এর আগের অধ্যায়ে আমরা পরমাণুর গঠন এবং রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেল সম্বন্ধে বিস্তারিত জেনেছিলাম। কিন্তু 1932 খ্রিস্টাব্দে নিউট্রন কণা আবিষ্কার হওয়ার ফলে, পরমাণুর গঠন সম্বন্ধে ধারণা আবার কিছুটা বদলে যায়। এইভাবে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার পর বর্তমানে পরমাণুর গঠন চিত্র পাওয়া যায় তার বর্ণনা নিচে বিস্তারিতভাবে দেওয়া হল।
পরমাণুর গঠনের বর্তমান চিত্র
প্রতিটি পরমানুর দুটি অংশে থাকে যথা A . নিউক্লিয়াস বা পরমাণু কেন্দ্র এবং B. নিউক্লিয়াসের বাইরের ইলেকট্রন বিন্যাস
A. নিউক্লিয়াস বা পরমাণু কেন্দ্রক
1 পরমাণুর কেন্দ্রস্থলে অতি অল্প স্থান জুড়ে পজিটিভ তড়িৎগ্রস্ত গুরুভার যে অংশটিতে পরমাণুর প্রায় সব ভর কেন্দ্রীভূত থাকে তাকে নিউক্লিয়াস বা পরমাণুকেন্দ্র বলে।
2. পরমাণুর বেশিরভাগই স্থানই ফাঁকা। সমগ্র পরমাণুর নিউক্লিয়াসের আয়তন খুবই কম। নিউক্লিয়াসের ব্যাস পরমাণুর ব্যাসের এক লক্ষ ভাগের এক ভাগ মাত্র।
3. নিউক্লিয়াসের দু’রকম মূল কণা থাকে যথা প্রোটন ও নিউট্রন। নিউক্লিয়াসের এই দু’রকম মূল কণাকে (অর্থাৎ প্রোটন ও নিউট্রন) একসঙ্গে নিউক্লিয়ন বা কেন্দ্রীয় কণা বলা হয়।
বিভিন্ন মৌলের ক্ষেত্রে নিউক্লিয়াসের প্রোটন ও নিউট্রন সংখ্যা বিভিন্ন হয়। যেমন হিলিয়াম মৌলের নিউক্লিয়াসে 2 টি প্রোটন ও 2টি নিউট্রন আছে। আবার সোডিয়ামের নিউক্লিয়াসের 11টি প্রোটন ও 12টি নিউট্রনের সমন্বয়ে গঠিত। সাধারণ হাইড্রোজেন পরমাণুতে কোন নিউট্রন কনা না থাকায় সবচেয়ে হালকা এই মৌলের নিউক্লিয়াসে কেবলমাত্র 1 প্রোটন কণা আছে।
4. প্রোটন কণিকার উপস্থিতির জন্য নিউক্লিয়াস পজিটিভ তড়িৎগ্রস্ত হয়।
5. নিউক্লিয়াসের মধ্যে প্রোটন ও নিউট্রন একসঙ্গে ঠাসাঠাসি করে থাকে। ইলেকট্রনের ভর নিউক্লিয়াসের ভরের তুলনায় নগণ্য বলে নিউক্লিয়াসের ভরই মৌলের পরমাণুর ভর অর্থাৎ পরমাণুর ভর = প্রোটনের ভর + নিউট্রনের ভর।
6. নিউক্লিয়াসের ঘনত্ব খুব বেশি। যদি এক ঘন সেন্টিমিটার নিউক্লিয়াসকে একসঙ্গে রাখা যেত তবে তার ভর হতে প্রায় 25 হাজার কোটি কিলোগ্রাম।
7. পরমাণুর মধ্যে সবচেয়ে সুস্থিত অংশটি হলো নিউক্লিয়াস। কোন রাসায়নিক বিক্রিয়া নিউক্লিয়াসের পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। আবার নিউক্লিয়াস ধ্বংস হলে পরমাণুর অস্তিত্ব লোপ পায়।
নিউক্লিয় বল
