ক্যাথোড রশ্মি কি বা কাকে বলে
ক্ষরণ নলের মধ্যে 0.01 মিলিমিটার চাপে বাতাস রেখে দুই তড়িৎদ্বারের মধ্যে 10 হাজার ভোল্ট বা তার বেশি বিভব প্রভেদ সৃষ্টি করলে ক্যাথোড থেকে অ্যানোডের দিকে একরকম রশ্মি নির্গত হয়, এবং ক্ষরণ নলের কাচের দেওয়ালে আপতিত হয়ে প্রতিপ্রভা সৃষ্টি করে। বিজ্ঞানী গোল্ডস্টাইন এর নাম দেন ক্যাথোড রশ্মি। তড়িৎক্ষেত্র এবং চৌম্বকক্ষেত্র দ্বারা এই রশ্মির বিক্ষেপ লক্ষ্য করে বিজ্ঞানীর জে জে টমসন প্রমাণ করেন যে, এই অদৃশ্য রশ্মি ইলেকট্রন কনার প্রবাহ মাত্র।
উচ্চ বিভব সম্পন্ন ক্যাথোডের প্রবল বিকর্ষণে বাতাসের মধ্যে থাকা মৌলের পরমাণু থেকে ইলেকট্রনগুলি কক্ষচ্যুত হয়ে অ্যানোডের দিকে ছুটে যায়। এই জন্য এই রশ্মির নাম ক্যাথোড রশ্মি দেওয়া হয়।
ক্যাথোড রশ্মির সংজ্ঞা
0.01 মিলিমিটার পারদ স্তম্ভের চাপে ক্ষরণ নলের মধ্যে ক্যাথোড থেকে অ্যানোডের দিকে প্রচন্ড বেগে প্রবাহমান ইলেকট্রন কণার স্রোতকে ক্যাথোড রশ্মি বলে।
ক্যাথোড রশ্মির ধর্ম
টমসন, ক্রুক্স, গোল্ডস্টাইন প্রমূখ বিজ্ঞানী নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ক্যাথোড রশ্মির বিভিন্ন ধর্ম আবিষ্কার করেন। নিচে ক্যাথোড রশ্মির ধর্ম সম্বন্ধে আলোচনা করা হলো–
১. ক্যাথোড রশ্মি ক্যাথোড থেকে লম্বভাবে নির্গত হয় এবং সরল রেখায় চলে।
আলো যেমন সরলরেখায় চলে অস্বচ্ছ বস্তুর ছায়া সৃষ্টি করে, তেমনি ক্যাথোড রশ্মির গতিপথে কোন অস্বচ্ছ বস্তুর রাখলে কাঁচের দেয়ালের উপর ঐ বস্তুর স্পষ্ট ছায়া পড়তে দেখা যায়।
পরীক্ষা
ক্ষরন নলের মধ্যে ক্যাথোড থেকে কিছু দূরে ক্যাথোডের সমান্তরালে একটি অভ্রের চক্র রাখা হলো। ক্যাথোড রশ্মির ধর্ম প্রমাণ করার জন্য কাচের নলটিকে অ্যানোডের দিকে বেশি চওড়া করা হয়। এবং শরু প্রান্তের দিকে ক্যাথোডটি একটি চাকতির আকারে রাখা হল। এবার নলে ক্যাথোড রশ্মির সৃষ্টি করা হলে বিপরীত দেয়ালে চক্রটির একটি সুস্পষ্ট ছায়া পড়বে। এই ছাড়া আর কোন উপচ্ছায়া থাকে না। এই পরীক্ষাটি প্রমাণ করে ক্যাথোড রশ্মি ক্যাথোড তল থেকে অভিলম্ব বরাবর নির্গত হয়ে সরলরেখায় চলে।
