সুপ্রাচীন কাল থেকে ব্যবহার হওয়া ধাতুগুলির মধ্যে অন্যতম ধাতু তামা বা কপার। খুব বেশি না হলেও অল্পমাত্রায় প্রকৃতিতে মুক্ত অবস্থায় কপার পাওয়া যায়। রাশিয়ার সাইবেরিয়া এবং ইউরাল পর্বত অঞ্চল থেকে প্রাকৃতিকভাবে মুক্ত অবস্থায় কপার পাওয়া যায়। এছাড়াও বিভিন্ন যৌগ হিসাবে খনিজ পদার্থের সঙ্গে কপার বিদ্যমান থাকে।
তামা বা কপারের উল্লেখযোগ্য খনিজ
তামা বা কপারের উল্লেখযোগ্য খণিজ গুলো হলো কপার পাইরাইটিস বা চালকোপাইরাইটিস, কপার গ্লাস বা চালকোসাইট, কিউপ্রাইট, ম্যালাকাইট এবং অ্যাজুরাইট। এর মধ্যে দুটি আকরিক থেকেই মূলত কপার নিষ্কাশন করা হয় যথা কপার পাইরাইটিস বা চালকোপাইরাইটিস এবং কিউপ্রাইট। এদের মধ্যে কপার সালফেট বা কপারপাইরাইটিস থেকে অধিকাংশ কপার নিষ্কাশন করা হয়।
কপার বা তামার খনিজ
যৌগ | খনিজ পদার্থের নাম |
সালফাইড | কপার গ্লান্স বা চালকোসাইট Cu2S কপার পাইরাইটিস বা চালকোপাইরাইটিস 2CuFeS2 |
অক্সাইড | কিউপ্রাইট Cu2O মেলাকোনাইট CuO |
কার্বনেট | আজুরাইট 2CuCO3 , Cu(OH)2 ম্যালাকাইট CuCO3 , Cu(OH)2 |
কিভাবে কপার নিষ্কাশন করা হয়
কপারের প্রধান আকরিক হল কপার পাইরাইটিস যা থেকে অধিকাংশ তামা নিষ্কাশন করা হয়।
১.প্রথমে বিচূর্ণ তামা পাইরাইটিসকে তৈলভাসণ পদ্ধতিতে গাঢ়ীকরণ করা হয়।
২. গাঢ়ীকৃত আকরিককে তাপজারণ এবং পরে সিলিকা ও কোকসহ বিগলন করলে কিউপ্রাস সালফাইড ও আয়রন সালফাইডের মিশ্রন পাওয়া যায়। এই মিশ্রণকে কপারম্যাট বলে।
৩. গলিত কপারম্যাটকে বেসিমার চুল্লিতে নিয়ে এরমধ্যে পরিমাণমতো সিলিকা মিশিয়ে বায়ুপ্রবাহে চালকোসাইট বা কপার গ্লান্সকে জারিত করা হয়।
৪. জারণের ফলে উৎপন্ন কিউপ্রাস অক্সাইড এবং অপরিবর্তিত কিউপ্রাস সালফাইড পরস্পর বিক্রিয়া করে ধাতব কপার বা তামা উৎপন্ন করে। একে ব্লিস্টার কপার বলে।
2Cu2S+3O2=2Cu2O+2SO2. 2Cu2O+Cu2S=6Cu+SO2
৫. উৎপন্ন তামা থেকে তড়িৎ বিশোধন পদ্ধতিতে বিশুদ্ধ তামা উৎপন্ন করা হয়।
তামা বা কপারের ব্যবহার
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে তামার ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিবিধ ক্ষেত্রে আমরা কপার ব্যবহার করে থাকি। নিচে তামা বা কপারের ব্যবহার সম্বন্ধে আলোচনা করা হলো।
১. তড়িৎ লেপন ও তড়িৎ মুদ্রণে তামা ব্যবহার করা হয়।
২. পিতল, ব্রোঞ্জ, জার্মান সিলভার, বেল মেটাল, ব্রাস, অ্যালুমিনিয়াম ব্রঞ্চ প্রভৃতি সংকর ধাতু তৈরিতে কপারের ব্যবহার হয়।
৩. বৈদ্যুতিক তার, মোটর, তড়িৎ কোষ, ডায়নামো, ট্রান্সফর্মার, জেনারেটর, টাইপ মেশিন প্রভৃতি প্রস্তুত করতে তামার ব্যবহার করা হয়।
