কোন কার্য করতে হলে বাধা অতিক্রম করতে হয়। এই বাধা অতিক্রম করার জন্য বলের প্রয়োজন। সেই জন্য কার্য করা কঠিন মনে হয়। এই বাধাকে সহজে অতিক্রম করতে দৈনন্দিন জীবনে আমরা বিভিন্ন যন্ত্র ব্যবহার করে থাকি। যেমন কাঠের পাটাতন ফেলে ঢালুপথ তৈরি করে লরি বা নৌকাতে জিনিসপত্র তোলা হয়, বেলচা দিয়ে পাথর টুকরো কুড়ানো হয়, ঢেঁকি দিয়ে ধান থেকে চাল তৈরি করা হয়, চরকির মাধ্যমিক ও থেকে জল তোলা হয় আরো অনেক এরকম উদাহরণ আমাদের চোখের সামনে প্রতিনিয়ত ঘটে থাকে।
যন্ত্র কাকে বলে
১) যে ব্যবস্থার সাহায্যে কম বল প্রয়োগ করে বেশি বাধাকে সহজে অতিক্রম করা যায় তাকে যন্ত্র বলে।
২) যন্ত্র হলে একটি ব্যবস্থা,যার এক অংশে বলপ্রয়োগ করে অন্য অংশে অবস্থিত কোন বাধা কে সহজে অতিক্রম করা যায়।
সাধারণত যন্ত্রের গঠন প্রণালী খুব জটিল। গম ভাঙ্গার কল, ছাপাখানার যন্ত্র, কাপড় বোনার কল প্রভৃতি জটিল ধরনের যন্ত্র। কিন্তু আনত তল, অক্ষদন্ডযুক্ত চক্র এবং লিভার প্রভৃতি সরল যন্ত্র। এইসব যন্ত্রের এক অংশে তুলনামূলকভাবে কম বল প্রয়োগ করে অন্য অংশে অবস্থিত বাধাকে সহজে অতিক্রম করা যায়। এছাড়া সরল যন্ত্রে কেবলমাত্র যান্ত্রিক শক্তি প্রয়োগ করা হয়।
বাধা কয় প্রকার ও কি কি
যন্ত্র ব্যবহার করা হয় বাধা অতিক্রম করার জন্য। এই বাধা মূলত তিন রকমের হয়ে থাকে।
১. অভিকর্ষ বলের বাধা,
২. ঘর্ষণজনিত বাধা এবং
৩. পদার্থের জাড্যের বাধা
১. অভিকর্ষজনিত বাধা
ভূপৃষ্ঠের বা তার কাছাকাছি সব বস্তুকেই পৃথিবীর নিজেও কেন্দ্রের দিকে আকর্ষণ করে। এই আকর্ষণকে অভিকর্ষ বলে। এজন্য একটি বস্তুকে উপরে তুলতে হলে বল প্রয়োগ করে অভিকর্ষ বলের বিরুদ্ধে কাজ করতে হয়।
২. ঘর্ষণজনিত বাধা
যদি দুটি বস্তুকে পরস্পরের সংস্পর্শে রেখে একটির উপর দিয়ে আরেকটিকে সরাবার চেষ্টা করা হয়, তবে ওদের স্পর্শ তলে একটি বিরুদ্ধ বল কাজ করে, এই বিরুদ্ধ বল বস্তুটির সরণে বাধা দেয়। এই ধরনের বাধাকে বলা হয় ঘর্ষণজনিত বাধা এবং ওই বলকে ঘর্ষণজনিত বল বলে।
টেবিলের উপর বই রেখে বইটিকে ঠেলার চেষ্টা করলে টেবিলটি যদি অমসৃণ হয় তাহলে বইটিকে সরাতে বেশি বল প্রয়োগ করতে হয়, আবার মসৃণ হলে কম বল প্রয়োগ করেই সরানো যাবে।
৩. পদার্থের জাড্য বলের বাধা
পদার্থের জাড্য কাজে বাধার সৃষ্টি করে। মালবোঝাই ঠেলাগাড়ি থেমে গেলে ওকে চালাতে প্রথমে অনেক বল প্রয়োগ করতে হয়, কারণ তখনকার এর স্থিতি জাড্য প্রযুক্ত বলের বিরুদ্ধে প্রবল বাধা দেয়।