২. ক্যাথোড রশ্মি নেগেটিভ তড়িৎ বহন করে এবং কঠিন পদার্থ ভেদ করে।
ক্যাথোড রশ্মি সোনা রূপো অ্যালুমিনিয়াম প্রভৃতি খুব পাতলা পাতকে ভেদ করে যেতে পারে।
পরীক্ষা
ক্যাথোডের বিপরীত দিকের দেয়ালে ছোট ছিদ্র করে ওই ছিদ্রটি 0.001 মিলিমিটার পুরু অ্যালুমিনিয়াম পাত দিয়ে বন্ধ করে ক্যাথোড রশ্মি উৎপন্ন করলে এই পাতলা অ্যালুমিনিয়াম পাত ভেদ করে ক্যাথোড রশ্মি বেরিয়ে আসে। ওই বেরিয়ে আসা রশ্মিকে তড়িৎবীক্ষণ যন্ত্রের উপর ফেলে পরীক্ষা করলে দেখা যায় যে, রশ্মির কণাগুলি নেগেটিভ তড়িৎগ্রস্ত। এর দ্বারা প্রমাণিত হয়, ক্যাথোড রশ্মি নেগেটিভ তড়িৎ প্রবাহ। প্রত্যেক কোনায় নেগেটিভ তড়িৎএর পরিমাণ 1.6×10-19 কুলম্ব।
ক্যাথোড রশ্মি পজিটিভ তড়িৎগ্রস্ত পাতের দিকে আকৃষ্ট হয়ে বেঁকে যায়। এর থেকে বোঝা যায়, ক্যাথোড রশ্মির কণাগুলি নেগেটিভ তড়িৎগ্রস্ত।
৩. ক্যাথোড রশ্মি কোন পদার্থের উপর পড়ে প্রতিপ্রভা সৃষ্টি করে।
ক্যাথোড রশ্মি নলের কাঁচের দেয়ালের উপর পড়ে প্রতিপ্রভার সৃষ্টি করে। কাচ জিংক সালফাইট বেরিয়াম প্লাটিনো সায়ানাইড প্রকৃতির উপর ক্যাথোড রশ্মি আপতিত হয়ে প্রতিপ্রভা সৃষ্টি করে। ক্যাথোড রশ্মি যে বস্তুর উপর আপতিত হয়, সেই বস্তুর প্রকৃতির ওপর প্রতিপ্রভার রং নির্ভর করে, যেমন, কাঁচে সবুজ, অ্যালুমিনিয়ামে লাল, টিন স্টোনে হলুদ প্রভৃতি।
৪. ক্যাথোড রশ্মি ফটোগ্রাফিক প্লেটকে নষ্ট করে দেয়। সাধারণ আলোকরশ্মির মত ক্যাথোড রশ্মি ও ফটোগ্রাফিক প্লেটের উপর ক্রিয়া করে এবং ফটোগ্রাফিক প্লেটকে নষ্ট করে দেয়।
৫. ক্যাথোড রশ্মির ভরবেগ এবং গতিশক্তি আছে।
ক্যাথোড রশ্মির আঘাতে বস্তুর মধ্যে গতির সৃষ্টি হয়। একটি হালকা দন্ডের সঙ্গে চারটি হালকা পাত আটকে দন্ডটিকে দুটি সূচিমুখের উপর বসিয়ে, কোন পাতের উপর ক্যাথোড রশ্মি ফেললে, পাতাগুলো ঘুরতে থাকবে। এ থেকে বোঝা যায় – এই রশ্মির ভরবেগ আছে। অর্থাৎ রশ্মিগুলি ক্ষুদ্র ভরবিশিষ্ট কণার স্রোত। পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, প্রতি কণার ভর = 9.11×10-28 গ্রাম অর্থাৎ একটি হাইড্রোজেন পরমাণুর 1/1887 গুণ।
