মৌলের রাসায়নিক চিহ্ন বা প্রতীক ও সংকেত
প্রাচীনকাল থেকে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সাংকেতিক চিত্র ব্যবহার করে মৌলিক পদার্থের নাম প্রকাশ করতেন। এই পদ্ধতি ছিল খুবই জটিল এবং এর সাহায্যে বিভিন্ন পদার্থের গঠন ও পরিবর্তনগুলোকে প্রকাশ করা খুবই কষ্টসাধ্য ছিল। বিজ্ঞানী ডাল্টন জটিল চিহ্নের বদলে সরল চিহ্ন দিয়ে পদার্থের নাম প্রকাশের চেষ্টা করেন। কিন্তু মৌলিক পদার্থের চিহ্ন ঐ প্রণালীতে মনে রাখা সম্ভব ছিল না কারণ অনুর গঠনও ওই প্রণালীতে প্রকাশ করা কষ্টকর ছিল। এরপর 1811 খ্রিস্টাব্দে সুইডিশ বিজ্ঞানী বার্জেলিয়াস ইংরেজি বর্ণমালা অক্ষর ব্যবহার করে মৌলিক পদার্থ গুলির পূর্ণনাম সংক্ষেপে প্রকাশ করা সুবিধাজনক পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।
মৌলের (রাসায়নিক) চিহ্ন বা প্রতীক কি ?
চিহ্ন বা প্রতীকের সংজ্ঞা
মৌলিক পদার্থের নাম যা দ্বারা সংক্ষেপে প্রকাশ করা হয় তাকে চিহ্ন বলে। অর্থাৎ যার দ্বারা সংক্ষেপে কোন মৌলিক পদার্থের একটি পরমাণুকে প্রকাশ করা যায়, তাকে চিহ্ন বলে। যেমন অক্সিজেন O, হাইড্রোজেন H, ক্যালসিয়াম Ca ইত্যাদি।
চিহ্ন বা প্রতীক লেখার নিয়ম বা পদ্ধতি
মৌলিক পদার্থের নাম সংক্ষেপে প্রকাশ করার কয়েকটি পদ্ধতি আছে। প্রতীক লেখার নিয়ম গুলি নিচে উল্লেখ করা হলো
প্রতীক লেখার নিয়ম ১.
মৌলিক পদার্থের ইংরেজি নামের প্রথম অক্ষরটিকে বড় হরফে লিখে মৌলটির চিহ্ন প্রকাশ করা হয়। যেমন
মৌলের নাম | মৌলের নাম | প্রতীক বা চিহ্ন |
অক্সিজেন | Oxygen | O |
হাইড্রোজেন | Hydrogen | H |
বোরণ | Boron | B |
ফ্লুরিন | Fluorine | F |
নাইট্রোজেন | Nitrogen | N |
কার্বন | Carbon | C |
ভ্যানাডিয়াম | Vanadium | V |
প্রতীক লেখার নিয়ম ২
একই প্রথম অক্ষর বিশিষ্ট একাধিক মৌল থাকলে ওই গুলির চিহ্ন প্রকাশ করা হয় প্রথম অক্ষরের সঙ্গে পরের অক্ষর যোগ করে কিংবা প্রথম অক্ষরের সঙ্গে উচ্চারিত অক্ষর যোগ করে। যেমন
মৌলের নাম | মৌলের নাম | প্রতীক বা চিহ্ন |
ক্যালসিয়াম | Calcium | Ca |
বেরিয়াম | Barium | Ba |
ব্রোমিন | Bromine | Br |
ক্লোরিন | Chlorine | Cl |
মৌলিক পদার্থের চিহ্ন প্রকাশের নিয়ম ৩
কতকগুলি মৌলের চিহ্ন মৌলের ল্যাটিন নামের প্রথম বা প্রথম দুই অক্ষর অথবা উচ্চারণ ধ্বনিতে প্রাধান্য পাওয়া অক্ষর দিয়ে প্রকাশ করা হয়। যেমন
মৌলের নাম | মৌলের ল্যাটিন নাম | প্রতীক বা চিহ্ন |
সোডিয়াম | Sodium (natrium) | Na |
পটাশিয়াম | Potassium (kalium) | K |
কপার | Copper (Cuprum) | Cu |
আয়রন | Iron (ferrum) | Fe |
মৌলিক পদার্থের চিহ্ন প্রকাশের নিয়ম ৪
প্রতিটি মৌলিক পদার্থের চিহ্ন সবসময় বড় অক্ষরের ক্যাপিটাল লেটার সাহায্যে লিখতে হয়। যেখানে দুই অক্ষরের চিহ্ন থাকে সেখানে প্রথম অক্ষরটি বড় হাতের এবং পরের অক্ষর ছোট হাতের লিখতে হয়।