এখন বাধা যত বেশি হবে, কার্য করাও ততো কঠিন হবে।
যান্ত্রিক সুবিধা এবং কর্মদক্ষতা
যন্ত্রে যে বল প্রয়োগ করা হয় তাকে প্রযুক্ত বল বলে। যে বাধাকে অতিক্রম করতে যন্ত্রে বল প্রয়োগ করতে হয় তাঁকে অতিক্রান্ত বাধা বলা হয়।
অতিক্রান্ত বাধা W এবং প্রযুক্ত বলের P অনুপাতকে যান্ত্রিক সুবিধা বলে।
যান্ত্রিক সুবিধা = ভার বা অতিক্রান্ত বাধা/প্রযুক্ত বল =W/P
সাধারণত যন্ত্রে কম বল প্রয়োগ করে অনেক বেশি বাধা অতিক্রম করার চেষ্টা করা হয়। ফলে যান্ত্রিক সুবিধার মান 1 এর বেশি হয়। নততল, অক্ষদণ্ড যুক্ত চক্র, দ্বিতীয় শ্রেণীর লিভার এর যান্ত্রিক সুবিধা 1 এর চেয়ে বেশি। আবার যেসব যন্ত্রে অতিক্রান্ত বাধা, প্রযুক্ত বলের চেয়ে কম, সে সব যন্ত্রে যান্ত্রিক সুবিধা 1 এর চেয়ে কম হয়। তৃতীয় শ্রেণীর লিভারের যান্ত্রিক সুবিধা 1 এর চেয়ে কম।
যন্ত্রের কর্মদক্ষতা
যন্ত্রের সাহায্যে শক্তির পরিমাণ বাড়ানো যায় না। যন্ত্রে মোট কতটা পরিমাণ কার্য করা হয় এবং যন্ত্রটি থেকে মোট কি পরিমান কার্য পাওয়া যায় এর উপর এই যন্ত্রটির কার্যদক্ষতা নির্ভর করে।
প্রসঙ্গত বলা যায় যে যন্ত্রে যে পরিমাণ শক্তি সরবরাহ করা হয় তার সবটুকু কার্যে রূপান্তরিত হয় না।
অর্থাৎ কর্মদক্ষতা = (যন্ত্র দ্বারা কৃতকার্য/যন্ত্রে প্রযুক্ত শক্তি)×100%
উদাহরণ, কর্মদক্ষতাকে শতকরা হিসেবে প্রকাশ করা হয়। একটি আদর্শ যন্ত্রের কর্মদক্ষতা 100%। এই যন্ত্রের প্রযুক্ত শক্তিও প্রাপ্ত কার্য পরস্পর সমান হয়। কিন্তু ঘর্ষণ প্রভৃতি বাধা অতিক্রম করার জন্য কিছু শক্তি বাহিত হয় ফলে যন্ত্রের কর্মদক্ষতা 100% এর কম হয়।
আনততল ও আনততলের যান্ত্রিক সুবিধা ও ব্যবহার
একটি মসৃণ পাটাতনকে অনুভূমিক না রেখে যদি ভূমি তলের সঙ্গে কোন করে রাখা হয়, তবে সেই অবস্থায় পাটাতনের তলকে আনত তল বলে। এর সাহায্যে ভারী বস্তুকে সহজে উপরে তোলা যায়।
আনততলের ব্যবহার
যেসব ভারী বস্তুকে সরাসরি উপরে তোলা কষ্টসাধ্য আনততল ব্যবহার করে তাদের সহজেই উপরে তোলা যায়। লরি বা ট্রেনে ভারি মাল তুলতে কাঠের তক্তার আনততল ব্যবহার করা হয়। খাড়া মই বেয়ে উপরে উঠতে কষ্ট হয়, কিন্তু মইটিকে আনততল হিসেবে ব্যবহার করলে ওই মইতে খুব সহজে উপরে ওঠা যায়।ঘরের সিঁড়ি নততলের উদাহরণ
আনততলের যান্ত্রিক সুবিধা
মনে করি AB একটি আনততল যা অনুভূমিক তল AC র সাথে θ কোণে নত আছে। অনুভূমিক তল থেকে আনততলটির উচ্চতা BC