৬. ক্যাথোড রশ্মি চৌম্বক ক্ষেত্রে বিক্ষিপ্ত হয়।
কোন পরিবাহীর মধ্য দিয়ে তড়িৎ প্রবাহ হলে, পরিবাহীতে চৌম্বক ক্ষেত্রে যেমন বিক্ষিপ্ত হয়, (ফ্লেমিং এর বাম হস্ত নিয়ম) ক্যাথোড রশ্মি চৌম্বক ক্ষেত্রে সেইরকম বিক্ষিপ্ত হয়।
৭. ক্যাথোড রশ্মি দ্বারা গ্যাস আয়নিত হয়।
কোন গ্যাসের মধ্য দিয়ে ক্যাথোড রশ্মি পাঠালে, ক্যাথোড রশ্মির প্রবল গতি যুক্ত ইলেকট্রন কণা গুলোর সঙ্গে গ্যাসের পরমাণু সংঘর্ষের ফলে, গ্যাসের পরমাণুগুলো আয়নে পরিণত হয়। ফলে গ্যাসটি তড়িৎ পরিবাহীতে পরিণত হয়।
৮. ক্যাথোড রশ্মিগুলি পরস্পরকে বিকর্ষণ করে।
কনাগুলি একই রকম তড়িৎগ্রস্ত বলে ক্যাথোড রশ্মির এই ধর্ম দেখা যায়।
৯. ক্যাথোড রশ্মি শক্তি বহন করে।
ক্যাথোডটি অবতল হলে, ওই অবতল থেকে নির্গত ক্যাথোড রশ্মি যেখানে কেন্দ্রীভূত হয়, সেখানে একটি পাতলা প্লাটিনাম পাত রাখলে, পাতটি প্রচন্ড উত্তপ্ত হয়ে আলো বিকিরণ করে। ইলেকট্রন কণা প্রচণ্ড বেগে প্লাটিনাম পাতের উপর পড়ে; ফলে ওদের গতিশক্তি তাপশক্তিতে রূপান্তরিত হয়।
১০. ক্যাথোড রশ্মি তড়িৎক্ষেত্র দ্বারা প্রভাবিত হয়।
দুইটি বিপরীত তড়িৎগ্রস্ত ধাতব পাতের ফাঁকের মধ্যে দিয়ে ক্যাথোড রশ্মি চালনা করলে দেখা যায়, ক্যাথোড রশ্মি পজিটিভ তড়িৎগ্রস্ত পাতের দিকে আকৃষ্ট হয়ে বেঁকে যায়। এর থেকে প্রমাণিত হয় যে, ক্যাথোড রশ্মির কণাগুলি নেগেটিভ তড়িৎগ্রস্ত।
ক্যাথোড রশ্মির প্রকৃতি
বিভিন্ন ধর্ম পর্যালোচনা করে ক্যাথোড রশ্মির প্রকৃতি জানা যায়। ক্যাথোড রশ্মির প্রকৃতি নিচে আলোচনা করা হলো।
১. চৌম্বক ক্ষেত্র ও তড়িৎ ক্ষেত্র দ্বারা ক্যাথোড রশ্মির বিক্ষেপ থেকে আমরা জানতে পারি, ক্যাথোড রশ্মি নেগেটিভ তড়িৎগ্রস্ত ।
২. ক্যাথোড রশ্মির আঘাতে বস্তুর মধ্যে গতির সৃষ্টি হয় । সুতরাং ক্যাথোড রশ্মির ভরবেগ আছে।
৩. যেহেতু ক্যাথোড রশ্মির কণাগুলি নেগেটিভ তড়িৎগ্রস্ত এবং তীব্র ভরবেগ বিশিষ্ট সুতরাং সিদ্ধান্ত করা যায় যে, ক্যাথোড রশ্মি নেগেটিভ তড়িৎগ্রস্ত কণার স্রোত মাত্র। এই কথাগুলোকে ইলেকট্রন বলে।
অর্থাৎ, ক্যাথোড রশ্মি হলো তীব্র গতিবেগ সম্পন্ন ইলেকট্রন কণা অদৃশ্য স্রোত।