পদার্থের তিন অবস্থার মধ্যে একটি বিশেষ অবস্থা হলো তার গ্যাসীয় অবস্থা। পদার্থের গ্যাসীয় অবস্থাটি অন্য দুই অবস্থা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। পৃথিবীতে একেকটি গ্যাস একই প্রকৃতির হয়ে থাকে। কিন্তু এইসব গ্যাসের মধ্যে কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম লক্ষ্য করা যায়। এই অধ্যায়ের আলোচনায় আমরা গ্যাসের ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করব।
১. প্রসারণশীলতা গ্যাসের ধর্ম
গ্যাসীয় অবস্থায় গ্যাসের অনুগুলির সংসক্তি ধর্ম অর্থাৎ পরস্পরকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা অনেক কমে যায়। ফলে, অনুগুলির মধ্যে আণবিক ব্যবধান এত বেড়ে যায় যে, গ্যাসের আয়তনের তুলনায় অনুগুলির মোট আয়তন একেবারে নগণ্য হয়। আন্তঃআণবিক ব্যবধান খুব বেশি হওয়ার জন্য আকর্ষণ ক’রে অণুগুলোকে একত্রিত করার ক্ষমতা গ্যাসের নেই। সেই জন্য সব গ্যাসই প্রসারণশীল। এই ধর্মের ফলে গ্যাসের কোন নির্দিষ্ট আকার ও আয়তন নেই। ছোট-বড় যে পাত্রে রাখা হয় না কেন গ্যাসটি ওই পাত্রের আকার ও আয়তন ধারণ করে।
২. সংকোচনশীলতা
উষ্ণতা স্থির রেখে গ্যাসের উপর যদি চাপ প্রয়োগ করা হয় তাহলে গ্যাসের অনুগুলির পরস্পরের কাছে সরে আসে। হলে গ্যাসের আয়তন সংকুচিত হয়। আবার চাপ স্থির রেখে উষ্ণতা কমালে গ্যাসের অনুগুলির মধ্যে পরস্পরের দূরত্ব কমে আসে, হলে আয়তন সংকোচন হয়। সংকোচনশীলতা গ্যাসীয় পদার্থের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম।
৩. গ্যাসের চাপ
গ্যাসের অনুগুলির মধ্যে পারস্পারিক আকর্ষন নেই বলে অনুগুলির দ্রুতবেগে ইতস্তত ঘুরে বেড়ায়। তাই দেখা যায়, কোন পাত্রের মধ্যে গ্যাস রাখলে গ্যাসটি সমগ্র পাত্রের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। গ্যাসের অনুগুলির সর্বদা গতিশীল এবং অনুগুলির বেগ খুব বেশি। বাতাসের অনুগুলির গড় বেগ প্রায় 400 মিটার/সেকেন্ড। অনুগুলির বেগের কারণে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে আবার ফিরে আসে। কিন্তু এর ফলে ওই অনুগুলির গতির বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয় না, অর্থাৎ গতিবেগ একই থাকে। ফলে গ্যাসের অনুগুলির মধ্যে সবসময় গতিশক্তি বর্তমান থাকে। সেই কারণে দেয়ালের উপর অনবরত আঘাত হানতে থাকে এবং পাত্রের দেওয়ালে চাপের সৃষ্টি হয়; একেই গ্যাসীয় চাপ বলে।
অনুগুলির গতি যদি কোনো কারণে বেড়ে যায় তাহলে পাত্রের দেয়ালেও চাপ বেড়ে যাবে। এই কারণে গ্যাসকে আবদ্ধ পাত্রে রাখতে হয় না হলে অণুর গতির জন্য ওই গ্যাসটি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। গ্যাসের অনুগুলির গতির মান উষ্ণতার উপর নির্ভর করে। উষ্ণতা বাড়লে অনুগুলির গতির মান বেড়ে যায়।
একটা পাত্রে কোন গ্যাসকে আবদ্ধ রেখে অর্থাৎ আয়তন স্থির রেখে যদি ওর উষ্ণতা বাড়ানো হয়, তাহলে অনুগুলির গতি বেড়ে যায় তখন আগের চেয়ে আরো বেগে অনুগুলি গিয়ে পাত্রের দেয়ালে ধাক্কা দেয় ফলে চাপ আরো বেড়ে যায়। আবার চাপকে স্থির রাখা হলো তাহলে অনুগুলির ধাক্কায় গ্যাসের আয়তন বেড়ে যায়।
৪. গ্যাসের উপর চাপের প্রভাব
স্থির উষ্ণতায় কোন গ্যাসের উপর চাপ প্রয়োগ করলে গ্যাসের অনুগুলি পরস্পরের কাছে সরে আসে এবং ঘন সন্নিবিষ্ট হয় গ্যাসের ঘনত্ব বাড়ায় কিন্তু আয়তন কমে যায়
৫. গ্যাসের উপর উষ্ণতার প্রভাব
