ডাল্টনের পরমাণুবাদ পর্যালোচনা করার পরে কিছু সামনে আসে। এই অধ্যায়ে আমরা পরমাণু, পরমাণুর বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম, অনু, অনুর প্রকারভেদ, মৌলিক ও যৌগিক অণু, পারমানবিকতা, গ্রাম পরমাণু বা গ্রাম পারমাণবিক গুরুত্ব, গ্রাম আণবিক গুরুত্ব বা 1 গ্রাম অনু বা 1 গ্রাম মোল, গ্রাম আণবিক আয়তন বা মোলার আয়তন, গ্রাম আণবিক ওজনের ব্যবহারিক প্রয়োগ এবং গ্রাম আণবিক আয়তন এর ব্যবহারিক প্রয়োগ সম্বন্ধে বিস্তারিত ভাবে জানবো।
পরমাণু
কোন মৌলিক পদার্থকে ভেঙে ফেললে সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম কণা পাওয়া যাবে। পরমাণুকে আর ভাঙা যায় না এবং যার মধ্যে মৌলিক পদার্থের সব গুণ বর্তমান থাকে।
পরমাণুর সংজ্ঞা
মৌলিক পদার্থের ক্ষুদ্রতম অবিভাজ্য কনা, যা রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে তাকে পরমাণু বলে।
H, O, C, Ca, Cl প্রভৃতি তারা যথাক্রমে হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন, ক্যালসিয়াম, ক্লোরিনের একটি করে পরমাণুকে বোঝায়। 2H বলতে হাইড্রোজেনের দুটি পরমাণুকে বোঝায়।
নিষ্ক্রিয় গ্যাস এবং ধাতু ছাড়া অন্যান্য মৌলের পরমাণু স্বাধীনভাবে থাকতে পারে না। পরমাণুর মধ্যে মৌলের সব ধর্ম বর্তমান থাকে।
পরমাণুর বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম
পরমাণুর বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম পয়েন্ট আকারে আলোচনা করা হলো
১. পরমাণু হলো মৌলিক পদার্থের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম কণা, যার মধ্যে মৌলিক পদার্থের সমস্ত ধর্ম বজায় থাকে। পৃথিবীতে 105 রকম মৌলিক পদার্থ পাওয়া যায়, কাজেই 105 রকম বিভিন্ন ধর্মের ও ওজনের পরমাণু পাওয়া যায়।
২. মৌলিক পদার্থের পরমাণুর বলে যখন পরস্পরের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়া দ্বারা যুক্ত হয়ে ভিন্ন ধর্ম বিশিষ্ট অন্য পদার্থ উৎপন্ন করে, তখন সেই পদার্থের মধ্যে পরমাণু গুলির নিজের নিজের ধর্ম প্রকাশ পায় না। যেমন দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু এবং একটি অক্সিজেন পরমাণু রাসায়নিক বিক্রিয়া করে একটি জলের অনুর গঠন করে। জলের মধ্যে হাইড্রোজেন অথবা অক্সিজেনের কোন গুণ বর্তমান থাকে না।
৩. বিভিন্ন পরমাণু পরস্পর রাসায়নিক বিক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে অনু গঠন করে। অনু রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় বিশ্লিষ্ট হয় কিন্তু পরমাণুকে এইভাবে বিশ্লিষ্ট করা যায় না।
[বিশেষভাবে মনে রাখা প্রয়োজন – বর্তমানে অনুকে ভেঙে ইলেকট্রন প্রোটন নিউট্রন প্রভৃতি আরো কয়েকটি সুক্ষ কনা পাওয়া গেছে।]
৪. একই মৌলিক পদার্থের পরমাণুগুলির ভার এবং ধর্ম একই। বিভিন্ন মৌলিক পদার্থের পরমাণুর ভর ও ধর্ম বিভিন্ন (ব্যতিক্রম আইসোটোপ মৌল)।
