প্রকৃতিতে অ্যালুমিনিয়াম মুক্ত অবস্থায় পাওয়া যায় না কিন্তু অ্যালুমিনিয়ামের যৌগের মধ্যে অ্যালুমিনিয়াম বর্তমান থাকে। ভূপৃষ্ঠের সমস্ত ধাতু গুলির মধ্যে অ্যালুমিনিয়ামের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। প্রায় 7% – 8% অ্যালুমিনিয়ামের যৌগ আছে ভূপৃষ্ঠে। বেশিরভাগ অ্যালুমিনিয়াম, সিলিকেট রূপে প্রকৃতিতে পাওয়া যায়। অ্যালুমিনিয়ামের প্রধান আকরিক হল বক্সাইট ( Al2O3, 2H2O)। বক্সাইটে প্রায় 60% অ্যালুমিনা থাকে। ভারতে মহারাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি বক্সাইট পাওয়া যায়, এছাড়াও উড়িষ্যা, গুজরাট, বিহার, মধ্যপ্রদেশ প্রভৃতি স্থানেও আকরিক হিসেবে বক্সাইট পাওয়া যায়।
বক্সাইট থেকে অ্যালুমিনিয়াম নিষ্কাশন করা হয়। বক্সাইটে 60% – 75% অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড এবং সামান্য বালি (SiO2) মিশ্রিত থাকে।প্রকৃতিতে যেসব মূল্যবান পাথর পাওয়া যায় যেমন চুনি, পান্না, পোখরাজ প্রভৃতি এগুলি হল অ্যালুমিনা (Al2O3)। এই অ্যালুমিনার সঙ্গে সামান্য পরিমাণ অন্যান্য ধাতু অক্সাইড মিশ্রিত থাকায় ওদের বিভিন্ন রং হয়ে থাকে।
বক্সাইট থেকে অ্যালুমিনিয়াম প্রস্তুতি
বক্সাইট আকরিক থেকে প্রথমে বিশুদ্ধ অ্যালুমিনা প্রস্তুত করা হয়। পরে ক্রায়োলাইট ও ফেল্স্পারের গলিত মিশ্রণে অ্যালুমিনাকে দ্রবীভূত করে তড়িৎ বিশ্লেষণ করলে ক্যাথোড অ্যালুমিনিয়াম এবং এনোডে অক্সিজেন উৎপন্ন হয়।
অ্যালুমিনিয়ামের আকরিক বা অ্যালুমিনিয়ামের প্রধান খনিজ
আকরিক যৌগ | খনিজ পদার্থের নাম |
সোদক অক্সাইড | ডায়াস্পোর Al2O3, H2O বক্সাইট Al2O3, 2H2O গিবসাইট Al2O3, 3H2O |
ফ্লুওরাইড | ক্রায়োলাইট AlF3, 3NaF |
সালফেট | অ্যালুনাইট K2SO4 , Al2(SO4)3, 4Al(OH)3 |
সিলিকেট | ফেল্সপার K2O4, Al2O3, 6SiO2 কেওলিন Al2O3, 2SiO2, 2H2O |
মিশ্র অক্সাইড | স্পাইনেল MgO, Al2O3, ক্রাইসোবেরিল BeO, Al2O3, |
অক্সাইড রূপে | কোরান্ডাম Al2O3 চুনি, হিরা, পান্না, হলদে পোখরাজ প্রভৃতি বহুমূল্য রত্ন আসলে হলো অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড। অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইডের সঙ্গে অন্যান্য ধাতুর অক্সাইড বিভিন্ন অনুপাতে মিশে থাকার জন্য এইসব রত্নের রং আলাদা হয়। |
অ্যালুমিনিয়ামের ধর্ম
অ্যালুমিনিয়াম এর ভৌত ধর্ম
১. অ্যালুমিনিয়ামের রং রুপোর মত সাদা,অশুদ্ধ অবস্থায় থাকলে সামান্য নীল আভা দেখা যায়।
২. এই ধাতু খুব হালকা। এর আপেক্ষিক গুরুত্ব 2.7।
৩. তাপ ও তড়িতের সুপরিবাহী।
৪. এটি নরম এবং নমনীয়, 100° – 150° সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ধাতুটি নমনীয় ও প্রসার্য হয় একে সহজেই পাতলা পাত বা সরু তারে পরিণত করা যায় কিন্তু 600°সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা এলুমিনিয়াম ভঙ্গুর হয়ে পড়ে তখন তাকে পাউডারে পরিণত করা যায়।
