লোহা বা আয়রন ব্যবহার, ধর্ম, প্রতীক, যোজ্যতা, মরিচা

0
787

সমগ্র পৃথিবীতে বিভিন্ন স্থানে লোহা ঘটিত আকরিক পাওয়া যায়। একমাত্র উল্কাপিণ্ড ছাড়া পৃথিবীতে মুক্ত অবস্থায় আয়রন পাওয়া যায় না। ওজনের হিসাবে পৃথিবীতে অ্যালুমিনিয়ামের পরেই লোহার স্থান। ভূত্বকে লোহার পরিমাণ 4.12%।
গাছের পাতা সবুজ অংশের মধ্যে এবং প্রাণীর রক্তে আয়রন বর্তমান থাকে। অক্সাইড, কার্বনেট এবং জলযুক্ত অক্সাইড আকরিক থেকে নিষ্কাশন করা হয়।

লোহার প্রধান খনিজ বা আকরিক

লোহার প্রধান খনিজ আকরিক গুলি হল রেড হিমাটাইট, ব্রাউন হেমাটাইট বা লিমোনাইট, ম্যাগনেটাইট, সিডারাইট ইত্যাদি।

আয়রনের প্রধান খনিজ বা আকরিক

যৌগখনিজ পদার্থের নাম
সালফাইডআয়রন পাইরাইটিস Fes2
কার্বনেটসিডারাইট FeCO3
স্পাথিক লৌহ আকরিক FeCO3
অক্সাইডম্যাগনেটাইট Fe3O4
রেডহিমাটাইট Fe2O3
জলযুক্ত অক্সাইডব্রাউন হেমাটাইট বা লিমোনাইট 2Fe2O3, 3H2O

লোহা বা আয়রন নিষ্কাশন

লোহা নিষ্কাশন করতে প্রধানত হেমাটাইট, ম্যাগনেটাইট, লিমোনাইট ও সিডারাইট আকরিক ব্যবহার করা হয়। বিচূর্ণ লোহা আকরিকের সঙ্গে সামান্য পরিমান কয়লা বা কোঁক চূর্ণ মিশিয়ে মিশ্রণটি অগভীর চুল্লিতে রেখে ভষ্মিকরণ করলে ফেরাস অক্সাইড জারিত হয়ে ফেরিক অক্সাইডে পরিণত হয়। ভস্মীভূত আকরিকের সঙ্গে কোক ও চুনাপাথর মিশিয়ে মারুত চুল্লিতে উত্তপ্ত বায়ুপ্রবাহের মিশ্রনটিকে জ্বালালে, Fe2O3 বিজারিত হয় লোহা উৎপন্ন করে।
2Fe2O3+3C=4Fe+3CO2;. Fe2O3+3C=2Fe+3CO

লোহা বা আয়রনের ব্যবহার

লোহার প্রকৃতি ও ধর্ম লোহায় মিশ্রিত কার্বনের উপর নির্ভর করে। কার্বনের পরিমাণ অনুসারে আয়রনকে আমরা তিন ভাগে ভাগ করতে পারি।
১. কাস্ট আয়রন বা ঢালাই লোহা
২. ইস্পাত বা স্টিল
৩. রট আয়রন বা পেটা লোহা

কাস্ট আয়রন বা ঢালাই লোহা কি

ঢালাই লোহাতে 2-5 শতাংশ কার্বন এবং সামান্য পরিমাণে সিলিকন, ম্যাঙ্গানিজ, ফারাস ও সালফার অপদ্রব্য হিসেবে থাকে। তিন শ্রেণীর লোহার মধ্যে কাস্ট আয়রন সবচেয়ে বেশি অশুদ্ধ হয়। ঢালাই লোহাকে স্থায়ীভাবে চুম্বকে পরিণত করা যায় না।

ঢালাই লোহা বা কাস্ট আয়রনের ব্যবহার

গলিত অবস্থায় ঢালাই লোহাকে ছাঁচে ঢেলে বিভিন্ন রকম দ্রব্য তৈরি করা হয়। যেমন মোটরের বহিরাংশ, রেলিং, লোহার নল, আলোক স্তম্ভ, উনুনের শিক ইত্যাদি। এছাড়াও নানান রকম যন্ত্রপাতি, লোহার ইস্ত্রী, রান্না ঘরের বিভিন্ন সরঞ্জাম প্রভৃতি কাস্টআয়রন দিয়ে তৈরি করা হয়। পাশাপাশি রট আয়রন এবং ইস্পাত প্রস্তুতিতে কাস্ট আয়রনের বেশিরভাগ অংশই ব্যবহৃত হয়।