অনু কাকে বলে এবং কি
অনেকক্ষেত্রে মৌলিক পদার্থের পরমাণু গুলির একক অস্তিত্ব নেই। একই মৌলের দুই বা ততোধিক পরমাণুর জোটবদ্ধ হয়ে থেকোনা গঠন করে তাই হলো মৌলের অনু। খাদ্য লবণের একটি দানাকে ভেঙে সূক্ষ্ম করা হলো। ক্রমশই টুকরোগুলো সূক্ষ্ম হতে সূক্ষ্মতর হতে লাগলো। একসময় এক ক্ষুদ্রতম কণা পাওয়া যাবে, যার মধ্যে খাদ্য লবণের সমস্ত গুণ বর্তমান থাকবে। এই কণাটিকে ভাঙলে যেসব কনা পাওয়া যায় তার মধ্যে লবণের কোন গুণ বর্তমান থাকে না।
হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, ক্লোরিন প্রভৃতি মৌলের দুটি করে পরমাণু পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে মৌলটির একটি অনুর গঠন করে; ফলে H2, O2, Cl2 এর দ্বারা যথাক্রমে হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, ক্লোরিন এর একটি করে অনুকে বোঝায়। আবার তিনটে অক্সিজেন পরমাণু যুক্ত হয় একটি ওজন অনু গঠন করে। নিষ্ক্রিয় গ্যাস ও ধাতব মৌলের অনুতে মৌলের একটি মাত্র পরমাণু দ্বারা গঠিত হয়। H2, O2, Cl2, O3 প্রভৃতি অনুকে মৌলিক অনু বলে। যৌগের অণুতে উপাদান মৌল গুলির কোন ধর্ম বজায় থাকে না।
অনু কাকে বলে
স্বাধীন সত্তা বিশিষ্ট এবং নিজস্ব ভৌত, রাসায়নিক ধর্ম বিশিষ্ট মৌলিক বা যৌগিক পদার্থের সূক্ষ্মতম কণাকে অনু বলে।
অনু কত প্রকার
বিভিন্ন পরীক্ষা এবং ধর্ম পর্যালোচনা করে অনুকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা
১. মৌলিক অনু এবং
২. যৌগিক অণু
মৌলিক অনু কাকে বলে
মৌলিক অনুর সংজ্ঞা
কোন মৌলিক পদার্থের একাধিক পরমাণু পরস্পর যুক্ত হয়ে যে অনু গঠন করে, তাকে মৌলিক অনু বলে।
অর্থাৎ একই রকম পরমাণু দিয়ে গঠিত অনুকে মৌলিক অনু বলে। H2, O2, P4 প্রকৃতি হল যথাক্রমে হাইড্রোজেন, অক্সিজেন এবং ফসফরাস মৌলের অনু। এরা প্রত্যেকেই মৌলিক অনু।
যৌগিক অণু কাকে বলে
যৌগিক অণুর সংজ্ঞা
দুই বা ততোধিক বিভিন্ন মৌলের পরমাণু গুলির নির্দিষ্ট পূর্ণ সংখ্যার অনুপাতে পরস্পর যুক্ত হয়ে যে অনু গঠন করে, তাকে যৌগিক অণু বলে
অর্থাৎ দুই বা ততোধিক মৌলের পরমাণুর সমন্বয় উৎপন্ন অনুকে যৌগিক অণু বলে।
যেমন জলের একটি অণু গঠিত হয় দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু এবং একটি অক্সিজেন পরমাণু দ্বারা। ঠিক তেমনিভাবে কার্বন ডাই অক্সাইড হাইড্রোক্লোরিক এসিড প্রভৃতি যৌগ, যৌগিক অণু দ্বারা গঠিত। পৃথিবীর বেশিরভাগ পদার্থই যৌগিক পদার্থ। সমস্ত যৌগিক পদার্থ ও যৌগিক অণু দিয়ে গঠিত।
পারমানবিকতা কি
কোন মৌলের একটি অণু যতগুলো পরমাণুর সমন্বয়ে গঠিত হয় সেই সংখ্যাকে মৌলের পারমাণবিকতা বলে। যেমন আর্গন অনুর পারমানবিকতা হল এক; হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, ক্লোরিন প্রভৃতি মৌলের অনুর পারমানবিকতা হচ্ছে 2। ওজনের অনুর পারমানবিকতা 3 প্রভৃতি।
