সনাতন সংস্কৃতির অন্যতম পবিত্র উৎসব মকর সংক্রান্তি উৎসব। সমগ্র ভারত যখন উত্তুরে হাওয়ার তীব্র প্রভাবে জবুথবু হয়ে অলস দিন কাটায়, তখন শীত বিদায়ের বার্তা নিয়ে প্রকৃতিতে নতুন প্রাণ স্পন্দন সঞ্চার করে ভারতীয় জীবনে আসে মকর সংক্রান্তি।
বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে মকর সংক্রান্তি
ভারতবর্ষ শুধুমাত্র আধ্যাত্মিকতার দেশ নয়, ভারতবর্ষ বিজ্ঞানের দেশও বটে। টাইকোব্রাহে, গ্যালিলিও, কেপলার, নিউটনেরও বহু পূর্বে, হাজার হাজার বছর আগেও বিজ্ঞান চেতনা সম্পন্ন ভারতীয় ঋষি-মুনিরা গ্রহ-নক্ষত্রের সঞ্চারপথ সম্পর্কে বিশদভাবে জানতেন। তাঁরা জানতেন যে সূর্য স্থির, আর তাকে কেন্দ্র করে পৃথিবী নিরন্তর ভ্রমণ করে চলেছে। তাঁরা এই ভ্রমণকালকে ১২টি রাশিতে ভাগ করে প্রতিটি রাশির একটি করে নামকরণ করেন। আজকের দিনে সুর্যের মকর সংক্রমণ ঘটে, অর্থাৎ রবি ধনু থেকে মকর রাশিতে প্রবেশ করে। যে সূর্য এতদিন মকর ক্রান্তি রেখার ওপর লম্ব ভাবে কিরণ দিচ্ছিল, দক্ষিণায়ন শেষ হয়ে এবার তার উত্তরায়ন শুরু হয়। উত্তর গােলার্ধ থেকে ক্রমশ সুর্যের কাছে আসতে থাকে। অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এই উত্তরায়ণের দিন থেকে শুরু হয় প্রকৃত বড়াে দিনের। রাত্রির পরিমাণ কমে যায়। বেড়ে যায় দিনের সময় সূর্যের আলােতে আরও কিছু বেশিক্ষণ দৃশ্যমান থাকে এই চরাচর। প্রাকৃতিক অবস্থাই মানুষকে করে রাখে কর্মচঞ্চল। আলােক, উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়। অন্ধকার, শৈথিল্য, জড়তা মুক্ত হয়ে জীবকুল নবআনন্দে জেগে ওঠে।
পৌরাণিক যুক্তিতে মকর সংক্রান্তি
ভারতীয় সমাজ চিরকালই আলােকরূপী সত্য, জ্ঞান, অমৃতের উপাসক। সেই কোনকালে ভারতীয় ঋষিগণ উদাত্ত কণ্ঠে বলে গিয়েছেন— ‘অসতাে মা সদগময়, তমশঃ মা জ্যোতিঃর্গময়’, অর্থাৎ অসত্য থেকে সত্যের পথে, অন্ধকার থেকে আলাের পথে নিয়ে চল। তাই সৌরবছর নিয়ন্ত্রিত পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি, শুধুমাত্র বিজ্ঞান নয়, আধ্যাত্মিকতার দিক থেকেও অতি গুরুত্বপূর্ণ দিনটি। নানা কারণেই পৌষ সংক্রান্তি হিন্দুর জীবনের এক অতি স্মরণীয় পুণ্যক্ষণ।
পুরাণ কথা, সংক্রান্তি হলেন দেবী মহামায়ারই এক শক্তির প্রকাশ। এই দিনেই বিনাশ করেছিলেন তিনি শঙ্করাসুর নামে এক দানবকে। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ধর্মকে। অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করে ফিরিয়ে এনেছিলেন শান্তি ও নীতিবােধকে। তাই পৌষসংক্রান্তিতে দেবীর আরাধনা হয়।