ইস্পাত বা স্টিল কি

কাস্ট আয়রনের কার্বনের পরিমাণ বিভিন্ন অনুপাতে কমিয়ে বা বাড়িয়ে বিভিন্ন ধরনের স্টিল বা ইস্পাত তৈরি করা হয়। ইস্পাত স্টিলে 0.15 থেকে 1.5 শতাংশ পর্যন্ত কার্বন অশুদ্ধ হিসাবে মেশানো থাকে। স্টিলের বা ইস্পাতের মধ্যে কার্বনের মাত্রা অনুসারে বিভিন্ন রকমের স্টিল তৈরি করা হয়। যেমন মাইল্ড স্টিল (কার্বন: 0.15% -0.3%), মিডিয়াম স্টিল (কার্বন: 0.3%-0.6%), টুল স্টিল (কার্বন: 0.8%-1.4%), হাই কার্বন স্টিল (কার্বন: 0.6%-0.8%) প্রভৃতি। আবার স্টিলের সঙ্গে বিভিন্ন অনুপাতে অন্নদাতা মিশিয়ে বিশেষ বিশেষ কাজের উপযুক্ত নানান ধরনের সংকর ইস্পাত বা অ্যালয় স্টিল তৈরি করা হয়। যেমন স্টেনলেস স্টিল, নিকেল স্টিল, ম্যাঙ্গানিজ স্টিল, টাংস্টেন স্টিল, ইনভার প্রভৃতি। ইস্পাতকে স্থায়ী চুম্বকে পরিণত করা যায়। স্টিলকে লোহিত তপ্ত করে জলে ডুবিয়ে আবার 200°-350°C উষ্ণতায় উত্তপ্ত করলে এর নমনীয়তা ও দৃঢ়তা বাড়ে। এই পদ্ধতিকে ইস্পাতের পানদান বলা হয়।

ইস্পাত বা স্টিলের ব্যবহার

বর্তমান যুগে ইস্পাতকে মানবসভ্যতার কাঠামো বলা হয়। বিভিন্ন ধাতু ও ধাতু শংকরের মধ্যে ইস্পাতের ব্যবহার শুধুমাত্র যে অনেক বেশি তাই নয়; ইস্পাতের ব্যবহারের ক্ষেত্রও বহুমুখী যেমন
ক) কৃষিক্ষেত্রে ইস্পাতের ব্যবহার
ট্রাকটার লাঙ্গলের ফলা জলের পাম্প প্রভৃতি ইস্পাতের তৈরি ।
খ) পরিবহন ক্ষেত্রে স্টিলের ব্যবহার
সেতু, রেল ইঞ্জিন ও বগি, মোটরগাড়ি, বিমান, জাহাজ প্রভৃতিতে স্টিলের ব্যবহার করা হয়।
গ) শিল্প-কারখানা ইস্পাতের ব্যবহার
সমস্ত রকম শিল্পের যন্ত্রপাতি অথবা কাঁচামাল হিসেবে ইস্পাতের ব্যবহার করা হয়।
ঘ) চিকিৎসা ক্ষেত্রে স্টিলের ব্যবহার
অস্ত্রোপচারের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি তৈরীর কাজে স্টিল ব্যবহার করা হয়।
ঙ) সামরিক ক্ষেত্রে স্টিল বা ইস্পাতের ব্যবহার
সমস্ত রকম যুদ্ধাস্ত্র, ক্ষেপণাস্ত্র, বন্দুক প্রভৃতি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।

রট আয়রন বা পেটা লোহা

পেটা লোহার 0.12% – 0.25% কার্বন অশুদ্ধরূপে থাকে। একে স্থায়ীভাবে চুম্বকে পরিণত করা সম্ভব হয় না। বিভিন্ন রকম লোহার মধ্যে পেটা লোহা বা রট আয়রন সবচেয়ে বিশুদ্ধ হয়।

পেটা লোহা বা রট আয়রনের ব্যবহার

তড়িৎ চুম্বকের মজ্জা, তার,শিকল প্রভৃতি প্রস্তুতিতে রট আয়রনের ব্যবহার হয়।

লোহা বা আয়রনের ধর্ম

লোহার ভৌত ধর্ম

ক) বিশুদ্ধ লোহার রং সাদা এবং উজ্জ্বল।
খ) লোহা নমনীয় ঘাতসহ প্রসারণশীল ধাতু।
গ) আয়রন চৌম্বক ধর্মী পদার্থ,অর্থাৎ লোহা চুম্বক দ্বারা আকৃষ্ট হয় এবং লোহাকে চুম্বকে পরিণত করা যায়।
ঘ) আয়রনের আপেক্ষিক গুরুত্ব 7.85।
ঙ) আয়রন এর গলনাঙ্ক 1530°C এবং স্ফুটনাংক 25°C।