৪. রান্নার পাত্র, বাসনপত্র, বয়লারের বিভিন্ন অংশ, স্টিম পাইপ, মুদ্রা তৈরি, ক্যালরিমিটার, তড়িৎদ্বার প্রভৃতি প্রস্তুত করতে তামা বা কপারের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য।
তামা বা কপারের ধর্ম
তামা বা কপারের ধর্ম বিষয়ে সহজে জানার জন্য আমরা তামার ধর্মকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করব।
১. তামা বা কপারের ভৌত ধর্ম
২. তামা বা কপারের রাসায়নিক ধর্ম
প্রথমে আমরা ভৌত ধর্ম এবং পরে রাসায়নিক ধর্ম সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানবো।
তামার ভৌত ধর্ম
১. বিশুদ্ধতা তামা একটি লাল রঙের ধাতু। এই ধরনের রং তামাটে লাল বলে।
২. তামা তাপ পরিবহন করতে পারে।
৩ তামা বা কপার বিদ্যুতের সুপরিবাহী।
৪. বিশুদ্ধ তামা নরম, প্রসারণশীল এবং ঘাতসহনশীল
৫. তামা বা কপারের আপেক্ষিক গুরুত্ব 8.94।
৬. তামার গলনাংক 1083°C এবং স্ফুটনাঙ্ক 2310°C।
কপারের রাসায়নিক ধর্ম
১. বাতাসের সঙ্গে কপারের বিক্রিয়া
ক) সাধারণ উষ্ণতায় শুষ্ক বায়ুর সঙ্গে কপারের কোন বিক্রিয়া ঘটে না।
খ) কিন্তু আর্দ্র বায়ুতে কপার রেখে দিলে তার ওপর ধীরে ধীরে অক্সাইড এবং সালফাইডের কালো রঙের আস্তরণ পড়ে। দীর্ঘদিন আর্দ্র বায়ুতে রাখলে ওই আস্তরনের বর্ণ সবুজ হয়ে যায়, কারণ তখন ক্ষারীয় কপারসালফেটে পরিণত হয়।
[CuSO4, 2Cu(OH)2]
গ) কপারকে বায়ু কিংবা অক্সিজেনের সংস্পর্শে রেখে তীব্রভাবে উত্তপ্ত করলে বায়ুর অক্সিজেনের সঙ্গে কপারের বিক্রিয়ায় কালো রঙের কিউপ্রিক অক্সাইড এবং লাল রঙের কিউপ্রাস অক্সাইড উৎপন্ন হয়।
2Cu+O2=2CuO
4Cu+O2=2Cu2O
২. জলের সঙ্গে ক্রিয়া
জল বা স্টিমের সঙ্গে কোন অবস্থাতেই কপারের বিক্রিয়া ঘটে না।
৩. ক্ষারের সঙ্গে ক্রিয়া
ক্ষারের সঙ্গে কপারের কোন অবস্থাতেই বিক্রিয়া হয় না।
৪. অ্যাসিডের সঙ্গে বিক্রিয়া
হাইড্রোজেনের চেয়ে Cu অনেক কম ইলেক্ট্রো পজিটিভ মৌল বলে লঘু সালফিউরিক অ্যাসিড বা লঘু হাইড্রোক্লোরিক এসিডের সঙ্গে তামার বিক্রিয়া ঘটে না।
খ) কিন্তু অক্সিজেন বা বায়ুর উপস্থিতিতে তামা ওই অ্যাসিডের সঙ্গে বিক্রিয়া করে কি উপরে ক্লোরাইড বা কপার সালফেট লবণ ও জল উৎপন্ন করে।
গ) গারো এবং উত্তপ্ত সালফিউরিক এসিডের সঙ্গে কপারের বিক্রিয়া সালফার ডাই অক্সাইড এবং কপারসালফেট উৎপন্ন হয়।
ঘ) বিভিন্ন অবস্থায় এসিডের গাঢ়ত্ব ও উষ্ণতার উপর নির্ভর করে নাইট্রিক এসিডের সঙ্গে কপারের বিক্রিয়ায় কিউপ্রিক নাইট্রেট ও নাইট্রোজেনের বিভিন্ন অক্সাইড উৎপন্ন হয়। আশা করি এই লেখনীটা পড়তে আপনার ভালো লাগছে। এ ধরণের আরো পোস্ট পেতে আমাদের টেলিগ্রাম চ্যানেল জয়েন করুন।
