এই অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করব পর্যাবৃত্ত গতি, পূর্ণ দোলন, পর্যায়কাল, কম্পাঙ্ক, তীক্ষ্ণতা, তরঙ্গদৈর্ঘ্য, বিস্তার ইত্যাদি সম্বন্ধে।
পর্যাবৃত্ত গতি কাকে বলে ( সংজ্ঞা)
যদি কোন গতিশীল বস্তু বারবার একই পথে যাতায়াত করে এবং নির্দিষ্ট সময় পর পর একই অবস্থানে ফিরে আসে তবে ঐ বস্তুর গতিকে পর্যাবৃত্ত গতি বলে।
পর্যাবৃত্ত গতির উদাহরণ
ঘড়ির কাঁটার গতি অর্থাৎ ঘন্টার বা মিনিট সেকেন্ডের কাঁটার গতি, পৃথিবীর বার্ষিক গতি, সরল দোলকের গতি প্রকৃতি পর্যাবৃত্ত গতির উদাহরণ।
পূর্ণ দোলন কাকে বলে (সংজ্ঞা)
পর্যাবৃত্ত গতিতে চলমান কোন বস্তু তার গতিপথের যে কোন বিন্দু থেকে নির্দিষ্ট দিকে যাত্রা করে বিপরীত দিক থেকে আবার সেই বিন্দুতে ফিরে এলে বলা হয় যে, বস্তুটি একটি পূর্ণ দোলন বা কম্পন সম্পন্ন করেছে।
পূর্ণ দোলনের উদাহরণ
আমরা যখন দোলনায় দোলে তখন একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে যাত্রা শুরু করে একটি স্থানে গিয়ে সামান্য থেমে আবার ঐ একই পথে পূর্বের স্থানে ফিরে আসে। এই টোটাল যাত্রাপথকে আমরা পূর্ণ দোলন বলে থাকি। ঘড়ির পেন্ডুলামের গতি পূর্ণ দোলনের উদাহরণ।
পর্যায়কাল কাকে বলে (সংজ্ঞা)
কম্পনশীল কোন বস্তু কণার যে সময়ে একটি পূর্ণ দোলন বা কম্পন সম্পন্ন করে থাকে বস্তুটির পর্যায় কাল বা period বলে।
পর্যায়কালের একক সেকেন্ড এবং পর্যায়কালকে সাধারণত T দিয়ে প্রকাশ করা হয়।
কম্পাঙ্ক কাকে বলে (সংজ্ঞা)
পর্যাবৃত্ত গতিতে স্পন্দনশীল বা কম্পনশীল বস্তু প্রতি সেকেন্ডে যতবার স্পন্দন বা কম্পন সম্পন্ন করে সেই সংখ্যাকে ঐ বস্তুর কম্পাঙ্ক বা ফ্রিকোয়েন্সি বলে।
বিস্তার কি বা কাকে বলে ( সংজ্ঞা)
স্পন্দনশীল বস্তুকণাকে তার সাম্য অবস্থান থেকে যে চরম দূরত্ব যেতে হয়, তাকে বিস্তার বলে।
সরল দোল গতি কি বা কাকে বলে ( সংজ্ঞা)
এটি বিশেষ এক ধরনের পর্যাবৃত্ত গতি যা সরলরেখা বরাবর সম্পন্ন হয়। কোন বস্তুর উপর ক্রিয়াশীল বল যদি সর্বদা বস্তুর গতিপথের মধ্যবিন্দু অভিমুখী হয় এবং ওই বিন্দু থেকে বস্তুর সরণের সমানুপাতিক হয়, তবে ওই পরের অধীনে বস্তুর গতি যে সরল দোলগতি বলে।
সরল দোল গতির উদাহরণ
সরল দোলকের গতি, সুরশলাকার বাহুর গতি ইত্যাদি হল সরল দোলগতির উদাহরণ।
তরঙ্গদৈর্ঘ্য কাকে বলে (সংজ্ঞা)
শব্দ উৎস বা স্বনকের একটি পূর্ণ কম্পনে শব্দ যে দূরত্ব অতিক্রম করে তাকে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বলে।
বাতাসে ছড়িয়ে পড়ার শব্দ তনুভবন এবং ঘনীভূত স্তররূপে বাতাসের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায়। অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গের ক্ষেত্রে একটি ঘনীভবন এবং পরবর্তী তনুভবনের মোট দৈর্ঘ্যকে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বলা হয়।
