দ্রবণ | দ্রবণের বৈশিষ্ট্য ও প্রকার | দ্রাব ও দ্রাবক

2
1827

দ্রবণ

এই অধ্যায়ে আমরা জানবো দ্রবণ কি, দ্রবণের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য, দ্রাব, এবং দ্রবণের প্রকার।
একা জলে এক চামচ চিনি যোগ করলে চিনি জলে অদৃশ্য হয়ে যায়। এখানে তিনি জলে দ্রবীভূত হয় একটি সমসত্ব মিশ্রণ উৎপন্ন করে। এই মিশ্রণ থেকে ওই চিনিকে আবার ফিরে পাওয়া যায় – জলকে বাষ্পীভূত করে দূর করলে। 1 কাপ চিনি মেশানো জলের উপরের অংশ থেকে বা মাঝের অংশ থেকে কিংবা তলার অংশ থেকে এক চামচ করে তুলে নিলে দেখা যাবে সব ক্ষেত্রেই সমান মিষ্টি। এ থেকে বোঝা যায় যে, চিনি জলে দ্রবীভূত হয়ে সমসত্ব মিশ্রণে পরিণত হয়েছে। যে তিনি যোগ করতে হবে, তা একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত বাড়ানো যায়। এই ভাবে চিনি ও জলের যে সমসত্ব মিশ্রণ উৎপন্ন হয় তাকেই দ্রবন বলে। সমসত্ব দ্রবণের প্রতি অংশের ঘনত্ব সমান হয়।

দ্রবণ এর সংজ্ঞা:

দুই বা ততোধিক পদার্থের সমসত্ব মিশ্রণের প্রতিটি অংশের উপাদান,গঠন এবং ধর্ম যদি একই থাকে এবং উপাদানগুলির আপেক্ষিক অনুপাত যদি একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত বাড়ানো যায়, তাহলে ওই মিশ্রণকে দ্রবন বলে।

দ্রবণের প্রতি অংশের গঠন, ভৌত ধর্ম এবং রাসায়নিক ধর্ম একই রকম হয়। দ্রবণের দুটি অংশ থাকে-দ্রাব (Solute), এবং দ্রাবক (Solvent) । দ্রাব এবং দ্রাবক এর সমসত্ব মিশ্রণ হল দ্রবণ।

১. দ্রাব কাকে বলে:

দ্রবণের মধ্যে যে পদার্থটি কম পরিমাণে থাকে, এবং যে পদার্থকে অন্য কোন (কঠিন তরল ও গ্যাসীয়) পদার্থে মেশালে পদার্থটি মিশে একটি সমসত্ব মিশ্রণ উৎপন্ন করে তাকে দ্রাব বলে। চিনি, লবণ, তুঁতে প্রভৃতি জলে দ্রবীভূত হয় সমসত্ব মিশ্রণ উৎপন্ন করে। এখানে চিনি, তুঁতে, লবণ হলে দ্রাব।

২. দ্রাবক কাকে বলে:

দ্রবণের মধ্যে যে উপাদানের পরিমাণ বেশি থাকে এবং দ্রবণের ভৌত অবস্থা উপাদানটির ভৌত অবস্থার মতো হয়, সেই উপাদানটিকে দ্রাবক বলে।
যেমন উপরের উদাহরণে জল একটি দ্রাবক।