চিহ্ন বা প্রতীকের কাজ ও তাৎপর্য
প্রতীক এর তাৎপর্য ১
চিহ্ন মৌলিক পদার্থের নাম কে সংক্ষেপে প্রকাশ করে। যেমন H হাইড্রোজেন, O অক্সিজেন, Na সোডিয়াম মৌলকে বোঝায়।
চিহ্নের তাৎপর্য ২
চিহ্ন দিয়ে মৌলের একটি পরমাণুকে প্রকাশ করা হয়। যেমন H বললে একটি হাইড্রোজেন পরমাণুকে বোঝায়। একাধিক পরমাণুর ক্ষেত্রে চিহ্নের বাঁদিকে পরমাণুর সংখ্যাটি লিখতে হয়। যেমন 2H বললে দুটি হাইড্রোজেন পরমাণুকে বোঝায়। ঠিক অনুরূপভাবে Na, Cl, Ar যথাক্রমে সোডিয়াম, ক্লোরিন, আর্গনের একটি পরমাণুকে বোঝায়।
প্রতীক এর গুরুত্ব ৩
কোন মৌলের পারমাণবিক ওজন যত, মৌলটির চিহ্ন দ্বারা ততোভাগ ওজনের মৌলটিকে বোঝায়।
যেমন C চিহ্ন দ্বারা কার্বনের একটি পরমাণু ও 12 ভাগ ওজনের কার্বন বোঝায়। 2C দ্বারা দুটি কার্বন পরমাণু এবং 2×12 = 24 ভাগ ওজনের কার্বন বোঝায়। 3N বললে 3×14=42 ভাগ ওজনের নাইট্রোজেন বোঝায়।
সংকেত কি বা কাকে বলে
সংকেত এর সংজ্ঞা
যার সাহায্যে কোনো মৌলিক বা যৌগিক পদার্থের একটি অণুকে চিহ্নের মাধ্যমে সংক্ষেপে প্রকাশ করা হয়, তাকে সংকেত বলে।
সংকেতের কাজ বা তাৎপর্য
প্রতীক বা চিহ্নের মতো পদার্থের সংকেত থেকে ওই পদার্থের গুণগত ও পরিমাণগত কয়েকটি তথ্য জানা যায় যেমন–
সংকেতের গুণগত তাৎপর্য – তথ্য
সংকেত থেকে সংক্ষেপে পদার্থের নাম জানা যায়। অর্থাৎ সংকেত মৌলিক বা যৌগিক পদার্থের নাম সংক্ষেপে প্রকাশ করে।
এছাড়া সংকেত পদার্থের অণুর মধ্যে থাকা ‘উপাদান মৌলিক পদার্থ গুলোকে’ প্রকাশ করে। এবং সংকেত থেকে তাদের সংখ্যাও বোঝা যায়। যেমন জলের সংকেত H2O থেকে আমরা গুণগতভাবে বুঝতে পারি যে, এই যৌগিক পদার্থটি হলো হাইড্রোজেন মনোক্সাইড বা জল। এবং জলের একটি অণুতে দুইটি হাইড্রোজেন এবং একটি অক্সিজেন পরমাণু আছে।
সংকেতের পরিমাণগত তাৎপর্য তথ্য
সংকেত পদার্থের একটি অণুকে বোঝায়। সংকেত থেকে অনুটি কি কি মৌলিক পদার্থের কয়টি পরমাণু দিয়ে গঠিত তা জানা যায়। যেমন H2O সংকেত জলের একটি অণুকে বোঝাচ্ছে। এছাড়া এই সংকেতটি থেকে জানা যাচ্ছে যে জল এর একটি অণুতে দুইটি হাইড্রোজেন পরমাণুর একটি অক্সিজেন পরমাণু আছে।
সংকেতের বাঁদিকে কোন সংখ্যা বসানো থাকলে ওই সংখ্যা থেকে পদার্থের অণুর সংখ্যা বোঝা যায়। যেমন 3H2O র সাহায্যে তিনটি জলের অনুকে বোঝানো হয়।
সংকেত থেকে কোন মৌলিক পদার্থ ও যৌগিক পদার্থের আণবিক গুরুত্ব জানা যায়। আণবিক গুরুত্ব থেকে আবার, কোন মৌলিক না যৌগিক পদার্থের অণুর মধ্যে অবস্থিত পরমাণুগুলোর ওজন অনুপাত জানা যায়। যেমন H2O বা জলের আণবিক গুরুত্ব বা আণবিক ওজন = দুটি হাইড্রোজেন পরমাণুর ওজন + একটি অক্সিজেন পরমাণুর ওজন = (2×1) + (1×16) =18 ( যেহেতু হাইড্রোজেনের পারমাণবিক গুরুত্ব =1, অক্সিজেনের পারমাণবিক গুরুত্ব=16)।
