বেনজিন
বেনজিন হলো অ্যারোমেটিক যৌগের সরলতম হাইড্রোকার্বন। 1825 সালে মাইকেল ফ্যারাডে তিমি মাছের তেল থেকে উৎপন্ন গ্যাস থেকে বেনজিন আবিষ্কার করেন। 1845 সালে হফম্যান আলকাতরার মধ্যে বেনজিনের উপস্থিতি লক্ষ্য করেন।
বেনজিনের উৎস
বেনজিনের উৎসগুলি নিচে কয়েকটি পয়েন্ট আকারে আলোচনা করা হলো।
১. আলকাতরাকে আমরা বেনজিনের প্রধান উৎস হিসেবে বলতে পারি। কয়লার অন্তর্ধূম পাতনের ফলে উৎপন্ন আলকাতরার আংশিক পাতন করে 170°C উষ্ণতায় যে পাতিত দ্রব্য পাওয়া যায়, তাকে লাইট অয়েল বা লঘু তেল বলা হয়। এই লাইট ওয়েলে বেনজিন থাকে।
২. বেনজিনের অপর একটি প্রধান উৎস হল পেট্রোলিয়াম। পেট্রোলিয়াম থেকে পাওয়া নরমাল হেক্সেন যৌগকে 550°C উষ্ণতায় উত্তপ্ত Cr2O3-Al2O3 অনুঘটকের উপর দিয়ে উচ্চচাপে প্রবাহিত করলে বেনজিন উৎপন্ন হয়।
C6H14 ( Cr2O3-Al2O3) C6H6+4H2
৩. অ্যাসিটিলিন গ্যাসকে উত্তপ্ত কপার নলের মধ্য দিয়ে চালনা করলে বেনজিন উৎপন্ন হয়।
৪. অনার্দ্র সোডিয়াম বেনজোয়েটকে সোডালাইমসহ উত্তপ্ত করে বেনজিন প্রস্তুত করা যেতে পারে।
C6H5COINa+NaOH=Na2CO3+C6H6
৫. ফেনোল বা কার্বলিক অ্যাসিডকে জিংক চূর্ণসহ পাতিত করলে ফেনল বিজারিত হয়ে বেনজিনে পরিণত হয়।
C6H5OH+Zn=C6H6+ZnO
বেনজিনের ধর্ম
বেনজিনের ধর্ম সম্বন্ধে অবগত করার জন্য নিচে পয়েন্ট আকারে আলোচনা করা হলো
১. বেনজিন একটি অ্যারোমেটিক যৌগের সরলতম হাইড্রোকার্বন।
২. এটি বর্ণহীন, বিশিষ্ট তীব্র গন্ধযুক্ত উদ্বায়ী তরল।
৩. বেনজিনের স্ফুটনাঙ্ক 80.5°C এবং গলনাঙ্ক 5.4°C।
৪. বেনজিন একটি উত্তম জৈব দ্রাবক। এটি গন্ধক, ফসফরাস, আয়োডিন, রেজিন, চর্বি প্রভৃতিকে দ্রবীভূত করে।
৫. বেনজিন জলে অদ্রাব্য কিন্তু ইথার, অ্যালকোহল ও পেট্রোলের দ্রাব্য।
বেনজিনের ব্যবহার
বেনজিনের বহুধা ব্যবহার আছে। এই পর্বে আমরা বেনজিনের ব্যবহার সম্বন্ধে জানবো।
১. বেনজিন পেট্রোলের সঙ্গে মিশিয়ে মোটর গাড়ির জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
২. তেল, চর্বি, রবার, লাক্ষা, গ্রীজ, গাম প্রভৃতির দ্রাবক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
৩. নাইট্রোবেনজিন, ফেনল, ক্লোরোবেনজিন, সাইক্লোহেক্সেন প্রভৃতি প্রস্তুতিতে বেনজিন ব্যবহার করা হয়।
৪. রেশম বস্ত্র ও পশম বস্ত্রের ড্রাইওয়াশে এটি ব্যবহার করা হয়।