বাংলা বর্ষপঞ্জির নবম মাস পৌষ। এই সংক্রান্তিতে সূর্য ধনু রাশি থেকে মকরে সঞ্চারিত হয়, তাই এর নাম ‘মকর সংক্রান্তি। একে ‘উত্তরায়ণ সংক্রান্তি’ও বলে। কারণ এই দিন থেকে সূর্য উত্তরা়ণের দিকে যাত্রা শুরু করে। এই সংক্রান্তিতে ব্রাহ্ম-মুহূর্তে যমুনা নদীতে মকর-স্নান করলে আয়ুবৃদ্ধি হবে— এই বিশ্বাসে মাতা যশােমতী বালক কৃষ্ণকে স্নান করাতে নিয়ে যান। পরে এদিনেই যমুনায় স্নান সেরে শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমতী রাধিকার সঙ্গে ‘মকর-পাতায়’, এ হলাে আত্মার সঙ্গে আত্মার দৃঢ় বন্ধন স্থাপন। বাংলার অনেক স্থানে একসময় কুমারী মেয়েরা এইদিন থেকে কনকনে ঠাণ্ডার ভােরে একমাস ব্যাপী মকরস্নান- ব্রত শুরুঃ করতাে। আলস্য, নিদ্রা, তন্দ্রা জড়তা-তামসিকতার রিপুগুলিকে জয় করার এ হলাে সংগ্রামী মনােবৃত্তি। ছড়া গেয়ে পাঁচ ডুব দেওয়ার নিয়ম ছিল : “এক ডুবিতে আই-ঢাই।/দুই ডুবিতে তারা পাই।/তিন ডুবিতে মকরের স্নান।/চার ডুবিতে সূর্যের স্নান। পাঁচ ড়বিতে গঙ্গাম্নান।
মহাভারতে থেকে জানা যায়, অগ্রহায়ণের শেষে কুরুক্ষেত্র রণভূমে পিতামহ ভীস্মের পতন হয় অর্জুনের শরাঘাতে। স্বেচ্ছায় মৃত্যুর বরপ্রাপ্ত ভীম্ম দক্ষিণায়নের সময়কালে দেহত্যাগ করতে চাইলেন না। তাই শরশয্যায় শায়িত থেকে তিনি প্রতীক্ষা করতে থাকেন উত্তরায়ণের পুণ্যক্ষণের জন্য। পৌষ শেষ মাঘ মাসের সূচনাতেই উত্তরায়ণ কালে দেহত্যাগ করলেন ভীম্ম। পতন হলাে এক মহীরুহের, একইসঙ্গে এক পুণ্যমাহাত্ম্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠল মাঘের সূচনাকালটি। সেইসঙ্গে ঘােষিত হলাে উত্তরায়ণের পুণ্যমাহাত্যের কথা। সে কারণের পৌষ-সংক্রান্তির অবসানে মাঘের প্রথম শুভা যাত্রাক্ষণে পুণ্যস্নান করে মানুষ কুড়িয়ে নেয় তার শেষ জীবনর পারানি পরম বিশ্বাসে।
রবির মকর রাশিতে সঞ্চার, উত্তরায়ণ থেকে দেবতাদের জাগরণ, পুণ্যাত্মা ভীস্মের দেহাবসান ইত্যাদি নানা পুণ্য মূহূর্তের সমাচার হলাে পৌষ-সংক্রান্তি তথা মাঘের প্রথম দিনটি।
মকর সংক্রান্তিতে গঙ্গা স্নানের পটভূমি
দিনটি বিশেষ বার্তাবহ হয়ে রয়েছে আরও একটি বিশেষ কারণেও। পৌরাণিক মতে আজকের দিনেই ভগীরথের তপস্যায় তুষ্ট মা গঙ্গা স্বর্গ থকে মর্ত্যে অবতরণ করে সগররাজের ভস্মীভূত ষাট হাজার পুত্রকে পবিত্র গঙ্গাস্পর্শে অভিশাপ মুক্ত করেন এবং গঙ্গাসাগরে মিলিত হন। এই দিনই পতিতপাবনি গঙ্গার পুণ্যবারি স্পর্শে প্রাণ ফিরে পান রাজা সগরের যাট হাজার সন্তান।
