প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিক কণাদ পরমাণুর কল্পনা করেন। প্রাচীন ভারতে জগতকে প্রথম পরমাণুর কথা জানায়। এরপর গ্রিক দার্শনিক ডেমোক্রিটাসের লেখা থেকে পরমাণুর কথা জানতে পারা যায়। কণাদের মতে, পদার্থের অতি ক্ষুদ্র কণা গুলি হল পরমাণু এবং ডেমোক্রিটাস এই কণার নাম দেন অ্যাটম। 1803 খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী জন ডালটন প্রকৃতির মধ্যে যে মৌলিক পদার্থ গুলি আছে সেগুলি পরমাণু দ্বারা গঠিত, মৌলিক পদার্থের এই পরমাণু গুলির পরিচয়, ধর্ম এবং কিভাবে বিভিন্ন মৌলিক পদার্থের এই পরমাণু গুলি পরস্পর যুক্ত হয়ে যৌগিক পদার্থ উৎপন্ন করে, পরমাণুর গঠন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক মত প্রকাশ করেন যা ‘ডাল্টনের পরমাণুবাদ’ নামে পরিচিত। ওই সময় পদার্থের অণুর সম্পর্কে বৈজ্ঞানিকদের বিশেষ কোন ধারণা ছিল না। 1811 সালে বিজ্ঞানী অ্যাভোগাড্রো সর্বপ্রথম অণু ও পরমাণুর মধ্যে সুস্পষ্ট সম্পর্কের কথা জানতে পারেন।
ডাল্টনের পরমাণুবাদ
রাসায়নিক সংযোগ সূত্রগুলির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে 1803 খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী ডাল্টন বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়া থেকে পাওয়া ফলের ভিত্তিতে পরমাণু সম্পর্কে স্পষ্ট অভিমত প্রকাশ করেন। একে ডাল্টনের পারমাণবিক তথ্য বা ডাল্টনের পরমাণুবাদ বলে অভিহিত করা হয়। এই পরমাণুবাদের ওপর নির্ভর করেই আধুনিক পরমাণু বিজ্ঞান করে উঠেছে।
ডাল্টনের পারমাণবিক তত্ত্ব ডাল্টনের পরমাণুবাদের মূল বক্তব্য
১. প্রত্যেক মৌলিক পদার্থ অসংখ্য অবিভাজ্য ও অতিক্ষুদ্র নিরেট কলা দিয়ে গঠিত। এই ক্ষুদ্রতম কণাকে পরমাণু বলে।
পরমাণু গুলো এত ছোট যে এদের আয়তন কল্পনাও করা যায় না। একটি হাইড্রোজেন পরমাণুর ওজন 1.67×10-24 গ্রাম। একটা হাইড্রোজেন পরমাণুর ব্যাস 12×10-9 সেন্টিমিটার।
২. পরমাণুগুলোকে রাসায়নিক প্রক্রিয়া দ্বারা ভাঙা যায় না, সৃষ্টি করা যায় না বা ধ্বংস করা যায় না। কোন প্রক্রিয়া দ্বারা পরমাণুগুলির আকার, ওজন বা ধর্মের পরিবর্তন করা যায় না। পরমাণু অবিভাজ্য এবং অবিনশ্বর।
৩. একই মৌলিক পদার্থের পরমাণুর ভর ও ধর্ম অভিন্ন হয়।
এই তথ্য অনুযায়ী হাইড্রোজেনের সমস্ত পরমাণুর ওজন ও ধর্ম সর্বতোভাবে একরকম হবে। ঠিক তেমনি কপার এর প্রত্যেকটি পরমাণুর ধর্ম ও ভর একই রকম হবে।
৪. বিভিন্ন মৌলিক পদার্থের পরমাণুর ভর এবং ধর্ম আলাদা।
ভিন্ন ভিন্ন মৌল যেমন হাইড্রোজেন পরমাণুর ভর এবং ধর্ম যা হবে, অক্সিজেন পরমাণু গুলির ওজন ও ধর্ম তা হবে না,– ভিন্ন হবে।
৫. বিভিন্ন মৌলিক পদার্থের পরমাণু গুলি পূর্ণ সংখ্যার অনুপাতে পরস্পর যুক্ত হয়ে যৌগিক পদার্থ উৎপন্ন করে। পরমাণু অবিভাজ্য বলে কখনও ভগ্নাংশে যুক্ত হয় না।