তরঙ্গদৈর্ঘ্যকে গ্রিক অক্ষর (λ) ল্যামডা দ্বারা প্রকাশ করা হয়। শব্দ বিস্তারের সময় প্রতি সেকেন্ডে যতগুলি তরঙ্গদৈর্ঘ্য কোন বিন্দুকে অতিক্রম করে, সেই সংখ্যাকে শব্দ তরঙ্গের কম্পাঙ্ক বলে। শব্দ উৎসের কম্পাঙ্ক এবং শব্দ তরঙ্গের কম্পাঙ্ক একই হয়।
শব্দ তরঙ্গের একক
সিজিএস পদ্ধতিতে শব্দ তরঙ্গের একক সেন্টিমিটার; এপিএস পদ্ধতিতে শব্দ তরঙ্গের একক ফুট; এমকেএস এবং এসআই পদ্ধতিতে শব্দ তরঙ্গের একক মিটার।
কম্পাঙ্ক
কম্পনশীল কোন বস্তুর প্রতি সেকেন্ডে যতবার পূর্ণ কম্পন সম্পন্ন করে সেই সংখ্যাগুলি বস্তুর কম্পাঙ্ক বলে।
কম্পাঙ্কের একক সাইকেলস পার সেকেন্ড বা হার্জ।
স্পন্দনশীল বস্তুর একবার পূর্ণ স্পন্দন হলে মাধ্যমে একটি পুর্ন তরঙ্গের সৃষ্টি হয়। সুতরাং বলা যায় যে,
1 সেকেন্ডে মাধ্যমের ভেতর যতগুলো পূর্ণ তরঙ্গের সৃষ্টি হয় সেই সংখ্যাকে কম্পাঙ্ক বলে।
একটি উদাহরণ দিয়ে বুঝি,
একটি সুরশলাকার বাহু যদি 1 সেকেন্ডে 256 বার পুর্ন কম্পন সম্পন্ন করে, তাহলে সুরশলাকাটির কম্পাঙ্ক হবে 256।
স্বনকের কম্পাঙ্ককে সাধারণত n দ্বারা প্রকাশ করা হয়। অর্থাৎ, n কম্পাঙ্ক বিশিষ্ট কোন স্বনক 1 সেকেন্ডে n সংখ্যক পুর্ন কম্পন সম্পন্ন করে।
অতএব একটি পূর্ণ কম্পন সম্পন্ন করতে স্বনকটির 1/ n সেকেন্ড সময় লাগে। আবার একটি কম্পনের জন্য স্বনকের যে সময় লাগে তাকে পর্যায়কাল (T) বলে। অতএব T=1/ n
অর্থাৎ বলা যায় যে, কম্পাঙ্ক পর্যায়কালের ব্যস্তানুপাতিক।
আবার একটি পূর্ণ তরঙ্গ সৃষ্টি করতে হলে, কম্পনশীল কোন বস্তুর একবার পুর্ন কম্পন সম্পন্ন করতে হয়। তাহলে n সংখ্যক পূর্ণতরঙ্গ সম্পন্ন করতে কোন বস্তুতে 1 সেকেন্ডে n সংখ্যক কম্পাঙ্ক সৃষ্টি হয়।
এখন তরঙ্গদৈর্ঘ্য যদি λ হয়, তাহলে একটি মাধ্যমের মধ্য দিয়ে n সংখ্যক পূর্ণতরঙ্গ 1 সেকেন্ডে n×λ দূরত্ব অতিক্রম করবে। আবার শব্দ 1 সেকেন্ডে যে দূরত্ব অতিক্রম করে তাকে শব্দের বেগ v বলে।
অতএব, v=n×λ
আবার, n=v/λ
অর্থাৎ, শব্দের বেগ =স্বনকের কম্পাঙ্ক × তরঙ্গ দৈর্ঘ্য
এখন নির্দিষ্ট মাধ্যমে শব্দের বেগের মান ধ্রুবক।
অতএব, বলা যায়, তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম্পাঙ্কের ব্যস্তানুপাতিক। অর্থাৎ স্বনকের কম্পাঙ্ক বাড়লে তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমবে এবং কম্পাঙ্ক কমলে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বাড়ে।
তীক্ষ্ণতা
তীক্ষ্ণতা কাকে বলে (সংজ্ঞা)