পুরাণ কথা অনুসারে, রাজা সাগর করেছিলেন অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়ােজন। তাঁর ক্ষমতা বৃদ্ধির আতঙ্ক দেবরাজ ইন্দ্র হরণ করেন যজ্ঞাশ্বটি। রেখে আসেন সেটি পাতালে মহর্ষি কপিলের আশ্রমে। রাজা সগরের যাট হাজার সন্তান খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে অশ্বটি দেখতে পায় কপিল মুনির আশ্রমে। মদমত্ত রাজপুত্ররা কোনােকিছু বিচার না করেই অশ্ব অপহারকভেবে মুনির ধ্যান ভাঙায়। ধ্যান ভাঙানােয় ক্রদ্ধ হন কপিল মুনি। তাকান তিনি রােষ কষায়িত নেত্রে। সঙ্গে সঙ্গে ভস্ম হয়ে যায় সগরের যাট হাজার সন্তান।
সময় বয়ে যায়। আসে না ছেলেরা যজ্ঞাশ্ব নিয়ে। উদ্বিগ্ন রাজা সগর এবার নাতি অংশুমানকে পাঠান সকলের খোঁজে। খুঁজতে খুঁজতে কপিলমুনির আশ্রমে আসে অংশুমান। দেখতে পায় যজ্ঞাশ্ব এবং ধ্যানমগ্ন কপিল মুনিকে। নানা স্তবস্তুতিতে ধ্যান ভাঙান তিনি মুনির। জানতে পারেন তাঁর পিতৃপুরুষদের পরিণামের কথা।
অংশুমানের স্তুতি ও কান্নায় বিগলিত কপিল বলেন, স্বর্গ থেকে গঙ্গাকে আনতে পারলে সেই পৃণ্যবারির স্পশেই জীবন ফিরে পাবেন সগর-পুত্রা। মুনিকে প্রণাম করে ফিরে আসে অংশুমান। রাজা সাগর শেষ করেন যজ্ঞ। অংশুমান শুরু করেন তপস্যা মর্ত্যে গঙ্গাদেবীকে অবতরণের জন্য।
সফল হলেন না তিনি। ব্যর্থ হলেন তাঁর ছেলে দিলীপও। অবশেষে দিলীপের ছেলে ভগীরথের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে গঙ্গা নেমে এলেন মর্ত্যে। পৌষ সংক্রান্তির দিন গঙ্গা এসে মিলিত হলেন সাগরে কপিলমুনির আশ্রমের কাছে গঙ্গাধারায় শাপমুক্ত হলেন সগরপুত্ররা। তারপর থেকেই সাগরসঙ্গমে পৌষসংক্রান্তির স্নান ধর্মপ্রাণ হিন্দুর কাছে হয়ে দাঁড়াল এক পুণ্য অনুষ্ঠান। আজও গঙ্গাসাগরে সারা ভারতের লক্ষ লক্ষ মানুষ এসে স্নান করেন। পুজো দেন কপিল মুনির মন্দিরে। আর ওই উপলক্ষে সাগরদ্বীপে বসে এক বিরাট মেলা।
মকর সংক্রান্তিতে গঙ্গাসাগরে স্নানের মাহাত্ব
তাই স্নান মাহাত্যের দিক থেকেও দিনটি অতি পবিত্র। সারা বিশ্ব থেকে কোটি কোটি নর-নারী তীর শীত উপেক্ষা করে পুণ্যম্নানের আশায় গঙ্গাসাগরে আসেন। আসেন পুণ্য কুম্ভ স্নানে। বহু ভাষাভাষী, খাদ্য, বস্ত্র বিবিধতায় ভরপুর ভারতীয় সমাজে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য গড়ে ওঠে। এই উৎসবের মধ্যে দিয়েই সমগ্র বিশ্ব সনাতন ভারতবর্ষকে প্রত্যক্ষ করে থাকে। শুধুমাত্র পুণ্য কুম্ভ বা গঙ্গাসাগরে নয়, এই দিনে ভারতবর্ষর প্রায় সমগ্র অংশেই ভিন্ন ভিন্ন নামে এই উৎসব পালিত হয়।
মকর সংক্রান্তিতে গঙ্গা স্নানের ইতিহাস