আয়রন এর রাসায়নিক ধর্ম

১. বায়ুর সঙ্গে লোহার রাসায়নিক বিক্রিয়া
ক) শুষ্ক বায়ুর সঙ্গে আয়রন বিক্রিয়া করে না।
খ) কিন্তু আদ্র বাতাসের মধ্যে লোহা বিক্রিয়া করে এবং লোহার উপরে লালাভ বাদামি আস্তরণ পড়তে দেখা যায়। একে মরিচা বলে।
গ) লোহাকে অক্সিজেনের উপস্থিতিতে উত্তপ্ত করলে স্ফুলিঙ্গসহ উজ্জ্বলভাবে জ্বলতে থাকে এবং ফেরোসোফেরিক অক্সাইড উৎপন্ন করে।
3Fe+2O2=Fe3O4
২. জলের সঙ্গে আয়রনের বিক্রিয়া
ক) সাধারণ উষ্ণতায় বিশুদ্ধ লোহার সঙ্গে জলের বিক্রিয়া ঘটে না।
খ) কিন্তু উত্তপ্ত লোহার উপর দিয়ে স্টিম চালনা করলে ফেরোসোফেরিক অক্সাইড ও হাইড্রোজেন গ্যাস উৎপন্ন হয়।
3Fe+4H2O=Fe3O4+H2
৩. ক্ষারের সঙ্গে লোহার বিক্রিয়া
কোন অবস্থাতে ক্ষারের সঙ্গে লোহার বিক্রিয়া হয় না


৪. লঘু এসিডের সঙ্গে আয়রনের বিক্রিয়া
ক) লঘু সালফিউরিক এসিড ও হাইড্রোক্লোরিক এসিডের সঙ্গে লোহা বিক্রিয়া করে ফেরাস সালফেট ও ফেরাস ক্লোরাইড এবং উভয় ক্ষেত্রে হাইড্রোজেন গ্যাস উৎপন্ন করে।
Fe+H2SO4=FeSO4+H2
Fe+HCl=FeCl2+H2
খ) লঘু নাইট্রিক এসিডের সঙ্গে বিক্রিয়ায় ফেরাস নাইট্রেট এবং অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট উৎপন্ন হয়।
4Fe+10HNO3=4Fe(NO3)2+NH4NO3+H2O
৫. গাঢ় এসিডের সঙ্গে বিক্রিয়া
ক) উত্তপ্ত এবং ঘন সালফিউরিক এসিডের সঙ্গে লোহা বিক্রিয়া করে সালফার ডাই অক্সাইড ও ফেরিক সালফেট উৎপন্ন করে।
2Fe+6H2SO4=Fe(SO4)3+3S2O+6H2O


খ) ঘন ও উত্তপ্ত নাইট্রিক এসিডের সঙ্গে লোহার বিক্রিয়ায় ফেরিক নাইট্রেটের হলুদ দ্রবণ এবং বাদামী বর্ণের নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড গ্যাস উৎপন্ন হয়।
Fe+6HNO3=Fe(NO3)3+3NO2+3H2O
গ) প্রতি ঘন ও ধুমায়মান নাইট্রিক এসিডের সংস্পর্শে লোহার উপর আয়রন অক্সাইডের একটি পাতলা আস্তরণ পড়ে। ওই সময় অ্যাসিড আর কোন রকম ভাবে লোহার সঙ্গে বিক্রিয়া করতে পারে না। এই অবস্থাকে লোহার নিষ্ক্রিয় অবস্থা বলে।
৬. 120° সেন্টিগ্রেড উষ্ণতায় উপরে লোহা চূর্ণ কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস শোষণ করে আয়রন পেন্টাকার্বনিল গঠন করে।
Fe+5CO=Fe(CO)5
৭. প্রতিস্থাপন বিক্রিয়া
ধাতব আয়রন অপেক্ষাকৃত কম তড়িৎ ধনাত্মক ধাতু লবণের দ্রবণ থেকে ধাতুকে প্রতিস্থাপিত ক’রে অধঃক্ষিপ্ত করে এবং বিক্রিয়ায় ফেরাস লবণ উৎপন্ন হয়। যেমন-কপার সালফেট দ্রবণে লোহা যোগ করলে কপার অধঃক্ষিপ্ত হয় এবং ফেরাস সালফেট লবন পাওয়া যায়।
CuSO4+Fe=FeSO4+Cu

লোহা বা আয়রন সম্পর্কিত প্রশ্নোত্তর

লোহার পাত্রে কপার সালফেট দ্রবণ রাখা হয় না কেন

লোহার পাত্রে কপার সালফেট দ্রবণে রাখা যায় না, কারণ লোহার সঙ্গে কপার সালফেটের বিক্রিয়ার ফলে দ্রবণে ফেরাস সালফেট উৎপন্ন হয় এবং লাল রঙের ধাতব কপার অধিঃক্ষিপ্ত হয়।

অম্লযুক্ত কপার সালফেট দ্রবণে একটি লোহার চামচ ডোবালে কি ঘটবে

অম্লযুক্ত কপার সালফেট দ্রবণে লোহার চামচ ডোবালে লাল রংয়ের কপার অধঃক্ষিপ্ত হবে এবং ফেরাস সালফেট উৎপন্ন হবে।

মরিচা কি

আর্দ্র বায়ুর মধ্যে লোহা কিছুদিন থাকলে লোহার উপরে হলুদ রঙের আস্তরণ পড়ে একে মরিচা বলে। মরিচা হল সোদক অর্থাৎ জলযুক্ত ফেরিক অক্সাইড। লোহায় মরিচা পড়ার জন্য জল বা জলীয়বাষ্প এবং বায়ুর অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। মরিচার সংকেত হলো 2Fe2O3, 3H2O

আরও পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here