দ্রবণের প্রকার

  • ভৌত অবস্থার উপর ভিত্তি করে দ্রবণকে মোটামুটি ছয় ভাগে ভাগ করা যায়।
  • ক) তরলে কঠিনের দ্রবণ:
  • তরল দ্রাবকের মধ্যে কঠিন দ্রাব মেশালে কঠিন পদার্থের সমসত্ব দ্রবণ উৎপন্ন হয়। জলের মধ্যে চিনি, তুঁতে, লবণ ইত্যাদি মেশালে এইরকম দ্রবণ উৎপন্ন হয়। কার্বন ডাই সালফাইডে সালফার, ফসফরাস দ্রবীভূত হয়ে একই রকম দ্রবণ সৃষ্টি করে। মোম, রবার ইত্যাদি কার্বন টেট্রাক্লোরাইডে এবং গালা ও নানাবিধ রজন অ্যালকোহলের দ্রবীভূত হয় অ্যাসিটোন, ক্লোরোফরম , বেনজিন, পেট্রোল ইত্যাদি দ্রাবকরূপে ব্যবহৃত হয়।
  • খ) তরলে তরলের দ্রবণ:
  • তরলের মধ্যে তরল দ্রবীভূত হয়ে যে সমসত্ব মিশ্রণ পাওয়া যায়, তাকে তরলের তরলের দ্রবন বলে। জলের মধ্যে অ্যালকোহল বা গ্লিসারিন মেশালে এই জাতীয় দ্রবণ উৎপন্ন হয়।
  • গ) তরলে গ্যাসের দ্রবণ:
  • জলের মধ্যে জলে দ্রাব্য গ্যাস,যেমন এমোনিয়া, কার্বন ডাই অক্সাইড, হাইড্রোজেন ক্লোরাইড, সালফার-ডাই-অক্সাইড প্রকৃতিক গ্যাস বিভিন্ন পরিমাণে মেশালে তরলে গ্যাসের দ্রবন তৈরি হয়। সোডা ওয়াটার হল জলে দ্রবীভূত কার্বন-ডাই-অক্সাইডের দ্রবণ। অক্সিজেন গ্যাস জলে সামান্য দ্রবীভূত হয়। চাপ বাড়ালে তরলে গ্যাসের দ্রবীভূত হওয়ার ক্ষমতা বাড়ে।
  • ঘ) গ্যাসে গ্যাসের দ্রবণ:
  • একটি গ্যাসের সঙ্গে অন্য কোন গ্যাস (পরস্পর বিক্রিয়া না ঘটলে) মিশিয়ে গ্যাসের দ্রবণ প্রস্তুত করা হয়। বায়ু এইরকম মিশ্রণের উদাহরণ।
  • ঙ) কঠিন কঠিনের দ্রবণ:
  • দুটি কঠিন ধাতু সমসত্ব ভাবে মিশে যে মিশ্র ধাতু উৎপন্ন করে তাকে কঠিন দ্রবন বলে। যেমন তামা ও দস্তা মিশে পিতল উৎপন্ন করে। তামা ও টিনের মিশে কাসা উৎপন্ন করে।
  • চ) কঠিনে গ্যাসের দ্রবণ:
  • প্যালাডিয়াম নিকেল ইত্যাদি কতগুলি ধাতু উত্তপ্ত অবস্থায় হাইড্রোজেন গ্যাস শোষণ করে যে সমসত্ব মিশ্রণ উৎপন্ন করে তাকে কঠিনে গ্যাসের দ্রবন বলে।

পরিবর্তনশীল যোজ্যতা বা যোজনী

দ্রবণের বৈশিষ্ট্য

দ্রবণের নিচের বৈশিষ্ট্যগুলি থাকবেই

  • দ্রবণ সর্বদা সমসত্ব হবে,অর্থাৎ দ্রবণের সব অংশের ভৌত ধর্ম এবং গঠন একই হবে।
  • দ্রবণের মধ্যে দ্রাবের কণাগুলি খালি চোখে দেখা যাবে না। এমনকি খুব শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যেও কনা গুলিকে দেখা যাবে না।
  • পরিস্রাবণ প্রক্রিয়া দ্বারা দ্রাবকে দ্রবন থেকে পৃথক করা যাবে না।
  • দ্রবণ কে স্থিরভাবে অনেকক্ষণ রেখে দিলেও দ্রাবের কণাগুলি কখনো থিতিয়ে পড়বে না।।
  • ভৌত পদ্ধতিতে (বাষ্পীভবন, কেলাসন) দ্রাব এবং দ্রাবক পৃথক করা যায়।যেমন পড়লে কঠিন এর দ্রবণে তাপ দিলে তরল দ্রাবক বাষ্পীভূত হয়ে চলে যায় এবং কঠিন দ্রাব পৃথক হয়ে পড়ে।
  • তরলের তরল দ্রবণের আংশিক পাতন করে তরল দুটিকে পৃথক করা যায়।
  • দ্রবণ প্রস্তুতির সময় তাপ উৎপন্ন বা তাপ শোষিত হতে পারে, আবার নাও হতে পারে।
  • কোন কঠিন এর জলীয় দ্রবণের বর্ণ, দ্রাবের বর্ণের মত হয়; যেমন তুতের বর্ণ নীল, তাই এর জলীয় দ্রবণের বর্ণ নীল।
  • দ্রবণের উষ্ণতা পরিবর্তন করে দ্রবণে দ্রাবকের পরিমাণ পরিবর্তন করা যায়।
  • তরলে গ্যাসের দ্রবন বা কঠিন এ গ্যাসের দ্রবণ কে উত্তপ্ত করলে গ্যাস পৃথক হয়ে যায়।