৫. কীটনাশক ঔষধ যেমন গ্যামাক্সিন, ডিডিটি এবং নানাবিধ ওষুধ প্রস্তুতিতে বেনজিন ব্যবহার করা হয়।
৬. নানা রকম বিস্ফোরক দ্রব্য তৈরিতে এর ব্যবহার আছে।
৭. ফেনোল থেকে নাইলন, প্লাস্টিক, এবং রংয়ের পণ্য উৎপাদনে বেনজিন ব্যবহার করা হয়।
ফেনল বা কার্বলিক অ্যাসিড
ফেনল বা কার্বলিক অ্যাসিড একটি অ্যারোমেটিক যৌগ। এই অধ্যায় এর সম্বন্ধে আমরা বিস্তারিত জানব।
ফেনল বা কার্বলিক অ্যাসিডের উৎস
১. আলকাতরার মধ্যে ফেনল বর্তমান। আলকাতরার আংশিক পাতন এর ফলে 170°C থেকে 230°C উষ্ণতার মধ্যে যে পাতিত দ্রব্য পাওয়া যায়, তাকে মিডল অয়েল বলে। মেডেল অয়েলকে ঠান্ডা করে কঠিন ন্যাপথলিনকে অপসারিত করলে যে অবশিষ্ট তরল পাওয়া যায় তার থেকে ফেনল প্রস্তুত করা হয়।
২. সিলিকন ডাই অক্সাইডের উপস্থিতিতে 425°C উষ্ণতায় ক্লোরোবেনজিন বাষ্প ও জলীয় বাষ্পের বিক্রিয়া ঘটিয়ে ফিনাল বা কার্বলিক এসিড প্রস্তুত করা হয়।
C6H5Cl+H2O=C6H5OH+HCl
৩. 400 °C তাপমাত্রা ও 200 বায়ুচাপে সোডিয়াম কার্বনেট ও সালফনিক এসিড বা ক্লোরোবেনজিনের মিশ্রণকে তপ্ত কপার অনুঘটকের উপর দিয়ে চালনা করে ফেনল বা কার্বলিক এসিড প্রস্তুত করা হয়।
৪. এছাড়াও বেনজিন থেকে কার্বলিক অ্যাসিড বা ফেনল প্রস্তুত করা যায়।
কার্বলিক অ্যাসিড বা ফেনলের ধর্ম
প্রত্যেকটি জৈব যৌগের মত ফেনোল বা কার্বলিক এসিডের ও বিশেষ কিছু ধর্ম আছে। ফেনোল বা কার্বলিক এসিডের ধর্ম আলোচনা করা হলো
১. কার্বলিক অ্যাসিড একটি জৈব এসিড
২. কার্বলিক অ্যাসিড বা ফেনল একটি অ্যারোমেটিক যৌগ।
৩. ফেনোল এর গলনাঙ্ক ও 43°C এবং স্ফুটনাঙ্ক 182°C।
৪. কার্বলিক অ্যাসিড একটি বর্ণহীন, দানাদার ও কঠিন পদার্থ।
৫. ফেনল দেহের সংস্পর্শে ক্ষতের সৃষ্টি করে।
৬. কার্বলিক অ্যাসিড এলকোহল এবং ইথারে দ্রাব্য।
৭. ফেনল জলে মোটামুটি দ্রাব্য।
৮. বেনজিন বলয়ের একটি হাইড্রোজেন পরমাণু একটি হাইড্রোক্সিল মূলক দ্বারা প্রতিস্থাপিত হলে ফেনাল উৎপন্ন হয়।
কার্বলিক অ্যাসিড বা ফেনোলের ব্যবহার
কার্বলিক অ্যাসিড বা ফেনল দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়ে থাকে। এখানে ফেনোল বা কার্বলিক এসিডের ব্যবহার সম্বন্ধে দেওয়া হল।
১. ব্যাকেলাইট (ফেনল ফরমালডিহাইড প্লাস্টিক) নামে প্লাস্টিক তৈরি করতে প্রচুর পরিমাণে ফেনল ব্যবহার করা হয়।
২. কাঠ সংরক্ষণ এবং ছত্রাক ধ্বংসকারী ওষুধ পেন্টাক্লোরোফেনল প্রস্তুতিতে কার্বলিক এসিড ব্যবহার করা হয়।