যেমন জল যৌগিক পদার্থ। জলে হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন পরমাণুর সংখ্যার অনুপাত 2:1। এটি পুর্নসংখ্যা সরল অনুপাত।
কার্বন ডাই অক্সাইডে কার্বন এবং অক্সিজেনের পরমাণু সংখ্যার অনুপাত 1:2 সালফিউরিক এসিডের অণুর মধ্যে হাইড্রোজেন, সালফার এবং অক্সিজেন পরমাণুর সংখ্যার অনুপাত 2:1:4 এগুলি সবই পূর্ণ সংখ্যার সরল অনুপাত।
প্রকৃতিতে 105 রকম মৌল আছে। সুতরাং 105 রকম পরমাণু আছে। 105 রকম পরমাণু নানাভাবে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয় অসংখ্য যৌগ উৎপন্ন করেছে।
ডাল্টনের পরমাণুবাদের ব্যাখ্যা
যে কোন উৎস থেকে হাইড্রোজেন মৌলটি কে সংগ্রহ করা হোক না কেন, মৌলটি একই ভর ও ধর্ম বিশিষ্ট পরমানু সমন্বয়ে গঠিত হবে। এইভাবে অক্সিজেন মৌলের প্রতিটি পরমাণু একই ভর ও একই ধর্ম বিশিষ্ট। কিন্তু হাইড্রোজেন পরমাণুর ভর এবং ধর্ম, অক্সিজেন পরমাণুর ভর এবং ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কোন রাসায়নিক বিক্রিয়ার সাহায্যে হাইড্রোজেন অক্সিজেন মৌলের পরমাণুকে সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না।
আবার হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন মৌলিক পদার্থ দুটির পরমাণু পরস্পর রাসায়নিক বিক্রিয়া করে জল যৌগটি উৎপন্ন করে। বিক্রিয়াটিতে দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু একটি অক্সিজেন পরমাণুর সঙ্গে যুক্ত হয়ে এক অনু জল গঠন করে। অতএব জল গঠনে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন পরমাণুর সংখ্যার অনুপাত হল 2:1। এটি একটি সরল অনুপাত—অর্থাৎ, যৌগ গঠনে বিক্রিয়াকারী পরমাণুগুলি পরস্পর পূর্ণ সংখ্যার সরল অনুপাতে যুক্ত হয়।
ডাল্টনের পরমাণুবাদের গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তা বা তাৎপর্য
ডাল্টনের পারমাণবিক তথ্য রসায়নকে সুসংবদ্ধ বিজ্ঞান হিসেবে রূপদান করতে সমর্থ হয়েছে। কিভাবে মৌলিক ও যৌগিক পদার্থ গঠিত হয়, বিভিন্ন মৌলিক পদার্থ ও যৌগিক পদার্থের ধর্মের পার্থক্য আছে কেন, কিভাবে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে এগুলি ডাল্টনের পরমাণুবাদ ব্যাখ্যা করে।
১. ডাল্টনের পরমাণুবাদেই সর্বপ্রথম মৌলিক পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা হিসেবে পরমানুর ধারনা করা হয়।
২. ডাল্টনের পরমাণুবাদ দ্বারা পদার্থের নিত্যতা সূত্র এবং অন্যান্য রাসায়নিক সংযোগ সূত্রগুলি প্রমাণ করা সম্ভব হয়েছে।
৩. বিভিন্ন মৌলিক পদার্থের পরমাণুগুলো কিভাবে নিজেদের মধ্যে যুক্ত হয়ে যৌগিক পদার্থ গঠন করে তার ডাল্টনের পরমাণুবাদ থেকেই সর্বপ্রথম জানা যায়।