অর্থাৎ, একটি জলের অণুতে অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেন এর ওজন অনুপাত হল 16:2 বা, 8:1 অর্থাৎ জলের অণুতে অক্সিজেন : হাইড্রোজেন :: 8:1।
বিভিন্ন মৌলিক পদার্থ কি কি ওজন অনুপাতে পরস্পর যুক্ত হয়ে কোন যৌগিক পদার্থ গঠন করে, তা সংকেত থেকে জানা যায়।যেমন H2O জলের সংকেত থেকে জানা যায় যে 18 ভাগ ওজনের জলের মধ্যে দুভাগ ওজনের হাইড্রোজেন এবং 16 ভাগ ওজনের অক্সিজেন আছে।
সংকেত থেকে কোন যৌগিক পদার্থের একটি অণুতে উপস্থিত মৌলিক পদার্থ গুলির শতকরা পরিমাণ জানা যায়। যেমন 100 গ্রাম জলে অক্সিজেন এর ওজন কত পরিমাণ হল 16/18×100 = 88.89এবং 100 ভাগ জলে হাইড্রোজেন এর ওজনগত পরিমাণ হল 2/18×100 = 11.11
মৌল বা যৌগটি গ্যাসীয় পদার্থের হলে, প্রমাণ তাপমাত্রা ও চাপে তার আয়তন কত হবে তার সংকেত থেকে জানা যায়। কারণ প্রমান তাপমাত্রা ও চাপে 1 গ্রাম অনু যে কোন গ্যাসের আয়তন 22.4 লিটার হয়। যেমন প্রমাণ তাপমাত্রা ও চাপে জল বা H2O গ্যাসীয় অবস্থায় থাকলে 1 গ্রাম অনু H2O এর আয়তন হবে 22.4 লিটার। এইভাবে প্রমাণ তাপমাত্রা ও চাপে 2 গ্রাম অনু জলীয় বাষ্পের আয়তন হবে 2 × 22.4 লিটার = 44.8 লিটার
সংকেত লেখার নিয়ম
সংকেত লেখার নিয়ম ১
মৌলের চিহ্ন এর ডান দিকে একটু নিচে মৌলটির একটি অণুতে কয়টি পরমাণু আছে সেই সংখ্যাটি লিখে মৌলের সংকেত প্রকাশ করা হয়।
যেমন হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, ক্লোরিন এর সংকেত যথাক্রমে H2, O2, N2, Cl2। কারণ এদের প্রত্যেকটির একটি অণুতে দুটি করে পরমাণু আছে। এছাড়া ওজন, ফসফরাস, সালফার অনুর সংখ্যা যথাক্রমে ও O3, P4, S8। কারণ একেকটি ওজন, ফসফরাস, সালফার অণুতে যথাক্রমে তিনটি চারটি আটটি পরমাণু আছে। আবার সোডিয়াম, পটাশিয়াম, কপার, হিলিয়াম, আর্গন প্রভৃতি মৌলের অনু একটি পরমাণু দিয়ে গঠিত। এদের সংখ্যা যথাক্রমে Na, K, Cu, He, Ar ইত্যাদি। নিষ্ক্রিয় গ্যাস ও ধাতব মৌল গুলির অনু একটিমাত্র পরমাণু দিয়ে গঠিত। একইভাবে কার্বন ও সিলিকনের সংকেতকে মৌল দুটি চিহ্নের সাহায্যে লেখা হয়।
সংকেত লেখার নিয়ম ২
যৌগিক পদার্থের অণুগুলো একাধিক মৌলিক পদার্থের পরমাণুর সমন্বয়ে গঠিত হয়। যেমন
ক) জলের একটি অণু দুটি হাইড্রোজেন ও একটি অক্সিজেন পরমাণু দ্বারা গঠিত। অতএব জলের অনুর সংকেত H2O।
ক) সোডিয়াম ক্লোরাইডের অণুতে একটি সোডিয়াম ও একটি ক্লোরিন পরমাণু আছে। অর্থাৎ সোডিয়াম ক্লোরাইড এর সংকেত NaCl।
সংকেত লেখার নিয়ম 3
কোন যৌগের সংকেত লিখতে হলে যৌগটি যেসব মৌল দিয়ে গঠিত হয়েছে তাদের চিহ্নগুলিকে পাশাপাশি লিখে প্রতিটি চীন্হের একটু নিচে মৌলের পরমাণুর সংখ্যা লেখা হয়। যেমন অ্যামোনিয়া যৌগে একটি নাইট্রোজেন এবং তিনটি হাইড্রোজেন পরমাণু আছে। সুতরাং অ্যামোনিয়ার সংকেত NH3।