শব্দের কোন নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের জন্য আমাদের কানে যে বিশেষ অনুভূতির সৃষ্টি হয় তাকে তীক্ষ্ণতা বলে। অর্থাৎ, শব্দের যে ধর্ম বা বৈশিষ্ট্যের জন্য চড়ার সুর এবং খাদের সুরের শব্দকে পৃথকভাবে চেনা যায় তাকে তীক্ষ্ণতা বলে।
তীক্ষ্ণতা হলো সুরযুক্ত শব্দের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। যেমন ছোট কাঁচের শিশির মধ্যে ফু দিলে তীক্ষ্ণ শব্দ সৃষ্টি হয়; আবার বড় কাঁচের বোতলের মধ্যে ফু দিলে মোটা শব্দ সৃষ্টি হয়। হারমোনিয়ামে ‘সা’ সুরের চেয়ে ‘রে’ সুর চড়া হয়।
তুলনামূলকভাবে বেশি তীক্ষ্ণ সুরকে চড়া সুর এবং কম তীক্ষ্ণ সুরকে খাদের সুর বলা হয়।
কম্পাঙ্ক ও তীক্ষ্ণতার মধ্যে সম্পর্ক
কম্পাঙ্ক এবং তীক্ষ্ণতার মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে নিচে আলোচনা করা হলো
১. সুরের তীক্ষ্ণতা শব্দের কম্পাঙ্কের সমানুপাতিক। অর্থাৎ, কম কম্পাঙ্কের শব্দের তীক্ষ্ণতা কম এবং বেশি কম্পাঙ্কের শব্দের তীক্ষ্ণতা বেশি। তাহলে বলা যেতে পারে কম্পাঙ্ক হল কারণ এখন তীক্ষ্ণতা তার ফল।
এই কারণে তীক্ষ্ণতাকে কম্পাঙ্ক দিয়ে প্রকাশ করা হয়।
২. কম্পাঙ্ক একটি ভৌত রাশি হওয়ার কারণে একে পরিমাপ করা যায়। যেমন সুরশলাকার কম্পাঙ্ক 256, 512 ইত্যাদি। তীক্ষ্ণতা একটি অনুভূতি তাই একে পরিমাপ করা সম্ভব হয় না।
৩. তীক্ষ্ণতা শব্দের উৎস থেকে শ্রোতার দূরত্বের ব্যস্তানুপাতিক হয়। যেমন লাউডস্পিকারের শব্দের তীক্ষ্ণতা কাছাকাছি এলে বেশি হয় এবং দূরে গেলে কমে যায়।
৪. তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ও কম্পাঙ্কের ব্যস্তানুপাতিক। কম্পাঙ্ক বাড়লে তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমে। যে সুরের তীক্ষ্ণতা যত বেশি তার তরঙ্গদৈর্ঘ্য তত কম হয়।
৫. তীক্ষ্ণতা হল শ্রবণেন্দ্রিয়ের একটি বিশেষ অনুভূতি। শব্দের তীক্ষ্ণতা শব্দের কম্পাঙ্কের উপর নির্ভর করে বলে আমরা শব্দের কম্পাঙ্কের দ্বারা তীক্ষ্ণতাকে প্রকাশ করে থাকি।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে কম্পাঙ্ক এবং তীক্ষ্ণতার মধ্যে সম্পর্ক বোঝা গেছে।
কম্পাঙ্ক ও তীক্ষ্ণতার মধ্যে পার্থক্য
কম্পাঙ্ক ও তীক্ষ্ণতার মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য আছে। নিচে কম্পাঙ্ক ও তীক্ষ্ণতার মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করা হলো।
কম্পাঙ্ক | তীক্ষ্ণতা |
১. শব্দউৎসের 1 সেকেন্ডে যতবার পূর্ণ কম্পন হয় সেই সংখ্যা হল ওই শব্দের কম্পাঙ্ক। | ১. শব্দের যে বৈশিষ্ট্যের জন্য শব্দকে খাদের বা চড়া বলে মনে হয় তাকে শব্দের তীক্ষ্ণতা বলে। |
২. কম্পাঙ্ক তীক্ষ্ণতার কারণ | ২. তীক্ষ্ণতা কম্পাঙ্কের ফল। কম্পাঙ্ক বাড়লে তীক্ষ্ণতা বাড়ে এবং কম্পাঙ্ক কমলে তীক্ষ্ণতা কমে। |