৫. 659° সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় অ্যালুমিনিয়াম গলে যায়। এই অবস্থায় রেখে বিভিন্ন সাথে ঢেলে তার আকৃতি প্রদান করা হয়।
অ্যালুমিনিয়ামের রাসায়নিক ধর্ম
১. বায়ুর সঙ্গে ক্রিয়া
ক) শুষ্ক বায়ুর সঙ্গে অ্যালুমিনিয়ামের কোন বিক্রিয়া ঘটে না।
খ) আদ্র বায়ুতে রাখলে ধাতব ও অ্যালুমিনিয়ামের উপর অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইডের একটি সূক্ষ্ম আস্তরণ পড়ে, যা ধাতুর ক্ষয় রোধ করে।
গ) অ্যালুমিনিয়াম পাত বা তারকে বায়ুর মধ্যে তীব্র উত্তপ্ত করলে উজ্জ্বল সাদা শিখার সঙ্গে জ্বলতে থাকে এবং বায়ুর অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন এর সঙ্গে যুক্ত হয় যথাক্রমে অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড এবং অ্যালুমিনিয়াম নাইট্রাইড উৎপন্ন করে।
4Al+3O2=2Al2O3, 2Al+N2=2AlN
২. জলের সঙ্গে বিক্রিয়া
ক) সাধারণ অবস্থায় অ্যালুমিনিয়াম ধাতুর ওপর Al2O3এর সখ্য আস্তরন থাকায় অ্যালুমিনিয়ামের সঙ্গে বিশুদ্ধ জল বা জলীয়বাষ্পের কোন বিক্রিয়া ঘটে না।
খ) অ্যালুমিনিয়াম চূর্ণ জলে ফোটালে জল বিয়োজিত হয়ে হাইড্রোজেন উৎপন্ন করে এবং অ্যালুমিনিয়াম হাইড্রোক্সাইড উৎপন্ন হয়ে অধঃক্ষিপ্ত হয়।
2Al+6H2O=3H2+2Al(OH)3
গ) অ্যালুমিনিয়াম ও পারদ এর সংখ্যার ধাতুর সঙ্গে জলের বিক্রিয়া অ্যালুমিনিয়াম হাইড্রোক্সাইড ও হাইড্রোজেন উৎপন্ন হয়।
ঘ) ম্যাগনেসিয়াম ক্লোরাইড বা লবণাক্ত জলে অ্যালুমিনিয়াম দ্রবীভূত হয়ে যায়, এবং হাইড্রোজেন ও হাইড্রোক্সাইড উৎপন্ন করে।
৩. লঘু এসিডের সঙ্গে অ্যালুমিনিয়ামের বিক্রিয়া
ক) লঘু সালফিউরিক এসিডের সঙ্গে অ্যালুমিনিয়ামের বিক্রিয়া ঘটে না। লঘু হাইড্রোক্লোরিক এসিডের সঙ্গে অ্যালুমিনিয়ামের বিক্রিয়ায় হাইড্রোজেন এবং অ্যালুমিনিয়াম ক্লোরাইড উৎপন্ন হয়।
2Al+6HCl=2AlCl3+3H2
খ) লঘু নাইট্রিক এসিড অ্যালুমিনিয়ামের সঙ্গে অতি ধীর গতিতে বিক্রিয়া করে এবং অ্যালুমিনিয়াম নাইট্রেট ও অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট উৎপন্ন করে।
৪. উত্তপ্ত ও গাঢ় এসিডের সঙ্গে বিক্রিয়া
ক) উষ্ণ ও গাঢ় সালফিউরিক এসিডের সঙ্গে অ্যালুমিনিয়ামের বিক্রিয়ায় অ্যালুমিনিয়াম সালফেট এবং সালফার ডাই অক্সাইড গ্যাস উৎপন্ন হয়।
2Al+6H2SO4=Al2(SO4)3+3SO2+6H2O
খ) গাঢ় নাইট্রিক এসিডের সঙ্গে অ্যালুমিনিয়ামের বিক্রিয়া ঘটে না। নাইট্রিক এসিডের গাঢ়ত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অ্যালুমিনিয়ামের সঙ্গে বিক্রিয়া করার ক্ষমতা কমে যায়।
৫. ক্ষারের সঙ্গে বিক্রিয়া
সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড বা পটাশিয়াম হাইড্রোক্সাইডেরর মত ক্ষারের জলীয় দ্রবণে অ্যালুমিনিয়ামের চূর্ণ ফেলে উত্তপ্ত করলে যথাক্রমে সোডিয়াম ও পটাশিয়াম অ্যালুমিনেট লবণ ও হাইড্রোজেন উৎপন্ন হয়।
2Al+2NaOH+2H2O=2NaAlO2+3H2
2Al+2KOH+2H2O=2KAlO2+3H2