গ্রাম পরমাণু বা গ্রাম পারমাণবিক গুরুত্ব
রাসায়নিক বিক্রিয়ায় একটি পদার্থের কত পরিমাণের সঙ্গে অন্য একটি পদার্থের কত পরিমাণের বিক্রিয়ায় কত পরিমান পদার্থ উৎপন্ন হয় — এই হিসাব করার সময় অণু পরমাণুর সত্তিকারের ওজন নিয়ে হিসাব করা সম্ভব নয়। — কারণ অণু পরমাণুর সঠিক ওজন অত্যন্ত নগণ্য। সেই জন্য হিসাব করার সুবিধার জন্য পারমাণবিক ওজনকে গ্রাম হিসাবে ধরে কাজ করা হয়।
গ্রাম পারমাণবিক গুরুত্ব বা গ্রাম পরমাণুর সংজ্ঞা
কোন মৌলের পারমাণবিক গুরুত্বকে গ্রামে প্রকাশ করলে তাকে মৌলটির গ্রাম পারমাণবিক গুরুত্ব বা 1 গ্রাম পরমাণুর বলে।
যেমন অক্সিজেনের পারমাণবিক গুরুত্ব 16। সুতরাং অক্সিজেনের গ্রাম পারমাণবিক গুরুত্ব 16 গ্রাম। অতএব 1 গ্রাম পরমাণু অক্সিজেন বলতে আমরা 16 গ্রাম অক্সিজেনকে বুঝে থাকি। আবার দুই গ্রাম পরমাণু অক্সিজেন বলতে 32 গ্রাম অক্সিজেনকে বোঝায়। দু গ্রাম পরমাণু নাইট্রোজেন বলতে 28 গ্রাম নাইট্রোজেনকে বোঝায়। তিন গ্রাম পরমাণু হাইড্রোজেন বলতে তিন গ্রাম হাইড্রোজেন বোঝায়।
গ্রাম আণবিক গুরুত্ব বা 1 গ্রাম অনু বা 1 গ্রাম মোল
কোন পদার্থের আণবিক গুরুত্বকে গ্রামে প্রকাশ করলে তাকে পদার্থটির গ্রাম আণবিক গুরুত্ব বা 1 গ্রাম অনু বা এক গ্রাম মোল বলে।
যেমন অক্সিজেনের আণবিক গুরুত্ব 32; সুতরাং অক্সিজেন এর গ্রাম আণবিক গুরুত্ব বা 1 গ্রাম অনু অক্সিজেন বা 1 মোল অক্সিজেন বলতে আমরা 32 গ্রাম অক্সিজেনকে বুঝি।
আবার জলের H2O আণবিক গুরুত্ব
= 1×2+16=18 অর্থাৎ জলের গ্রাম আণবিক গুরুত্ব 18 গ্রাম
CO2 এর আণবিক গুরুত্ব 44
এখন 1 গ্রাম অনু CO2 = 44 গ্রাম CO2
2 গ্রাম অনু CO2 = 88 গ্রাম CO2
3 গ্রাম অনু CO2 = 132 গ্রাম CO2
0.5 গ্রাম অনু CO2 = 22 গ্রাম CO2
গ্রাম আণবিক আয়তন বা মোলার আয়তন
গ্রাম আণবিক আয়তন বা মোলার আয়তনের সংজ্ঞা
কোন নির্দিষ্ট চাপ এবং উষ্ণতায় 1 গ্রাম অনু পরিমাণ কোন গ্যাসের আয়তন কে গ্রাম আণবিক আয়তন বা মোলার আয়তন বলে।
হঠাৎ নির্দিষ্ট উষ্ণতা ও চাপে 1 গ্রাম অনু পরিমাণ কোন গ্যাস যে আয়তন অধিকার করে তাকে ওই গ্যাসটির গ্রাম আণবিক আয়তন বা মোলার আয়তন বলা হয়ে থাকে। প্রমাণ উষ্ণতা ও চাপে যে কোন গ্যাসের গ্রাম আণবিক আয়তন বা মোলার আয়তন 22.4 লিটার হয়।
উদাহরণ স্বরূপ অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, অ্যামোনিয়া, কার্বন ডাই অক্সাইডের গ্রাম আণবিক ওজন যথাক্রমে 32, 28, 17 এবং 44 গ্রাম। প্রমাণ চাপ ও উষ্ণতা 32 গ্রাম O2, বা 28 গ্রাম N2 কিংবা 17 গ্রাম NH3 বা 44 গ্রাম CO2 এর আয়তন 22.4 লিটার হয়। NTP তে 2 গ্রাম অনু গ্যাসের আয়তন 2× 22.4 লিটার হবে।
গ্রাম আণবিক ওজন এবং গ্রাম আণবিক আয়তনের ব্যবহারিক প্রয়োগ
রাসায়নিক সমীকরণের সাহায্যে ওজন সংক্রান্ত গণনা