এখন W ভরের কোন বস্তুকে AB আনততলের A প্রান্ত থেকে B প্রান্তে নিয়ে যেতে বস্তুটির উপর আনততলের সমান্তরালে যদি P বল প্রয়োগ করতে হয়, তবে কৃতকার্য = বল×বস্তুর সরণ
সরণ= P×AB।
আবার ওই বস্তুটিকে C থেকে সরাসরি B তে তুলতে কৃতকার্য=বস্তুর ওজন×উচ্চতা=W×BC। উভয় ক্ষেত্রে বস্তুটিকে একই উচ্চতায় তোলা হয়েছে। তাই উভয় ক্ষেত্রে কার্যের পরিমাণ সমান।
অতএব, P×AB=W×BC
বা, W/P=AB/BC
অর্থাৎ, (অতিক্রান্ত ভার/প্রযুক্ত বল) = (আনততলটির দৈর্ঘ্য/আনততলের উচ্চতা)
অতএব আনততলের যান্ত্রিক সুবিধা = আনততলটির দৈর্ঘ্য/আনততলের উচ্চতা = AB/BC
এখন, AB, BC অংশের চেয়ে দীর্ঘ হওয়ায় এর মান 1 এর চেয়ে বেশি হবে। অর্থাৎ আনততলের যান্ত্রিক সুবিধা 1 এর বেশি হবে।
অতএব আনততলে কম বল প্রয়োগ করে বেশি ভরের বস্তুকে একই উচ্চতায় তোলা যায়। এই ব্যবস্থায় নততলের কোন যত কম হবে নততলের যান্ত্রিক সুবিধার মান তত বাড়বে। ছুরি কুড়াল স্ক্রু গোজ প্রভৃতি নততলের বাস্তব উদাহরণ। ছুরি, কুড়াল ও গোঁজে দুটি সমতল পৃষ্ঠ ক্রমশ নত হয়ে তীক্ষ্ণ প্রান্তের সৃষ্টি করে। তাই এদের তীক্ষ্ণ প্রান্তটি দুটি নততলের সমন্বয়ে তৈরি হয়।
অক্ষদন্ড যুক্ত চক্রের যান্ত্রিক সুবিধা ও ব্যবহার
অক্ষ দন্ড চক্রে একই অক্ষ বিশিষ্ট একটি কম ব্যাসার্ধের বেলন দণ্ডের সঙ্গে অপর একটি বেশি ব্যাসার্ধের বেলন দৃঢ়ভাবে যুক্ত থাকে। বড় বেলুনটিকে চক্র বলা হয় এবং ছোট ব্যাসের দীর্ঘ বেলনটাকে অক্ষদন্ড বলা হয়।
অক্ষ দণ্ডযুক্ত চক্রের বর্ণনা
ছবিতে AB অক্ষদন্ড এবং CD চক্র। বেলন দুটিতে দুটি দড়ি পরস্পর বিপরীত পাশে জড়ানো থাকে। ফলে চক্রের দড়ির পাক খুলতে শুরু করলে অক্ষদন্ডের দড়ি জড়াতে আরম্ভ করে। দড়ি যাতে পিছলে না যায়, সেজন্য চক্রটির গায়ে খাঁজ কাটা থাকে। দড়িটিকে ওই খাঁজ বরাবর জড়ানো হয়। অক্ষদন্ডটিকে দুটি অবলম্বনের সাহায্যে অনুভূমিকভাবে রাখা হয়।
অক্ষ দন্ডযুক্ত চক্রের কার্যপ্রণালী
চক্রের দড়ির পাক প্রয়োজনমতো গোটালে, অক্ষদণ্ড দড়ির পাক খুলে যায় এবং দড়িটি শেষ প্রান্ত বেশ নিচে নেমে আসে। এই অবস্থায় অক্ষদন্ড দড়ির শেষপ্রান্তে W ভারকে ঝুলিয়ে রাখা হয়।এরপর চক্রে জড়ানো দড়ির শেষপ্রান্তে P বল প্রয়োগ করলে চক্রের দড়ি খুলতে শুরু করে, এবং অক্ষদণ্ডের দড়ি দন্ডে জড়াতে থাকে। ফলে W ভারটি উপরে উঠে আসে। এই প্রক্রিয়ায় অপেক্ষাকৃত কম বল প্রয়োগ করে বেশি ভরের বস্তুকে নিচে থেকে উপরে তোলা যায়।
অক্ষদন্ড এর যান্ত্রিক সুবিধা