৬. একইসঙ্গে এসিড ও ক্ষারের সঙ্গে বিক্রিয়া
ক) অ্যালুমিনিয়াম ক্ষার ও এসিড উভয়ের সঙ্গে বিক্রিয়া করে হাইড্রোজেন উৎপন্ন করে।
খ) অ্যালুমিনিয়াম-অক্সাইড এসিড ও ক্ষারের সঙ্গে বিক্রিয়া করে লবণ ও জল উৎপন্ন করে। অর্থাৎ অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড একটি উভধর্মী অক্সাইড।
Al2O3+6HCl=AlCl3+3H2O
Al2O3+NaOH=2NaAlO2+H2O
অ্যালুমিনিয়ামের ব্যবহার
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্নভাবে অ্যালুমিনিয়ামের ব্যবহার করে থাকে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কাজ মেটাতে। নিচে অ্যালুমিনিয়ামের ব্যবহার সম্বন্ধে প্রধান কয়েকটি বিষয় দেওয়া হল।
১. মোটরগাড়ি ও বিমানের কাঠামো প্রস্তুত করতে অ্যালুমিনিয়ামের ব্যবহার হয়।
২. তড়িৎবাহী তার এবং বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি তৈরি করতে অ্যালুমিনিয়ামের ব্যবহার হয়।
৩. থার্মিট পদ্ধতিতে ভাঙাচোরা লোহা জোড়া লাগাতে এবং ক্রোমিয়াম, ম্যাংগানিজ প্রভৃতি ধাতু উৎপাদনে Al ব্যবহার করা হয়।
৪. দৈনন্দিন ব্যবহৃত ঘরের বিভিন্ন সামগ্রী যেমন বাসনপত্র, রন্ধনপাত্র প্রভৃতি রান্নার সরঞ্জাম তৈরি করতে
৫. চেয়ার, টেবিল, টুল, মই প্রভৃতি হালকা আসবাবপত্র ও নিত্য ব্যবহার্য জিনিস অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে তৈরি করা হয়। মরিচাবিহীন হালকা ও সহজে বহনযোগ্য হওয়ার কারণে এলুমিনিয়ামের মই, কাঠামো প্রভৃতি জিনিস দমকল ও সেনাবাহিনীতে ব্যবহার করা হয়।
৬. চকলেট, সিগারেট, প্রভৃতির মোড়ক ও রাংতা অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে তৈরি করা হয়।
৭. ফটোগ্রাফিক ফ্ল্যাশ বাল্ব প্রস্তুতিতে অ্যালুমিনিয়ামের ব্যবহার হয়।
৮. বাজি ও বোমা তৈরি করতে অ্যালুমিনিয়ামের ব্যবহার হয়
৯. তুলাযন্ত্র, বিমান ও মোটরগাড়ির কাঠামো, বাসনপত্র, মুদ্রা প্রভৃতি প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত হালকা ও ঘাতসহ ধাতুসংকর প্রস্তুতি করতে অ্যালুমিনিয়ামের ব্যবহার হয়। যেমন অ্যালুমিনিয়াম ব্রোঞ্জ, ম্যাগনেসিয়াম, ডুরালুমিন প্রভৃতি ধাতু সংকর।
অ্যালুমিনিয়াম সম্বন্ধীয় প্রশ্নোত্তর
অ্যালুমিনিয়াম পাতে মোড়া চাটনি বা আচার খাওয়া উচিত নয় কেন
অ্যালুমিনিয়ামের পাতে মোড়া চাটনি আচার খাওয়া উচিত নয়। চাটনিতে জৈব এসিড (অ্যাসিটিক অ্যাসিড বা ভিনিগার) থাকে। ওই জৈব এসিড অ্যালুমিনিয়ামের সঙ্গে বিক্রিয়া করে যে লবণ উৎপন্ন করে, তা চাটনির সঙ্গে আমাদের দেহে প্রবেশ করে শরীরের ক্ষতি সাধন করতে পারে। তাই অ্যালুমিনিয়ামের পাতে মোড়া চাটনি বা আচার খাওয়া উচিত নয়।
অ্যালুমিনিয়ামের সংকেত
Al হল অ্যালুমিনিয়ামের সংকেত
অ্যালুমিনিয়ামের পারমাণবিক গুরুত্ব কত
অ্যালুমিনিয়ামের পারমাণবিক গুরুত্ব হলো 26.98
অ্যালুমিনিয়ামের পরমাণু ক্রমাঙ্ক কত
অ্যালুমিনিয়ামের পরমাণু ক্রমাঙ্ক 13
অ্যালুমিনিয়ামের যোজ্যতা কত
অ্যালুমিনিয়ামের যোজ্যতা 3