স্থির চাপে তাপের প্রভাবে কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় – সব পদার্থের আয়তন পরিবর্তিত হয়। কঠিন ও তরলের ক্ষেত্রে আয়তন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। আবার এটাও লক্ষ্য করা যায় যে, বিভিন্ন রকম কঠিন বা তরলের আয়তন একই উষ্ণতার প্রভাবে সমভাবে পরিবর্তিত হয় না। এই আয়তন পরিবর্তন ওদের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে। কিন্তু স্থির চাপে একই উষ্ণতা বৃদ্ধিতে প্রত্যেক গ্যাসের আয়তন একই মাত্রায় বাড়ে, আবার একই উষ্ণতা হ্রাসে প্রত্যেক গ্যাসের আয়তন একই মাত্রায় কমে। তাই গ্যাসের উপর উষ্ণতার প্রভাব বিস্তার করাটা গ্যাসের ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়।
৬. ব্যাপন হল গ্যাসের ধর্ম
ঘরের এক কোণে সুগন্ধি ধূপ জ্বালালে ওই ধুপের গন্ধ সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। এ কারণ হলো গ্যাসের ব্যাপন।
পরস্পর বিক্রিয়া করে না এমন কতগুলি গ্যাস একসঙ্গে মেশালে ওরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরস্পরের সঙ্গে মিশে গিয়ে সমসত্ব একটি মিশ্রণ উৎপন্ন করে। গ্যাস গুলির পরস্পরের মধ্যে এই ভাবে মিশে যাওয়ার ধর্মকে ব্যাপন ধর্ম বলে।
৭. ঘনত্ব গ্যাসের একটি বৈশিষ্ট্য
কঠিন পদার্থ বা তরল পদার্থের চেয়ে গ্যাসের ঘনত্ব অনেক কম হয়। গ্যাসের প্রসারণশীলতার জন্য এরকম ঘটে। গ্যাসের ঘনত্বের এই বিশেষত্ব গ্যাসের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য।
৮. ভর হল গ্যাসের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য
সমস্ত পদার্থের মত গ্যাসের ভর আছে।
৯. গ্যাসের ভৌত ধর্ম
বিভিন্ন গ্যাসের মধ্যে রাসায়নিক ধর্ম এবং প্রকৃতিগত পার্থক্য থাকলেও মৌলিক বা যৌগিক সব গ্যাসের ভৌত ধর্ম এক রকম হয়।
উপরের ন’টি পয়েন্টকে গ্যাসের ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য হিসাবে উল্লেখ করা যেতে পারে।
গ্যাসের চাপের পরিমাপ
পৃথিবীর উপর বিভাগে অবস্থিত ভাসমান গ্যাস সর্বদা পৃথিবীর উপরে অভিকর্ষ বলের প্রভাবে একটি চাপের সৃষ্টি করে। বায়ু পৃথিবীপৃষ্ঠের একটি নির্দিষ্ট স্থানে একক ক্ষেত্রফলের উপর যে চাপ প্রয়োগ করে, তাকে ওই স্থানের বায়ুচাপ বলা হয়।
উল্লেখ থাকে যে বায়ুমন্ডলের চাপ পরিমাপ করা হয় ব্যারোমিটার যন্ত্রের সাহায্যে এবং ব্যারোমিটারে সাধারণতঃ বায়ুর চাপ থাকে 76 সেন্টিমিটার পারদস্তম্ভের উচ্চতার সমান।
76 সেন্টিমিটার পারদস্তম্ভ উচ্চতা বলতে বোঝায়, ভূপৃষ্ঠের উপর বায়ুর চাপ কোন একটি নির্দিষ্ট স্থানে 1 বর্গ সেন্টিমিটারের উপর 1 বর্গ সেন্টিমিটার প্রস্থচ্ছেদ বিশিষ্ট এবং 76 সেন্টিমিটার উচ্চতা বিশিষ্ট পারদের চাপের সমান।
76 সেন্টিমিটার পারদস্তম্বের চাপ = পারদ স্তম্ভের উচ্চতা × ঘনত্ব × অভিকর্ষজ ত্বরণ
= 76 × 13.6 × 980 ডাইন বর্গ সেন্টিমিটার = 1.013 × 10⁶ ডাইন/বর্গ সেন্টিমিটার
আন্তর্জাতিক পদ্ধতিতে চাপের একক হল পাসকেল = নিউটন/বর্গ মিটার
76 সেন্টিমিটার পারদ স্তম্বের চাপ= 1 অ্যাটমোসফিয়ার চাপ =1.013 × 10 পাসকেল।
গ্যাসের প্রমাণ চাপ ও উষ্ণতা
গ্যাসের আয়তন মাপার ক্ষেত্রে 0 ডিগ্রী সেলসিয়াস উষ্ণতায় প্রমাণ উষ্ণতা এবং 76 সেন্টিমিটার পারদস্তম্বের চাপকে প্রমাণ চাপ বলে ধরা হয়।
76 সেন্টিমিটার পারদ স্তম্বের চাপ = এক বায়ুমন্ডল চাপ। এনটিপিতে একটি গ্যাসের আয়তন 20 ঘণসেন্টিমিটার বলতে বোঝায় যে 0 ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতায় 76 সেন্টিমিটার চাপে গ্যাসের আয়তন 20 ঘন সেন্টিমিটার।
বায়ুমন্ডলের চাপ এবং উষ্ণতার পরিবর্তন সব সময় হয়। গ্যাসের আয়তনও চাপ এবং উষ্ণতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। সেই জন্য বিভিন্ন গ্যাসের আয়তন মাপার সময় অবশ্যই চাপ এবং উষ্ণতার উল্লেখ করতে হয় এবং আয়তন তুলনা করার সময় আয়তনগুলিকে প্রমাণ চাপ উষ্ণতায় আনা হয়।