সংকেতের ক্রম নির্ণয়
ধাতু বা ধাতু সদৃশ মূলক(NH4) এবং অধাতু দ্বারা গঠিত পদার্থের সংকেত লেখার নিয়ম:
যেসব যৌগিক পদার্থ শুধু ধাতু (বা ধাতু সদৃশ মুলক) এবং অধাতু দ্বারা গঠিত, সেইসব যৌগিক পদার্থের সংকেত লেখার সময় প্রথমে ধাতুর চিহ্ন অথবা ধাতু সদৃশ মূলকের সংকেত লিখে পরে অধাতুর চিহ্ন লিখতে হয়। যেমন—
১) সোডিয়াম সালফাইডের সংকেত Na2S (এখানে সোডিয়াম ধাতুর চিহ্ন লিখে পরে অধাতু সালফারের চিহ্ন লেখা হয়েছে), ক্যালসিয়াম অক্সাইড এর সংকেত CaO প্রভৃতি।
২) অ্যামোনিয়াম এবং ক্লোরিনের মধ্যে বিক্রিয়ায় উৎপন্ন অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড এর সংকেত NH4Cl লেখার সময় প্রথমে ধাতু সদৃশ অ্যামোনিয়াম এর চিহ্ন লিখে পরে অধাতু ক্লোরিন এর চিহ্ন লেখা হয়েছে।
৩) হাইড্রোজেন অধাতু হলেও ধাতুর মত ব্যবহার করে বলে H2Oবা জলের সংকেত লেখার সময় হাইড্রোজেন প্রথমে বসেছে।
হাইড্রোজেনের এই নিয়মের ব্যতিক্রম হলো NH3, CH4 প্রভৃতি।
দুটি অধাতুর মধ্যে একটি কঠিন হলে উৎপন্ন যৌগের সংকেত লেখার নিয়ম:
দুটি অধাতব মৌলের ( যার মধ্যে একটি কঠিন) বিক্রিয়ায় উৎপন্ন যৌগের সংকেত লেখার সময় কঠিন মৌলিক পদার্থের চিহ্নটি প্রথমে বসাতে হয়। যেমন কার্বন-ডাই-অক্সাইড বা CO2। কার্বন এবং অক্সিজেন এই দুটি অধাতুর মধ্যে বিক্রিয়ায় উৎপন্ন কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসের সংকেত লেখার সময় কঠিন মৌল কার্বনের চিহ্নটি আগে বসেছে।
দুটি অধাতু দ্বারা গঠিত যৌগের সংকেত লেখার নিয়ম:
দুটি অধাতব মৌলিকপদার্থের মধ্যে বিক্রিয়ায় উৎপন্ন যৌগিক পদার্থের সংকেত লেখার সময় বিক্রিয়াকারী অধাতু দুটির মধ্যে যে মৌলটি অন্যদের তুলনায় বেশি এলেক্ট্রনেগেটিভ সেই মৌলটির চিহ্ন পরে বসাতে হয়। যেমন সালফার (গন্ধক) এবং অক্সিজেনের মধ্যে অক্সিজেন সালফার এর তুলনায় বেশি এলেক্ট্রনেগাতিভ। তাই সালফার এবং অক্সিজেনের বিক্রিয়ায় গঠিত সালফার ডাই অক্সাইড যৌগের সংকেত লেখার সময় প্রথমে সালফারের চিহ্ন লিখে পরে তুলনামূলকভাবে বেশি এলেক্ট্রনেগাতিভ অক্সিজেন এর চিহ্ন লেখা হয়েছে। একইভাবে নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন দ্বারা উৎপন্ন নাইট্রিক অক্সাইডে নাইট্রোজেন অক্সিজেনের চেয়ে বেশি এলেক্ট্রনেগাতিভ তাই নাইট্রিক অক্সাইড এর সংকেত হলো NO।
অসম্ভব সুন্দর ভাবে বোঝানো হয়েছে
সুন্দর ব্লগ।
অনেক সহজ ভাবে বুঝানু হয়েছে।
Very smart 👌👌👌👌👌👌👍👍👍👍👍
খুব সুন্দর ও সহজ উপায়ে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে পর্যায় সারণী টা সঙ্গে থাকলে আরো ভালো হতো সংকেত লেখার পদ্ধতি অনুসরণ করতে।
thanks a lot🤗