গঙ্গাসাগর জনসমক্ষে এল কবে? সহত্রাধিক বছরের তীর্থক্ষেত্রটির সূত্রপাতের সঠিক ক্ষণ অজানা। ভারতের সহত্রাধিক তীর্থক্ষেত্রের মধ্যে একমাত্র গঙ্গাসাগর তীর্থক্ষেত্রটি মূল ভুখণ্ডের বাইরে।
পৌষ সংক্রান্তির দিন সাগরসঙ্গমে স্নান করলে মুক্তি লাভ হয়। এই বিশ্বাস থেকে পৌষ সংক্রান্তির দিন দেশ-বিদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রী অনেক কষ্ট স্বীকার করে গঙ্গাসাগরে আসেন স্নান করতে।
কেউ কেউ বলেন ওয়েলেসলির (১৭৯৮-১৮০৫) শাসনকালে জীবন্ত ২৩টি শিশুকে জলে বিসর্জন দেওয়ার ঘটনা থেকে গঙ্গাসাগর জনসমক্ষে আসে।
মনে হয় এরকম কোনও একটি ঘটনার পর তীর্থস্থানটি সুষ্টু ভাবে পরিচালনার দাবি ওঠে। এই দাবি রূপায়ণে এগিয়ে আসেন সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ সুধী জনেরা। গঠিত হয় ‘সাগর আইল্যান্ড সােসাইটি’। তারপর মেলা পরিচালনার ভার নেয় জেলা ইউনিয়ন বাের্ড। সময়ের দাবি মেনে ১৯৬৪ সালে রাজ্য সরকার সরাসরি তীর্থক্ষেত্রটি পরিচালনার ভার গ্রহণ করে। প্রাচীন এই তীর্থক্ষেত্রটি জাতীয় মেলার তালিকা ভৃক্ত হওয়া উচিত বলে মনে করেন অনেকে। ইউনিয়ন বাের্ডের সময় তীর্থযাত্রীদের মাথাপিছু দু’ আনা কর দিতে হতাে। পরে তা বেড়ে হয় চার আনা। রাজ্য সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর কর ধার্য হয় দু’ টাকা পরে তা বেড়ে হয় পাঁচ টাকা। এই কর আদায়ে বিস্তর অভিযােগ ছিল। অবশেষে রাজ্য সরকার তীর্থ কর প্রত্যাহার করে।
প্রশাসনিক অসুবিধা দেখা দেওয়ায় ১৯৩৭ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রথম বছর গঙ্গাসাগরে স্নান পর্ব বন্ধ ছিল।
গঙ্গাসাগর জনসমক্ষে আসার সময় থেকে তীর্থযাত্রীদের সাহায্য ও সহযােগিতায় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি বলিষ্ঠ ভুমিকা পালন করছে। বর্তমানে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সংখ্যা শতাধিক। সময় হয়েছে অংশগ্রহণকারী সংস্থাগুলির কাজের একটি জরুরি মূল্যায়নের।
কিভাবে যাবেন গঙ্গাসাগরে
সড়ক পথে অথবা ট্রেনে মূল ভূখণড পর্যন্ত এসে, তার পর মুড়ি গঙ্গা অথবা হাতানিয়া-দোয়ানিয়া যে কোনও একটি নদী পার হয়ে গঙ্গাসাগরে পাঁছতে হয়।
সড়ক পথের যে যাত্রীরা মুড়িগঙ্গা পার হবেন, তাদের লট-৮ ফেরিঘাটে আসতে হবে, সেখান থেকে নদী পার হয়ে কচুবেড়িয়া, ওখান থেকে সঙ্গমস্থলে। শিয়ালদহ-নামখানা ট্রেনের যাত্রীদের কাকদ্বীপ স্টেশনে নামতে হবে, স্টেশন থেকেলট-৮। তারপর নদী পার হয়ে কচুবেড়িয়া হয়ে স্নান ঘাটে।