হাইড্রোজেন পরমাণুর ছাড়া অন্য সব মৌলের পরমাণুর নিউক্লিয়াসে অতি অল্প স্থানের মধ্যে একাধিক প্রোটন করা রয়েছে। নিউক্লিয়াসের এই পজেটিভ তড়িৎধর্মী প্রোটন কণাগুলি পরস্পর পাশাপাশি অবস্থান করায় এদের মধ্যে প্রবল বিকর্ষণ বল ক্রিয়া করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সমজাতীয় পজেটিভ চার্জযুক্ত প্রোটনগুলি পরস্পর বিকর্ষীত না হয়ে নিউক্লিয়াসের অতি অল্প স্থানের মধ্যে এক সঙ্গে থাকছে কি করে? এর কারণ হলঃ নিউক্লিয়াসে প্রোটন কণাগুলো যখন নিউট্রন কণার সঙ্গে পাশাপাশি থাকে তখন প্রোটন ও নিউট্রন কণার মধ্যে মেসন নামে এক রকমের কনার অবিরাম আদান প্রদানের দরুন প্রোটন কণাগুলি নিউট্রনের এবং নিউট্রন কণাগুলি প্রোটনে রূপান্তরিত হয়। ফলে প্রোটন কণাগুলির মধ্যে বিকর্ষণ বল কার্যকরী হতে পারে না। উপরন্তু নিউট্রন ও প্রোটনের মধ্যে দ্রুত চার্জ বিনিময়ের ফলে নিউক্লিয়াসের কনাগুলির মধ্যে একটি তীব্র আকর্ষণ জনিত বলের সৃষ্টি হয়। এই আকর্ষণজনিত বলই নিউক্লিয় বল। এই আকর্ষণ বলের প্রভাবে পজিটিভ চার্জযুক্ত প্রোটন কণাগুলোই বিকর্ষীত না হয়ে পরস্পরের একসঙ্গে অবস্থান করে এবং নিউক্লিয়াসটি বেশি স্থায়ী হয়। নিউক্লিয় বল খুব শক্তিশালী। কিন্তু এই বলের ক্রিয়া নিউক্লিয়াসের ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।
নিউক্লিয়াসের আকার যত বড় নিউক্লিয় বল তত দুর্বল হয়। ইউরোনিয়াম রেডিয়াম প্রভৃতি ভারী মৌলের নিউক্লিয়াসের ক্ষেত্রে প্রোটন ও নিউট্রন সংখ্যার পার্থক্য বেশি বলে নিউক্লিয় বল প্রোটন ও নিউট্রন গুলিকে একসঙ্গে ধরে রাখতে পারে না। তখন নিউক্লিয়াস অস্থায়ী ও ভঙ্গুর হয়। এই সব মৌলের নিউক্লিয়াস থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তেজস্ক্রিয় রশ্মি নির্গত হতে থাকে এবং অবশেষে নিউক্লিয়াস ভেঙে অন্য কোনো স্থায়ী পরমাণু সৃষ্টি করে।
তেজস্ক্রিয়তা
নিউক্লিয়াসের আকার যত বাড়ে নিউক্লিয় বলও ততই দুর্বল হয়। যেসব পরমাণুর নিউক্লিয়াসের আকার বড়, অর্থাৎ যেসব নিউক্লিয়াসের মধ্যে প্রোটন ও নিউট্রন সংখ্যা বেশি সেইসব নিউক্লিয়াসের নিউক্লিয় বল কম হয়। এছাড়া রেডিয়াম ইউরেনিয়াম থোরিয়াম প্রভৃতি যেসব ভারী মৌলের পরমাণুর নিউক্লিয়াসের মধ্যে প্রোটনের চেয়ে নিউট্রনের সংখ্যা বেশি হয় সেইসব পদার্থের নিউক্লিয় বল তাদের নিউক্লিয়াসের প্রোটন ও নিউট্রন গুলিকে একসঙ্গে ধরে রাখতে পারেনা। ফলে এইসব পদার্থের নিউক্লিয়াস থেকে সবসময় তেজস্ক্রিয় রশ্মির আকারে আলফা কনা, বিটা কণা এবং গামা রশমি বেরিয়ে যেতে থাকে। এই জন্য এদের নিউক্লিয়াস অস্থায়ী এবং ভঙ্গুর হয় এবং নিউক্লিয়াসের পারমাণবিক সংখ্যার পরিবর্তনের নতুন পরমাণুর সৃষ্টি হয়। নিউক্লিয়াসটি সাম্য অবস্থায় না আসা পর্যন্ত ( অর্থাৎ নিউক্লিয়াসে নিউট্রন ও প্রোটনের অনুপাতের কম না হওয়া পর্যন্ত ) পারমাণটির ভাঙ্গন চলতে থাকে। ভারী মৌলের পরমাণুর সতস্ফুর্ত ভাঙ্গণের ঘটনাকে তেজস্ক্রিয়তা বলে।
নিউক্লিয়াসের বাইরে ইলেকট্রন বিন্যাস