অক্সিজেনের ধর্ম ও ব্যবহার

কলয়ডীয় দ্রবণ কি?

কোন পদার্থের (দ্রাব) কণার ব্যাস 10-8 থেকে 10-7 সেন্টিমিটার হলে, পদার্থটির সূক্ষ্ম কণাগুলি দ্রাবকের মধ্যে দ্রবীভূত না হয় প্রলম্বিত থেকে ইতস্তত ঘুরে বেড়ায়। এই সুক্ষ কনা গুলিকে ফিল্টার পেপার দ্বারা পৃথক করা যায় না। কারণ এরা ফিল্টার পেপারের ছিদ্র অতিক্রম করে। কিন্তু পার্চমেন্ট পেপারের মধ্যে দিয়ে বের হতে পারে না। এইভাবে উৎপন্ন অদ্রাব্য দ্রাবের অস্বচ্ছ এবং অসমসত্ত্ব মিশ্রণকে কলয়েড দ্রবণ বল।
যেমন ভাতের ফ্যান হলো জলের মধ্যে চালের সুক্ষ কনা দ্বারা সৃষ্ট কলয়েডীয় দ্রবণ।

চিনি জলে দ্রবীভূত হয় অথচ চকের মিহি গুঁড়ো জলে দ্রবীভূত হয় না কেন

দ্রাবের কণার আকারের ওপর ওর দ্রাব্যতা নির্ভর করে। দ্রাবের কণার ব্যাস 10-4 সেন্টিমিটার এর মধ্যে হলে দ্রাবের কণাগুলি দ্রাবকে ঘনীভূত হয় না। দ্রাবের কনার ব্যাস 10-8 সেন্টিমিটার বা তার কম হলে সেটি দ্রাবকে দ্রবীভূত হয়। জলের মধ্যে চিনির কণার ব্যাস 10-8 সেন্টিমিটার, হয় বলে চিনির কণাগুলি জলে দ্রবীভূত হয়। চকের সুক্ষ কনা গুলির ব্যাস 10-4 সেন্টিমিটার বা তার চেয়ে বেশী থাকে বলে চকের গুঁড়ো জলে দ্রবীভূত হয় না।

জলকে সার্বজনীন দ্রাবক বলা হয় কেন

জল একটি উত্তম দ্রাবক। এর কারণ হলো বেশিরভাগ কঠিন, তরল ও গ্যাসীয় পদার্থ জলে দ্রবীভূত হয়ে দ্রবণ উৎপন্ন করে।
জল ছাড়া অন্যান্য দ্রাবকও আছে, যেমন অ্যালকোহল, ইথার, বেনজিন, কার্বন ডাই সালফাইড, ক্লোরোফরম ইত্যাদি। সালফার, কার্বন ডাই সালফাইডে দ্রাব্য কিন্তু জলে অদ্রাব্য। তেল, চর্বি, ক্লোরোফর্মে দ্রবীভূত হয়। তাই জলকে সার্বজনীন দ্রাবক বলা হয়

দ্রাব্যতা ও দ্রাব্যতার উপর উষ্ণতার প্রভাব

2 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here