওয়ার জন্য যান্ত্রিক সুবিধা সর্বদায় 1 এর বেশি হয়।
দ্বিতীয় শ্রেণীর লিভারের সবসময় যান্ত্রিক সুবিধা পাওয়া যায়। তাই দ্বিতীয় শ্রেণীর লিভারে কম বল প্রয়োগ করে বেশি ভার তোলা যায়। রোধবাহুর তুলনায় বলবাহু যত বড় হবে দ্বিতীয় শ্রেণীর লিভারের যান্ত্রিক সুবিধাও ততো বেশি হবে।
দ্বিতীয় শ্রেণীর লিভারের উদাহরণ
চলন্ত নৌকার দাঁড়, এক চাকার হাত গাড়ি, সুপারি কাটার যন্ত্র যাঁতি, ছিপি খোলার চাবি ইত্যাদি হলো তৃতীয় শ্রেণীর লিভারের উদাহরণ।
তৃতীয় শ্রেণীর লিভার
যে লিভারে আলম্বের একই দিকে ভার এবং বলের প্রয়োগ বিন্দু থাকে এবং রোধবাহুটি বল বাহুর চেয়ে বড় হয়, তাকে তৃতীয় শ্রেণীর লিভার বলে।
তৃতীয় শ্রেণীর লিভারের প্রযুক্ত বলের অভিমুখ ভারের অভিমুখের বিপরীত দিকে হয়।
তৃতীয় শ্রেণীর লিভারের যান্ত্রিক সুবিধা
তৃতীয় শ্রেণীর লিভারের যান্ত্রিক সুবিধা = বলবাহু/রোধবাহু
তৃতীয় শ্রেণীর লিভারের বলবাহু রোধবাহুর থেকে ছোট হওয়ার জন্য এর যান্ত্রিক সুবিধা 1 এর কম হয়। ফলে কম ভার তুলতে এই লিভারে বেশি বল প্রয়োগ করতে হয়। সুতরাং বলা যেতে পারে এই লিভারের কোন যান্ত্রিক সুবিধা নেই।
তৃতীয় শ্রেণীর লিভারের উদাহরণ
মাছ ধরার ছিপ, মুখের চোয়াল, চিমটা, মাল তোলা ক্রেন, পাউরুটি কাটার ছুরি, মানুষের হাত প্রভৃতি তৃতীয় শ্রেণীর লিভারের উদাহরণ। চিমটাতে তৃতীয় শ্রেণীর দুটি লিভার একসঙ্গে কাজ করে।
লিভার সম্বন্ধীয় প্রশ্নোত্তর
সাধারণ তুলাযন্ত্র কি একটি লিভার
লিভারে যেসব অংশ বর্তমান থাকে, যেমন আলম্ব বিন্দু, বলবাহু, রোধবাহু, ইত্যাদি তুলা যন্ত্রে সেইসব অংশ বর্তমান। তুলাযন্ত্রের দন্ডের ঠিক মাঝখানে আলম্ব বিন্দু থাকে। বল বাহুতে বাটখারা এবং ভারবাহুতে বস্তু রাখা থাকে। যেহেতু তুলা যন্ত্রের আলম্ব বিন্দুর একপাশে বলবাহু এবং তার বিপরীত পাশে রোধ বাহু থাকে, তাই তুলা যন্ত্র একটি প্রথম শ্রেণীর লিভার। এর যান্ত্রিক সুবিধা সবসময় 1 হয়। কারণ এক্ষেত্রে বল বাহু এবং রোধবাহু সমান হয়।
প্রথম শ্রেণীর লিভারে সব সময় যান্ত্রিক সুবিধা পাওয়া যায় কি
প্রথম শ্রেণীর লিভারে সব সময় সুবিধা পাওয়া যায় এটা আমরা জানি বটে কিন্তু কখনো কখনো এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। একটি উদাহরণের দেখি
ক) সাধারণত তুলাযন্ত্র তুলাদন্ডটি একটি প্রথম শ্রেণীর লিভার। কিন্তু তুলাদন্ডে বল বাহু এবং রোধবাহু পরস্পর সমান হয়। তাই এই লিভারটি থেকে কোন যান্ত্রিক সুবিধা পাওয়া যায় না। আবার
খ) ঢেঁকি এমন একটি প্রথম শ্রেণীর লিভার যার বোলবাহু রোধবাহুর চেয়ে ছোট হয়। অর্থাৎ ঢেঁকি থেকেও কোন যান্ত্রিক সুবিধা পাওয়া যায় না।
সুতরাং, বলা যেতে পারে প্রথম শ্রেণীর লিভারের সবসময় যান্ত্রিক সুবিধা পাওয়া যায় না।
টিউবওয়েলের হাতল এবং ভারী বস্তু তোলার শাবলকে প্রথম শ্রেণীর লিভার বলা হয় কেন
টিউবওয়েলের হাতল এবং ভারী বস্তু তোলার শাবল প্রথম শ্রেণীর লিভার। কারণ অভয় যন্ত্রতেই আলম্ব বিন্দু থাকে। এবং এই আলম্ব বিন্দুর একদিকে ভার এবং অন্যদিকে প্রযুক্ত বল ক্রিয়া করে। আবার উভয় যন্ত্রের বল বাহু ও রোধ বাহুর চেয়ে বড় হয়। এবং এই যন্ত্র দুটির প্রত্যেকটি যান্ত্রিক সুবিধা 1 এর চেয়ে বেশি হয়। তাই বলা যায় যে, টিউবয়েলে হাতল এবং ভারী বস্তু তোলার শাবল প্রথম শ্রেণীর লিভার।