যারা হাতানিয়া-দোয়ানিয়া নদী পার হয়ে যেতে চান, সেই সড়ক এবং ট্রেন যাত্রীদের সরাসরি নামখানা যেতে হবে। এখান থেকে নদী পার হয়ে, বেণুবন অথবা চেমাগুড়ি, সেখান থেকে কপিলমুনির মন্দির।
একসময় গঙ্গাসাগর যাওয়ার প্রধান দুয়ার ছিল নামখানা। যাত্রীদের চাপ কমাতে বিকল্প পথের ভাবনা শুরু হয়। ওই ভাবনায় ফসল মুড়িগঙ্গার মূল ভুখণ্ডের তীরে লট-৮ ওপারে কচুবেড়িয়া ফেরিঘাট তৈরি হয়। ১৯৯৪ সালে চেমাগুড়ির কাছে অভয়া লঞ্চ শতাধিক যাত্রীসমেত ডুবে যায়। তারপর থেকে গঙ্গাসাগর যাওয়ার ভারকেন্দ্র লট – ৮ ফেরিঘাট।
আগে গঙ্গাসাগর মেলা শুরুর সময় আলােকিত হতাে কেরােসিনের লগ্ঠনে, তারপর এল হ্যাজাক, এরপর জেনারেটর। সত্তর দশকে রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদ রুদ্রনগরে বিদ্যুতের পাওয়ার স্টেশন গড়ে তােলে। সময়ের দাবি মেনে ২০০৯ সালে মুড়িগঙ্গা নদীর ওপর দিয়ে তার টেনে গঙ্গাসাগরের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার কাজ শুরু হয়, সমাপ্তি ঘটে ২০১১ সালে।
একসময়ের দুর্গমতম গঙ্গাসাগরের সঙ্গে এখনকার গঙ্গাসাগরকে কোনও দিক থেকেই মেলানাে যাবে না। একটু একটু করে তীর্থক্ষেত্রে যাতায়াতের জন্য তৈরি হয়েছে পাকা রাস্তা, ব্যবস্থা করা হয়েছে পানীয় জল। বিদ্যুৎ, চিকিৎসা ও পরিবহণ। আগুন প্রতিহত করতে রাখা হচ্ছে দমকলের গাডি। উন্নত করা হয়েছে যােগাযােগের ব্যবস্থাও, শক্তপােক্ত করা হয়েছে বাঁশের বেড়া, ওয়াচ টাওয়ার এবং ড্রপ গেট সহ বিভিন্ন দিক। এত সবের পরও অভিজ্ঞজনদের অভিমত, রাজ্যবাসীদের সঙ্গে আগত তীর্থযাত্রীদের বন্ধুত্ব গড়ে উঠছে না। তাই সমস্ত অহংকার ভুলে সারা দেশ থেকে আগত তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে আত্মীয়তা গড়ে তােলার পদক্ষেপ নেওয়াটাই সময়ের দাবি।
মকর সংক্রান্তির বিভিন্ন নাম
পৌষ মাসের শেষ দিন বলে বাঙ্গলায় পৌষ সংক্রান্তি, অসমে ভােগালি বিহু, বিহার উত্তরপ্রদেশে খিচুড়ি, পঞ্জাব-হরিয়ানায় লােরী, কাশ্মীরে সাঁকরাত, গুজরাটে উত্তরায়ণ, কর্ণাটকে মকর সংক্রমণ, ওড়িশা, মহারাষ্ট্র, ন্ধ্প্রদশে, কেরলে মকর সংক্রান্তি,
তামিলনাডুতে পোঙ্গল ইত্যাদি বিভিন্ন নাম এই উৎসব পালিত হয়। শুধুমাত্র এদেশেই নয়, বিদেশেও এই উৎসব পরম শ্রদ্ধা ও উৎসাহের সঙ্গে পালিত হয়। নেপালে মাঘী, থাইল্যান্ডে সংক্রান, লাওসে পি-মা-লাও, মিয়ানমারে থিং-ইয়াল এবং কম্বোডিয়ায় মহাসংক্রান নামে পালিত হয়। পুরাণ মতে এই দিনেই দেবাসুরের যুদ্ধ সমাপ্ত হয়ে শুভা শক্তির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। শাস্ত্রমতে দক্ষিণায়নের ছ’ মাস তাঁরা জাগ্রত থাকেন। সুতরাং উত্তরায়ণের শুভ সূচনায় নিদ্রোত্থিত দেবতাদের বন্দনায় মুখরিত হয় মানব সমাজ।