৪. বিভিন্ন মৌলিক পদার্থের পরমাণুর ওজন এবং ধর্ম সুনির্দিষ্ট। পরমাণুবাদের এই সিদ্ধান্ত রাসায়নিক বিক্রিয়া গুলিকে সমীকরণের সাহায্যে সংক্ষেপে প্রকাশ করতে সাহায্য করে।
৫. ডাল্টনের পরমাণুবাদ পরমাণুর কল্পনাকে আশ্রয় করে পরবর্তীকালে অ্যাভোগাড্রো অনুর কল্পনা করতে সমর্থ হন। পরমাণুবাদের উপর ভিত্তি করেই অ্যাভোগাড্রো প্রকল্প রচিত হয়।
৬. বর্তমানে ডাল্টনের পরমাণুবাদ এবং অ্যাভোগাড্রো প্রকল্পের উপর নির্ভর করে সমস্ত রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলির ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছে।
৭. এই তত্ত্বের সাহায্যে রাসায়নিক সংযোগ থেকে বিভিন্ন মৌলের পরমাণু দ্বারা কিভাবে বিভিন্ন ধরনের যৌগ গঠিত হয় তা ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছে।
৮. পরমাণুবাদের সাহায্যে বিভিন্ন মৌলের পরমাণুর আপেক্ষিক ওজনরূপে মৌলিক পদার্থের পারমানবিক ওজন নির্ণয় করার পদ্ধতি আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে।
৯. এই পরমাণু তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই পরমাণুর গঠন সম্পর্কিত আধুনিক ধারণা টি গড়ে উঠেছে।
১০. ডাল্টনের পরমাণুবাদের সাহায্যে ওজন সংক্রান্ত বিভিন্ন রাসায়নিক সংযোগ সূত্রকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়েছে।
ডাল্টনের পরমাণুবাদের অসম্পূর্ণতা বা ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতা
পদার্থের আরেকরকম কনা অর্থাৎ অনু সম্বন্ধে ডাল্টনের কোন ধারণা ছিল না । তাই ডাল্টনের পরমাণুবাদের মধ্যে অনেক ত্রুটি থেকে যায়। যথা
১. মৌলিক পদার্থের অন্তিম কণাটি হল পরমাণু, পরমাণু অবিভাজ্য, ডাল্টনের এই সিদ্ধান্ত বর্তমানকালের সঠিক নয় বলে প্রমাণিত হয়েছে। এখন জানা গেছে যে, পরমাণু, নেগেটিভ তড়িৎ গ্রস্ত কণা ইলেকট্রন, পজিটিভ তড়িৎগ্রস্ত কণায় প্রোটন, নিস্তড়িত কণা নিউট্রন এবং আরো কয়েকটি আদি কণা দ্বারা গঠিত। কিন্তু সাধারণ অবস্থায় কিংবা রাসায়নিক বিক্রিয়ায় মৌলের পরমাণু অবিভাজ্য করার মতোই ব্যবহার করে।
২. পরমাণুর কেন্দ্র বা নিউক্লিয়াসের অংশ রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অবিভাজ্য থাকে। কিন্তু পরমাণুর বাইরের অংশ ইলেকট্রন মহলে, ইলেকট্রনের আদান-প্রদান ঘটে বা একজোড়া ইলেকট্রন সমভাবে ব্যবহার করে বাইরের কক্ষে ইলেকট্রনগুলি রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। এইভাবে একটি পরমাণু থেকে ইলেকট্রন বর্ধিত হলে বা কোন পরমাণুতে ইলেকট্রন গৃহীত হলে পরমাণুর পূর্বের ভরের পরিবর্তন হয়। তবে ইলেকট্রনের ভর নগণ্য বলে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় পরমাণুর ওজন এর বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয় না।