কোন রাসায়নিক বিক্রিয়ায় কি পরিমান বিক্রিয়াকারী পদার্থের প্রয়োজন হয়েছে এবং বিক্রিয়াটি থেকে কি পরিমান বিক্রিয়াজাত পদার্থ পাওয়া গিয়েছে তা রাসায়নিক সমীকরণ থেকে জানা যায়। অর্থাৎ সহজ ভাষায় বলা যেতে পারে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় একটি পদার্থের কত পরিমান ওজনের সঙ্গে অন্য পদার্থটির কত পরিমান ওজন বিক্রিয়া করে সঠিক কত ওজনের পদার্থ উৎপন্ন করবে নির্ণয় করা যায়।
যেমন চুনাপাথরকে CaCO3 উত্তপ্ত করলে পোড়া চুন বা ক্যালসিয়াম অক্সাইড CaO এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড CO2 পাওয়া যায়
এখানে ক্যালসিয়াম Ca কার্বন C এবং অক্সিজেন O এর পারমাণবিক গুরুত্ব যথাক্রমে 40, 12 এবং 16।
অতএব, CaCO3 এর আণবিক গুরুত্ব = (40+12+3×16) = 100
CaO এর আণবিক গুরুত্ব = (40+16) = 56 এবং
CO2 এর আণবিক গুরুত্ব = (12+2×16) = 44
অর্থাৎ, CaCO3 (100 গ্রাম) = CaO (56 গ্রাম) + CO2 (44 গ্রাম)
অতএব, রাসায়নিক সমীকরণটি থেকে বলা যায় 100 গ্রাম ক্যালসিয়াম কার্বনেট কেতাবে বিরোধিতা করলে 56 গ্রাম ক্যালসিয়াম অক্সাইড এবং 44 গ্রাম কার্বন-ডাই-অক্সাইড পাওয়া যায়।
রাসায়নিক সমীকরণের সাহায্যে আয়তন সংক্রান্ত গণনা
কোন রাসায়নিক বিক্রিয়ায় যদি গ্যাসীয় পদার্থ উৎপন্ন হয় তাহলে এন টি পি তে কত আয়তনের গ্যাস পাওয়া যাবে জানা যায়। আবার এনটিপিতে কোন আয়তন গ্যাসের ওজন জানা থাকলে, তার থেকে গ্যাসটির আণবিক গুরুত্ব জানা যায় । যেমন
উপযুক্ত শর্তে নাইট্রোজেন এবং হাইড্রোজেন বিক্রিয়া করে অ্যামোনিয়াম উৎপন্ন করে।
এই বিক্রিয়াটির সমীকরণ N2 (1 গ্রাম অনু) + 3H2 (3 গ্রাম অনু) = 2NH3 (দুই গ্রাম অনু)
বিক্রিয়াটিতে 1 গ্রাম অনু বা এন টি পি তে 22.4 লিটার নাইট্রোজেন যথাক্রমে 3 গ্রাম অনু বা এনটিপিতে 67.2 লিটার হাইড্রোজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে 2 গ্রাম অনু বা এনটিপিতে 44.8 অ্যামোনিয়া উৎপন্ন করে।
অতএব বলা যায় এনটিপিতে 22.4 লিটার নাইট্রোজেন 67.2 লিটার হাইড্রোজেন এর সঙ্গে বিক্রিয়া করে 44.8 লিটার এমোনিয়া উৎপন্ন করে।
N2 (22.4 লিটার) + 3H2 (67.2 লিটার) = 2NH3 (44.8 লিটার)
মোলার আয়তন সম্পর্কিত প্রশ্নোত্তর
Cl, 2Cl, Cl2, 3Cl2 বলতে কী বোঝায়
Cl এবং 2Cl বলতে যথাক্রমে একটি এবং দুটি ক্লোরিন পরমাণুকে বোঝায়; আবার কোনদিন এর পারমাণবিক গুরুত্ব 35.5। সুতরাং Cl এবং 2Cl দ্বারা যথাক্রমে 35.5 গ্রাম এবং 71 গ্রাম ক্লোরিনকে বোঝায়।
অন্যদিকে, Cl2 এবং 3Cl2 সংকেত থেকে যথাক্রমে ক্লোরিনের একটি ও তিনটি অনুকে বোঝায়। ক্লোরিনের আণবিক ওজন (2×35.5) 71। সুতরাং Cl2 এবং 3Cl2 যথাক্রমে 71 গ্রাম এবং (3×35.5) বা 213 গ্রাম ক্লোরিনকে প্রকাশ করে।
অ্যামোনিয়াম ফসফেটের একটি অণুতে কয়টি পরমাণু আছে
অ্যামোনিয়াম ফসফেটের সংকেত হলো (NH4)3PO4
অতএব, অ্যামোনিয়াম ফসফেট যৌগের অণুতে পরমাণু সংখ্যা = 3(1+4)+1+(4×1) = 20