আধ্যাত্মিকতা ও মকর সংক্রান্তি
চতুর্দিকে বেজে ওঠে শঙ্খ ঘন্টা শুরু হয় হোম, যজ্ঞ, পূজা, গীতা পাঠ, কীর্তন, তর্পণ দান। শাস্ত্র অনুযায়ী মকর সংক্রান্তির দিন যজ্ঞের আহুতি গ্রহণের জন্য দেবতারা মর্ত্যে নেমে আসেন। আবার এই পথেই পুণ্যাত্মারা শরীর ত্যাগ করে স্বর্গলোকে প্রবেশ করেন। তাই মহাভারতে আমরা দেখি দক্ষিণায়ন কালে আটান্নদিন শরসজ্জায় শায়িত পিতামহ ভীম্ম এই বিশেষ দিনটিতেই স্বেচ্ছামৃত্য বরণ করেন।
শুধু বঙ্গদেশে নয়, সারা ভারতবর্ষেই পৌষান্তে মাঘের ঘরে পা দেওয়ার মুহূর্তটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ভারতীয় হিন্দু জনমনে মাঘের প্রথম উষা নিয়ে আসে মুক্তি আর আনন্দের বার্তা। তাই মানবজীবনে এই সময়টি বড়ই পুণ্যময়। সেই পুণ্য মুহূর্তে তাই মানুষ ছুটে যায় গঙ্গা-যমুনা- গােদাবরী-কৃষ্ণা-কাবেরী-নর্মদার মতাে পুণ্যতােয়ায় অবগাহনশেষে বিশেষ পূজা অর্চনা, শ্রাদ্ধ-তর্পণের মাধ্যমে অপার তৃপ্তি লাভের জন্য। পৌষের বিদায় ক্ষণটি অন্ধকার থেকে আলােয় প্রবেশের মতােই মহা আনন্দে উদ্ভাসিত। সত্য-সুন্দর অনন্তের জ্যোতিতে পরিপূর্ণ হওয়ার, এক দিব্য আনন্দে ভেসে যাওয়ার বার্তাই দিয়ে যায় পৌষ সংক্রান্তির হিমেল রাত তার যাওয়ার বেলায়।
মকর সংক্রান্তি আসলে সূর্যের উদ্দেশ্য নিবেদিত
হিন্দুর প্রায় সমস্ত পুজা অনুষ্ঠানই হয় চান্দ্রমাসের গণনা অনুযায়ী। সে কারণেই তিথি ভিত্তিক এইসব উৎসবের ঠিক নির্দিষ্ট কোনো দিন নেই। এক্ষেত্রে অল্প যে কটি ব্যতিক্রম রয়েছে তার একটি এই মকর সংক্রান্তি। এটি সৌরবৎসরের গণনা অনুযায়ী পালিত হয়। তাই দিনটি মােটামুটি প্রতি বছরই পড়ে ইংরাজির ১৪ জানুয়ারি। একটি ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে দিনটি পড়ে ১৫ জানুয়ারি। মকর সংক্রান্তি রবির মকর রাশিতে সঞ্চারণ উপলক্ষে সৌরবর্ষ গণনা রীতিতে পালিত হওয়ার কারণে এটি একটি সৌর অনুষ্ঠানও বটে। এদিনটি সূর্যের উদ্দেশ্য নিবেদিত। পূজাও করা হয় সূর্যদেবতার। প্রতি বারাে বছর অন্তর মকর সংক্রান্তির দিনটি বিশেষ তাৎপর্যের সঙ্গে পালিত হয়। বসে মহাকুম্ভের মেলা। ওইদিন প্রায় ৪০ লক্ষ পুণ্যার্থী কুম্ভমেলায় স্নান করেন। এটি বিশ্বের বৃহত্তম। মেলা হিসেবে পরিচিত। বলা হয় আদি শঙ্করাচার্য এই কুস্তমেলার প্রচলন করেন।
মকর সংক্রান্তি হল কৃষকের উতছাস