তামা বা কপার সম্পর্কিত প্রশ্নোত্তর
ব্রাস কি দিয়ে তৈরি হয় এবং এর ব্যবহার কি
ব্রাশ একটি সংকর ধাতু। তামা ও দস্তার সংমিশ্রণে ব্রাস উৎপন্ন হয়। ব্রাস এর মধ্যে 75% তামা এবং 25% দস্তা থাকে।
ব্রাসের ব্যবহার
ব্যারোমিটার, টেলিস্কোপ ও বাসনপত্র তৈরিতে ব্রাস ব্যবহার করা
তামা বা কপার কোথায় পাওয়া যায়
প্রকৃতিতে অল্পমাত্রায় তামা মুক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। বাদবাকি তামা বিভিন্ন যৌগ থেকে নিষ্কাশন করে নেওয়া হয়। তামার মূল আকরিক হল কপারপাইরাইটিস বা চালকোপাইরাইটিস, এবং কিউপ্রাইট।
ভারতে বিহার প্রদেশের সিংহভূম জেলায়, হাজারীবাগে, সাঁওতাল পরগনায়, মাদ্রাজ অর্থাৎ তামিলনাড়ুতে, রাজস্থান, পাঞ্জাবে কপার আকরিক পাওয়া যায়। এছাড়াও নেপাল, যুক্ত প্রদেশের কুমায়ুন, কানাডার সুপিরিয়র হ্রদ অঞ্চলে,রাশিয়ার সাইবেরিয়া ও ইউরাল পর্বত অঞ্চল মুক্ত অবস্থায় কিছু পরিমান তামা বা কপার পাওয়া যায়
অ্যালুমিনিয়াম ব্রোঞ্জ কি দিয়ে তৈরি হয় এবং এর ব্যবহার কি
অ্যালুমিনিয়াম ব্রঞ্চ কথাটি শোনার পরেই বোঝা যায় যে এটি একটি সংকর ধাতু। অ্যালুমিনিয়াম ব্রোঞ্জ তামা ও অ্যালুমিনিয়ামের মিশ্রণে তৈরি করা হয়। এর মধ্যে 75 শতাংশ তামা এবং 25 শতাংশ দস্তা থাকে।
অ্যালুমিনিয়াম ব্রোঞ্জের ব্যবহার
অ্যালুমিনিয়াম ব্রোঞ্জ মুদ্রা, বাসনপত্র, ফটো ফ্রেম ও নানান রকম সৌখিনদ্রব্য প্রস্তুত করতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
ব্রোঞ্জ কি দিয়ে তৈরি এবং এর ব্যবহার কি
ব্রোঞ্জ একটি সংকর ধাতু। ব্রোঞ্জ তামা ও টিন দিয়ে তৈরি করা হয়। উল্লেখ্য ব্রোঞ্জ এর মধ্যে 90% তামা এবং 10% টিন থাকে।
ব্রোঞ্জের ব্যবহার
বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, বাসনপত্র ও মূর্তি তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়।
বেল মেটাল বা কাঁসা কি দিয়ে তৈরি হয় এবং এর ব্যবহার কি
কাসা একটি সংকর ধাতু। তামা ও টিনের মিশ্রণে কাসাঁ যৌগ তৈরি হয়। কাঁসার মধ্যে 80 শতাংশ তামা এবং 20 শতাংশ টিন থাকে।
বল মেটালের ব্যবহার
বেল মেটাল বা কাঁসা বাসনপত্র, মুদ্রা, মূর্তি প্রভৃতি তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়।
কপারের সংকেত কি
তামা বা কপারের সংকেত Cu
তামা বা কপারের যোজ্যতা কত
তামা বা কপারের যোজ্যতা 1 ও 2
তামা বা কপারের পারমাণবিক ওজন বা গুরুত্ব কত
তামা বা কপারের পারমাণবিক ওজন বা গুরুত্ব 63.5
তামা বা কপারের পরমাণু ক্রমাঙ্ক কত
তামা বা কপারের পরমাণু ক্রমাঙ্ক 29