এই যন্ত্রে চক্রের দড়ি এক পাক খুললে অক্ষদন্ডের দড়ি 1 পাক জড়াবে। যদি চক্রের ব্যাসার্ধ R এবং অক্ষদন্ড ব্যাসার্ধ r হয় তবে, অক্ষদন্ড যুক্ত চক্রের যান্ত্রিক সুবিধা = (চক্রের ব্যাসার্ধ/অক্ষ দন্ডের ব্যাসার্ধ) = R/r
এখানে যেহেতু চক্রের ব্যাসার্ধ অক্ষদন্ডের ব্যাসার্ধের চেয়ে অনেক বড়, সুতরাং অক্ষদন্ড চক্রের যান্ত্রিক সুবিধা সর্বদায়ই বেশি হয়। অর্থাৎ কম বল প্রয়োগ করে এই যন্ত্রের সাহায্যে বেশি ভারকে উপরে তোলা যায়।
অক্ষদন্ড যুক্ত চক্রের ব্যবহারিক প্রয়োগ
ক) গ্রামাঞ্চলে অক্ষদণ্ড জড়ানো দড়ির শেষপ্রান্তে বালতি ঝুলিয়ে গভীর কুয়ো থেকে পানীয় জল সংগ্রহ করা হয়।
খ) রেডিওর নব মোটর গাড়ির স্টিয়ারিং অক্ষদণ্ড যুক্ত চক্রের মত।
গ) জাহাজের নোঙ্গর তোলার যন্ত্রকে ক্যাপস্টান বলে। এই যন্ত্রের চক্র ও অক্ষদন্ডের কার্যনীতি প্রয়োগ করা হয়।প্রয়োগ করে অতি সহজে জাহাজের নোঙ্গর তোলা যায়।
ঘ) চরকি কল
গভীর কুয়ো থেকে বালতি দিয়ে জল তুলতে চোরকি কল ব্যবহার করা হয়। এই যন্ত্রের চোঙাকৃতি অনুভূমিক দণ্ডের গায়ের খাঁজে শক্ত দড়ি জড়িয়ে দড়ির খোলা মুখে বালতি বাধা হয় । দন্ডটিরএক প্রান্তে একটি S আকৃতির হাতল যুক্ত থাকে। এটি চক্রের কাজ করে। হাতলের শেষ প্রান্তে বলপ্রয়োগ করে জলভর্তি বালতির দড়িকে চোঙাকৃতি দন্ডের উপর ক্রমশ ছড়ানো হয়। ফলে জলপূর্ণ বালতি উপরে উঠে আসে।
প্রশ্নোত্তর
নততল কে যন্ত্র বলা হয় কেন
আমরা জানি, যে ব্যবস্থার সাহায্যে কম বল প্রয়োগ করে বেশি বাধাকে অপেক্ষাকৃত সহজে অতিক্রম করা যায় তাকেই যন্ত্র বলে। আনততল বরাবর কোন ভারী জিনিসকে অপেক্ষাকৃত কম বল প্রয়োগ করে উপরে তোলা যায়। অর্থাৎ নততলের যান্ত্রিক সুবিধা 1 এর বেশি। তাই আনততলকে যন্ত্র বলা হয়। শোনা যায় যে বহু বছর আগে,যখন ক্রেনের আবিষ্কার হয়নি তখন মিশরের পিরামিড কিংবা পুরি বা কোনারকের মন্দিরের বহু উচ্চতায় পাথর তুলতে নততলের সাহায্য নেওয়া হয়েছিল।
পাহাড়ের গায়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পথ তৈরি করা হয় কেন
পাহাড়ের গায়ে যে বাঁকা পথ থাকে তা নততলের মত আচরণ করে। নততলের যান্ত্রিক সুবিধাকে কাজে লাগাতে খারা পথে না উঠে ঢালু পথ বেয়ে পাহাড়ে ওঠা হয়। এই জন্য পাহাড়ের গায়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পাহাড়ে ওঠার পথ তৈরি করা হয়ে থাকে। এই পথে পাহাড়ে ওঠা নামা করতে খাড়া পথের তুলনায় পরিশ্রম অনেক কম হয়।