৩. একই মৌলের পরমাণুগুলি ওজনে এবং ধর্মে অভিন্ন বলে ডালটন যে সিদ্ধান্ত করেন সেটি সঠিক নয়। আইসোটোপ আবিষ্কার এর পর জানা গেছে যে, একই মৌলিক পদার্থের বিভিন্ন ওজন এবং বিভিন্ন ভৌত ধর্ম বিশিষ্ট পরমানু থাকতে পারে। যেমন হাইড্রোজেনের তিন রকম পরমাণু (আইসোটোপ) পাওয়া যায়। এদের পারমাণবিক ওজন যথাক্রমে 1,2 এবং 3। আবার কার্বনের তিন রকম পরমাণু পাওয়া যায় যাদের পারমাণবিক ওজন যথাক্রমে 12, 13 ও 14।
কাজেই ডাল্টনের পরমাণুবাদের সামান্য সংশোধন করে বলা যেতে পারে,
একই মৌলিক পদার্থের বিভিন্ন আইসোটোপ গুলোর পারমাণবিক ওজন এবং ভৌত ধর্ম বিভিন্ন হয়। কিন্তু একই মৌলিক পদার্থের একই রকম আইসোটোপের প্রতিটি পরমাণুর ওজন এবং ধর্ম এক রকমের হয়।
৪. ডালটন পরমাণুর কল্পনা করেন বটে, কিন্তু মৌলিক বা যৌগিক অণু ও কল্পনা তিনি করতে পারেননি। এইজন্য যৌগের ক্ষুদ্রতম কণাকেও তিনি পরমাণু বলে ধরেন। অ্যাভোগাড্রো সর্বপ্রথম অনুর কল্পনা করেন। যা পরবর্তীকালে জানা যায় যে, যৌগের ক্ষুদ্রতম কণা হলো অনু।
৫. বিভিন্ন মৌলের পারমাণবিক ওজন বিভিন্ন–ডাল্টনের এই তত্ত্বটি ঠিক নয়। একই পারমাণবিক ওজন বিশিষ্ট বিভিন্ন পরমাণু আছে। এদেরকে আইসোবার বলে। যেমন ক্যালসিয়ামের পারমাণবিক ওজন 40 আবার আর্গনেরও পারমাণবিক ওজন 40।
৬. বর্তমানে ইউরেনিয়ামের মত তেজস্ক্রিয় মৌলের পরমাণু বিশেষ প্রক্রিয়ায় নিজে থেকেই ভেঙে লঘুতর পারমাণবিক ওজন বিশিষ্ট একাধিক নতুন পরমাণুর সৃষ্টি হয়। আবার অতি উচ্চ উষ্ণতায় হাইড্রোজেন এর মত হালকা মৌলকে সংযোজিত করে নতুন মৌলের পরমাণু গঠন করা যায়। সুতরাং পরমাণু অবিভাজ্য নয় একে ভাঙা যায় বা সৃষ্টি করা যায়।
৭. এছাড়া পরমাণুর নিউক্লিয়াস ও কক্ষপথে থাকা ইলেকট্রনের মধ্যে যথেষ্ট ফাঁকা স্থান রয়েছে অর্থাৎ পরমাণুর নিরেট কণিকা নয়।
৮. গে লুসাকের গ্যাস আয়তন সূত্রটি ডাল্টনের পারমাণবিক তত্ত্বের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায় না।
ডাল্টনের পরমানুবাদ সম্পর্কিত প্রশ্নোত্তর
মৌলিক পদার্থের পরমাণুর ওজন ও ধর্ম এবং রাসায়নিক বিক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে ডাল্টনের পরমাণুবাদের স্বীকার্য বিষয় দুটি কি কি
একই মৌলের পরমাণুর ওজন ধর্ম এবং রাসায়নিক বিক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে ডাল্টনের পরমাণুবাদের স্বীকার্য বিষয় দুটি হল
১. একটি নির্দিষ্ট মৌলিক পদার্থের পরমাণুর ওজন এবং রাসায়নিক ধর্ম একই রকমের কিন্তু বিভিন্ন মৌলিক পদার্থের পরমাণুর ভর ও ধর্ম আলাদা।
২. রাসায়নিক বিক্রিয়ার সময় বিভিন্ন মৌলিক পদার্থের পরমাণুগুলো পূর্ণ সংখ্যার অনুপাতে যুক্ত হয়ে যৌগ গঠন করে।
ডাল্টনের পরমাণুবাদ কত সালে প্রকাশিত হয়
ডাল্টনের পরমাণুবাদ 1803 সালে প্রকাশিত হয়
ইমেজ সোর্স ঃ Britannica.com