৩. পিকরিক এসিড নামক বিস্ফোরক তৈরি করতে ফিনাল ব্যবহার করা হয়।
৪. ওষুধ হিসাবে ব্যবহৃত অ্যাসপিরিন, স্যালিসাইলিক এসিড, ফেনাসেটিন প্রভৃতি প্রয়োজনীয় নানান রকম জৈব যৌগ প্রস্তুতিতে ফেনল বা কার্বলিক এসিড ব্যবহৃত হয়।
৫. জীবাণুনাশক সাবান লোশন প্রস্তুতিতে ব্যবহার করা হয়
৬. রবার ও নাইট্রো সেলুলোজের দ্রাবক সাইক্লোহেক্সানল প্রস্তুতিতে ব্যবহার করা হয়।
৭. জীবাণুনাশক হিসেবে ফেনল ব্যবহৃত হয়। এছাড়া কার্বলিক এসিডের গন্ধে সাপ আসে না।
৮. নাইলন প্রস্তুতিতে এর ব্যবহার আছে।
৯. অ্যামাইডোফেলন যৌগ (ফটো শিল্পে ব্যবহৃত হয়) প্রস্তুতিতে কার্বলিক এসিড ব্যবহার করা হয়।
ন্যাপথলিন
ন্যাপথলিনের উৎস
১. ন্যাপথলিনের প্রধান উৎস হল আলকাতরা। আলকাতরার মধ্যে প্রায় 6% ন্যাপথলিন থাকে। আলকাতরার আংশিক পাতনে 170°C-230°C উষ্ণতার মধ্যে যে পাতিত তরল পদার্থ পাওয়া যায়, তাকে মিডল অয়েল বলে। মিডল অয়লে কার্বলিক অ্যাসিড বা ফেনোল এবং ন্যাপথলিন মিশ্রিত থাকে। ন্যাপথলিন ঠান্ডা করলে কঠিন কেলাসের আকারে দ্রবন থেকে পৃথক হয়ে পড়ে। এরপর ফিল্টার তরল থেকে ন্যাপথলিন কেলাসগুলোকে আলাদা করে দেয়।
২. এছাড়া পেট্রোলিয়াম থেকে প্রাপ্ত নরমাল ডেকেন যৌগকে 680°C উষ্ণতায় কপার অনুঘটকের উপর দিয়ে পাঠিয়ে ন্যাপথলিন প্রস্তুত করা হয়।
C10H22___C10H8+7H2O
৩. বিশেষ কয়েক শ্রেণীর পেট্রোলিয়ামের মধ্যে সামান্য পরিমাণে ন্যাপথলিন থাকে।
ন্যাপথলিনের ধর্ম
ন্যাপথলিনের কিছু বিশেষ ধর্ম আছে সেগুলো নিচে আলোচনা করা হল
১. ন্যাপটল ইন দুটি বেনজিন বলয় যুক্ত একটি অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন।
২. নেপোলিয়ন একটি বিশিষ্ট গন্ধযুক্ত চকচকে সাদা রঙের কেলাসিত কঠিন পদার্থ।
৩. এটি উদ্বায়ী পদার্থ
৪. ন্যাপথলিনের গলনাঙ্ক 80°C এবং স্ফুটনাঙ্ক 218°C
ন্যাপথলিনের ব্যবহার
কিছু বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাজে ন্যাপথলিন ব্যবহার করা হয়
১. জামা কাপড় যাতে পোকায় নষ্ট না করে সেজন্য কীটনাশক হিসেবে ন্যাপথলিন ব্যবহার করা হয়।
২. জীবাণুনাশক এবং দুর্গন্ধনাশক হিসেবে ন্যাপথলিন ব্যবহৃত হয়।
৩. নানা রকম রং তৈরিতে ন্যাপথলিন ব্যবহৃত হয়। নীল প্রস্তুত করতে এটি ব্যবহার করা হয়।
৪. ট্রেটালিন, ডেকালীন, থ্যালিক অ্যানহাইড্রাইড প্রভৃতি জৈব পদার্থ প্রস্তুত করতে ন্যাপথালিন ব্যবহার করা হয়।