৩. কম্পাঙ্ক হল স্বনকের স্পন্দনের হার। | ৩. তীক্ষ্ণতা হল শব্দের একটি ধর্ম যা আমাদের মস্তিষ্কে বিশেষ অনুভূতি সৃষ্টি করে। |
৪. কম্পাঙ্ক ও একটি ভৌত রাশির পরিমাপ করা সম্ভব। | ৪. তীক্ষ্ণতা একটি অনুভূতি তাই এটি ভৌত রাশি নয় এবং এর পরিমাপ করা সম্ভব নয়। |
৫. কম্পাঙ্ক ও সুরযুক্ত এবং সুর বর্জিত উভয় শব্দের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। | ৫. ঠিকমতো কেবলমাত্র সুরযুক্ত শব্দের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। |
এই ছিল কম্পাঙ্ক এবং তীক্ষ্ণতার মধ্যে পার্থক্য।
কম্পাঙ্ক সম্পর্কিত প্রশ্নোত্তর
বাঘের গর্জনের চেয়ে মশার গুনগুন শব্দ বেশি তীক্ষ্ণ হয় কেন
মশার গুন গুন শব্দের তীক্ষ্ণতা বাঘের গর্জনের তার চেয়ে বেশি। এর কারণ হলো মশার ডানার কম্পনে উৎপন্ন শব্দের কম্পাঙ্ক, বাঘের গর্জনের কম্পাঙ্কের চেয়ে অনেক বেশি।
পুরুষের গলার স্বরের চেয়ে শিশুরা মেয়েদের গলার স্বর শুরু হয় কেন
মানুষের গলায় দুটি পর্দা থাকে এদের স্বরতন্ত্রী বলে। এই পর্দায় কম্পন হলে শব্দ উৎপন্ন হয়।
পুরুষের ক্ষেত্রে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই স্বরতন্ত্রী দৃঢ় হয়। ফলে স্বরতন্ত্রীর কম্পাঙ্ক কমে। স্বরযন্ত্রের কম্পাঙ্ক কমে যাওয়ায় স্বরের তীক্ষ্ণতা কমে এবং স্বর মোটা হয়।
আপরপক্ষে শিশু বা মেয়েদের গলার স্বরতন্ত্রী তত দৃঢ় নয়। তাই এদের স্বরের কম্পাঙ্ক বেশি হয়। ফলে ওই স্বরতন্ত্রীর কম্পনে উৎপন্ন স্বরের তীক্ষ্ণতা পুরুষের গলার স্বরের তীক্ষ্ণতার চেয়ে বেশি হয়। ঠিকমতো অপেক্ষাকৃত বেশি হয় শিশু বা মেয়েদের গলার স্বর পুরুষের গলার স্বরের চেয়ে শরু হয়।
কলের নিচে কলসি রেখে কলসিতে জল ভর্তি করতে থাকলে প্রথমে গম্ভীর শব্দ শোনা যায় কিন্তু পরে কলসি যত ভর্তি হতে থাকে তত চড়া হয়। কারণ কি?
এক্ষেত্রে খালি কলসি রেখে কলসিতে জল ভর্তি করতে থাকলে প্রথমে মোটা শব্দ শোনা যায়। কারণ খালি কলসিতে বায়ুর স্তম্ভের দৈর্ঘ্য বেশি থাকে ফলে উৎপন্ন শব্দের কম্পাঙ্ক কম হয়। তাই গম্ভীর শব্দ শোনা যায়।
অপরপক্ষে কলসি যত ভরে যেতে থাকে ততোই কলসির ভেতরের বায়ু স্তম্ভের দৈর্ঘ্য কমতে থাকে। ফলে কলসির ভিতরের বায়ুর কম্পাঙ্ক ক্রমশ বাড়তে থাকে। তাই উৎপন্ন শব্দের তীক্ষ্ণতা বাড়ে ফলে শব্দ ক্রমশ চড়া হতে থাকে।
কাচের বোতলের চেয়ে কাচের ছোট শিশিতে ফু দিলে বেশি তীক্ষ্ণ শব্দ শোনা যায় কেন
উভয় ক্ষেত্রেই বায়ুস্তম্ভের কম্পনের ফলে শব্দ সৃষ্টি হয়। বোতলে বায়ু বেশি থাকায় শব্দের কম্পাঙ্ক কম হয় এবং শিশিতে বায়ু কম থাকায় শব্দের কম্পাঙ্ক বেশি হয় ফলে শীশিতে ফু দিলে বেশি তীক্ষ্ণ শব্দ শোনা যায়।