পরমাণুর গঠন সম্বন্ধে ভালভাবে জানতে নিউক্লিয়াসের বাইরে ইলেকট্রন বিন্যাস জানা খুবই প্রয়োজন।
১. পরমাণুর তড়িৎ নিরপেক্ষ বলে পরমাণুর মধ্যে মোট পজেটিভ ও নেগেটিভ তড়িৎএর পরিমাণ সমান হয়, অর্থাৎ পরমাণুর প্রোটন সংখ্যা এবং ইলেকট্রন সংখ্যা সমান হবে। প্রত্যেকটি পরমাণুর নিউক্লিয়াসে মোট কতগুলো প্রোটন থাকে নিউক্লিয়াসের বাইরে অর্থাৎ পরমাণুর বাকি অংশেও ঠিক ততগুলো ইলেকট্রন সজ্জিত থাকে। একে পরমাণুর ইলেকট্রন মহল বলে। এইজন্য পরমাণুর ইলেকট্রন সংখ্যাকে পরোক্ষভাবে পরমাণুর পরমাণু ক্রমাঙ্ক বলা চলে।
২. সৌরজগতের গ্রহগুলি যেমন সূর্যকে কেন্দ্র করে নিজ নিজ কক্ষপথে অবিরাম আবর্তিত হচ্ছে, পরমাণুর ইলেকট্রনগুলি ও সেইরকমভাবে নিউক্লিয়াসকে ঘিরে ক্রমবর্ধমান ব্যাসের কতকগুলি সমকেন্দ্রিক কিন্তু বিভিন্ন সময়ে অবস্থিত বৃত্তাকার এবং উপবৃত্তাকার পথে তীব্র বেগে ঘুরছে।
৩. ইলেকট্রনগুলো নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ক্রমবর্ধমান ব্যাসের মোট সাতটি নির্দিষ্ট কক্ষপথে আবর্তন করে। ইলেকট্রনগুলির আবর্তনের এই পথকে স্থির কক্ষপথ বা মুখ্য শক্তি স্তর বা কোয়ান্টাম স্তর (n) বলে। নিউক্লিয়াস থেকে ক্রমবর্ধমান দূরত্ব অনুসারে কক্ষপথগুলি কে যথাক্রমে K ( n=1), L (n=2), M ( n=3) , N (n=4), O (n=5), P (n=6), Q (n=7) কক্ষপথ বলে। n এর মান যত কম হবে ইলেকট্রনের কক্ষপথটি ততই পরমাণুর নিউক্লিয়াসের নিকটবর্তী হবে। এইসব কক্ষপথগুলিতে আবর্তন কাল ইলেকট্রনগুলি শক্তি বিকিরণ করে না, ফলে এই কক্ষপথ গুলির গড় শক্তির পরিমাণ নির্দিষ্ট থাকে।
৪. কোন একটি বিশেষ শক্তিস্তরে যেকোনো সংখ্যক ইলেকট্রন থাকতে পারে না। প্রত্যেকটি মুখ্য শক্তি স্তরের সর্বাধিক ইলেকট্রন সংখ্যা সর্বদা নির্দিষ্ট থাকে। ইলেকট্রনের এই নির্দিষ্ট সংখ্যাটি হল 2×n², যেখানে n = মুখ্য শক্তি স্তরের ক্রমিক সংখ্যা। নিউক্লিয়াস থেকে দূরত্ব অনুসারে n = 1, 2, 3, 4, 5, 6, 7 হতে পারে।
৫. অবশ্য যেকোন ইলেকট্রনীয় কক্ষে সর্বোচ্চ ইলেকট্রন সংখ্যা 2×n² হলেও এর কয়েকটি সীমাবদ্ধতা আছে। যেমন
ক) n এর মান 4 এর বেশি হলেও ওই কক্ষপথে সর্বোচ্চ ইলেকট্রন সংখ্যা 32 এর বেশি হয় না।
খ) যে কোন পরমাণুতে সবচেয়ে বাইরের কক্ষে আটটির বেশি ইলেকট্রন থাকতে পারে না।
গ) সবচেয়ে বাইরের কক্ষের ঠিক আগের কক্ষপথে 18 এর বেশি ইলেকট্রন থাকতে পারে না।
৬. যে সব মৌলের পরমাণুর সবচেয়ে বাইরের কক্ষে ৮ টি ইলেকট্রন থাকে তাদের নিষ্ক্রিয় মৌল বলে। ওইসব পরমাণু রাসায়নিক বিক্রিয়ার দিক থেকে খুবই নিষ্ক্রিয়। নিয়ন (Ne), আর্গন (Ar), ক্রিপটন (Kr), জেনন (Xe),রেডন (Rn) প্রভৃতি গ্যাসগুলি এই শ্রেণীভূক্ত। এছাড়া নিষ্ক্রিয় গ্যাস হেলিয়ামের একটি মাত্র ইলেকট্রনীয় কক্ষপথে ২টি ইলেকট্রন থাকে।