সাধারণ তুলা যন্ত্রের যান্ত্রিক সুবিধা কত
সাধারণ তুলাযন্ত্রের তুলাদন্ডটি একটি প্রথম শ্রেণীর লিভার। যার বল বাহু এবং রোধ বাহু পরস্পর সমান। আমরা জানি প্রথম শ্রেণীর লিভারের যান্ত্রিক সুবিধা = (বল বাহু/রোধ বাহু) = 1
অতএব সাধারণ তুলা যন্ত্রের তুলাদন্ড টির যান্ত্রিক সুবিধা 1।
এক চাকার হাত গাড়িতে সর্বদা যান্ত্রিক সুবিধা বেশি পাওয়া যায় কেন
আমরা জানি এক চাকার হাত গাড়ি একটি দ্বিতীয় শ্রেণীর লিভার। এক চাকার হাতঘড়ির এক প্রান্তে আলম্ব এবং অন্য প্রান্তে প্রযুক্ত বল ক্রিয়া করে। এছাড়া গাড়িটির ভারের ক্রিয়া বিন্দু আলম্ব প্রযুক্ত বলের ক্রিয়া বিন্দুর মধ্যবর্তী স্থানে থাকে। এই কারণে এক টাকা আর হাত গাড়িতে যান্ত্রিক সুবিধা 1 এর চেয়ে বেশি হয় অর্থাৎ এই গাড়িতে সর্বদাই যান্ত্রিক সুবিধা পাওয়া যায়।
দ্বিতীয় শ্রেণীর লিভারের সর্বদাই যান্ত্রিক সুবিধা পাওয়া যায় কেন
দ্বিতীয় শ্রেণীর লিভারের যান্ত্রিক সুবিধা বেশি পাওয়া যায় তার কারণ হলো দ্বিতীয় শ্রেণীর লিভারের একপ্রান্তে আলম্ব এবং অন্য প্রান্তে বল প্রযুক্ত হয়, আলম বিন্দু এবং প্রযুক্ত বল বিন্দুর মাঝে ভার থাকে। দ্বিতীয় শ্রেণীর লিভারের সর্বদাই বলবাহু রোধবাহুর চেয়ে বড় হয় এবং যান্ত্রিক সুবিধা সর্বদায় একের বেশি থাকে।
মানুষের হাত কে তৃতীয় শ্রেণীর লিভার বলা হয় কেন
কনুইয়ের সামনের মাংস পেশিতে ঊর্ধ্বমুখী বল প্রয়োগ করে হাতের তালুতে রাখা কোন ভারকে উপরে তোলা যায়। এখানে কোনুই আলম্বের কাজ করে। এই ব্যবস্থায় কনুই থেকে হাতের তালু পর্যন্ত অংশটির লিভার দণ্ড, যার এক প্রান্তে আলম্ব এবং অপর প্রান্তে ভার ক্রিয়াশীল থাকে। প্রযুক্ত বল লিভারটির আলম্ব ও ভারের মধ্যবর্তী বিন্দুতে ক্রিয়া করে। এখানে ভারও প্রযুক্ত বল পরস্পর পরস্পরের বিপরীত মুখে ক্রিয়া করে। এছাড়া বলবাহু, রোধবাহু থেকে ছোট হয় বলে যান্ত্রিক সুবিধা 1 এর কম হয়। তাই হাতকে তৃতীয় শ্রেণীর লিভার বলা হয়।
যান্ত্রিক সুবিধা না থাকা সত্ত্বেও আমরা তৃতীয় শ্রেণীর লিভার ব্যবহার করি কেন
তৃতীয় শ্রেণীর লিভারের বল বাহু রোধ বাহুর থেকে ছোট। তাই সর্বদা এই যান্ত্রিক সুবিধা 1 এর কম হয় অর্থাৎ ভারকে তুলতে বেশি বল প্রয়োগ করতে হয়। কিন্তু যান্ত্রিক সুবিধা না থাকা সত্ত্বেও আমরা তৃতীয় শ্রেণীর লিভার ব্যবহার করে থাকি। কারণ
১. কখনো কখনো ভার তোলার জন্য সরাসরি বল প্রয়োগের সুযোগ থাকে না তাই আমরা তৃতীয় শ্রেণীর লিভার ব্যবহার করি।
২. আবার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর লিভার ব্যবহার করারও সুযোগ থাকে না সে কারণেও সেই ক্ষেত্রে আমরা তৃতীয় শ্রেণীর লিভার ব্যবহার করে থাকি।
৩. তুলনায় তৃতীয় শ্রেণীর লিভারের প্রযুক্ত বলের প্রয়োগ বিন্দু সরণের চেয়ে বাধার বিরুদ্ধে সরণের মান বেশি হয়। তাই যেসব ক্ষেত্রে ভারের সরণ বেশি হওয়ার প্রয়োজন হয় সেই সব ক্ষেত্রে তৃতীয় শ্রেণীর লিভার ব্যবহার করা হয়। যেমন ক্রেন একটি তৃতীয় শ্রেণীর লিভার। বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে খুব ভারী বস্তু এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরাতে সাধারণত ক্রেন ব্যবহার করা হয়।