দীপ জেলে যায়। পৌষের বিদায় ক্ষণিকে বর্ণনা করা যায় এভাবেই। সাধারণ বিশেষ করে দেশের কৃষক সমাজকে নানা ভাবে আনন্দের উপকরণ জোগায় এই মাসটি। সারা দেশেই এই মাসটি হয়ে যায় আনন্দের মাস, সৌভাগ্যের মাস। আর তাই যাওয়ার বেলায়ও রাঙিয়ে দিয়ে যায় মানুষের মন। জ্বালিয়ে যায় আশার প্রদীপ। উদ্বুদ্ধ করে নতুন কাজে— নতুন উৎসাহে।
ঘরে ঘরে ওঠে তখন নতুন ফসল। আমন ধানে ভরে ওঠে গােলা। কয়েকমাসের অন্তহীন পরিশ্রম আর দুশ্চিন্তার অবসানে কৃষকসমাজ প্রাপ্তির উজ্জ্বল স্পর্শে জেগে ওঠে নবআনন্দে। সেই আনন্দেরই প্রকাশ মকরসংক্রান্তির স্নান শেষে নতুন ধানের নবান্ন। পিঠে-পুলি-পায়েসের সুবাসে ভরে ওঠে চারিদিক। নতুন ধান-কোটা চলে আর নলেন গুড়ে তৈরি ওইসব উপকরণ নিবেদন করে সকলে গৃহদেবতা,বাস্তুদেবতা, গণদেবতার উদ্দেশ্যে। তারপর সেইসব দিয়েই রসনাতৃপ্তি আর আনন্দ-প্রমােদে মেতে ওঠা। পূজা-উৎসব, ক্রীড়া ও নানা আমােদে সুস্থ জীবনের শক্তি সংগ্রহ আর নব উদ্দীপনায় ভবিষ্যৎ হয় পৌষমাসের ওই সন্ধিক্ষণে।
স্থানভেদে মকর সংক্রান্তির বিভিন্ন নাম
মকর সংক্রান্তি পালিত হয় সারা ভারতবর্ষেই। পঞ্জাব ও উত্তর ভারতের কিছু জায়গায় এই দিনের উৎসবের নাম মাগী, তামিলনাড়ুতে পােঙ্গল, অন্ধ্রপ্রদেশে পেডা পাণ্ডুগা, মহারাষ্ট্র কর্ণটকে মকর সংক্রান্তি, অসমে মাঘ-বিহু, গুজরাটে উত্তরায়ণ, উত্তরপ্রদেশে ও পশ্চিম বিহারে খিচড়ি মিথিলায় তিল সাকরাইত নামে পরিচিত।।
এছাড়া নেপালে এর নাম মাঘে সংক্রান্তি বা মাঘী খিচড়ি সংক্রান্তি, বাংলাদেশে শকরাইন বা পৌষ সংক্রান্তি মালয়শিয়া এবং শ্রীলঙ্কায় থাই পােঙ্গল নামে পরিচিত।
উৎসবের তিথি পৌষ সংক্রান্তি
পৌষ তথা মকর সংক্রান্তির দিনটি পালিত হয় সারা ভারতবর্ষেই। বঙ্গদেশে এই দিনটি হলাে পিঠেপুলির উৎসব পৌষ পার্বণ। বাড়িতে বাড়িতে পালিত হয় দিনটি গৃহদেবতার নবান্ন উৎসব বাস্তুপূজার দিন হিসেবে। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গেও বহু বাড়িতে দিনটি পালিত হয় একই ভাবে। পৌষ সংক্রান্তির দিনবিশেষ করে গ্রামবাঙ্গলায় হয় লক্ষী পুজা কোথাও কোথাও এই পূজা হয় পয়লা মাঘে। পুজায় অন্যান্য দ্রব্যের সঙ্গে দেওয়া হয় নতুন ধানের চালের গুড়াে ও নলেন গুড়, পাটালি দিয়ে তৈরি নানারকম পিঠে পায়েস।
মকর সংক্রান্তির অপর একটি নাম তিল সংক্রান্তি। এই দিনে তিল দিয়ে তৈরি করা নাডু, মিষ্টি, ফল ইত্যাদি পূজার নৈবেদ্য হিসেবে নিবেদন করা হয়। এছাড়াও নতুন ফসল ওঠার আনন্দে নানা জাতের পিঠা, পায়েস ইত্যাদির আয়ােজন করে দিনটি আরও আনন্দায়ক করে তােলা হয়।