রাম মন্দির ইতিহাস | রাম জন্মভূমি পুনরুদ্ধার | বাবরি মসজিদ

0
465

রাম মন্দিরের ইতিহাস, রাম জন্মভূমি পুনরুদ্ধার ও বাবরি মসজিদ

রাম মন্দির এর ইতিহাস ও রাম জন্মভূমির পুনরুদ্ধার ভারতীয়দের কাছে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সুদীর্ঘ অপেক্ষার পর সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে ন্যায়বিচার পেল অযোধ্যার শ্রী রাম জন্মভূমি।

শ্রী রামচন্দ্রের জন্মভূমি ভারতের আস্থা, বিশ্বাস ও সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধার প্রতীক। সারা বিশ্বের হিন্দুদের প্রাণকেন্দ্র। তাই ভারতীয়রা আজ প্রসন্ন। কারণ কয়েক শতাব্দী ধরে চলে আসা সংঘর্ষ, সংগ্রাম ও অগণিত প্রাণের বলি ও আত্মোৎসর্গের পর অযোধ্যা মামলা রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে শ্রী রাম জন্মভূমি মুক্ত হলো ও সাধারণ মানুষের আস্থার জয় হলো।

রাম মন্দিরের ইতিহাস

ভারতের ইতিহাসের এক বড় অংশজুড়ে আছে অযোধ্যা নগরী ও রাম জন্মভূমি। কারণ শ্রী রামের জন্মভূমি অযোধ্যা। রামচন্দ্রের পিতা সূর্যবংশীয় রাজা দশরথ রাজত্ব করেন মনুর সৃষ্ট অযোধ্যায়। রামচন্দ্রের জন্ম হয় এই অযোধ্যায় ত্রেতাযুগে, বিষ্ণুর সপ্তম অবতার রূপে।

অথর্ব বেদে অযোধ্যার উল্লেখ আছে। ঋকবেদে সরযু নদীর বর্ণনা আছে। বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থগুলিতে একাধিকবার অযোধ্যা ও রঘুবংশীয় রাজাদের কথা বলা হয়েছে। কালিদাসের রঘুবংশ অযোধ্যা ও রাম রাজ্যের কথা বলা হয়েছে। গুপ্ত যুগে (২০০-৪০০খ্রী:) রাজা বিক্রমাদিত্য অতীত পুনরুদ্ধারে প্রয়াস করেন। ব্যাপক উন্নতি সাধন করা হয়। সরযু নদীর সংলগ্ন এলাকা এবং জন্মস্থানের প্রভূত সংস্কার করা হয়। তবে সবই বিনষ্ট ও লীন হয় কালের কবলে।

অযোধ্যার রাম মন্দির বিশ্ববন্দিত। এশিয়ার বিভিন্ন দেশে (ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, ফিলিপিন্স) রাম ও রাম জন্মভূমি আজও মহান এবং রাষ্ট্রের প্রাণ স্বরূপ।

এই রাম মন্দিরের উপর আঘাত হানা হয় 1528 সালে বাবরের নির্দেশে এবং সেনাপতি মীর বাকীর নেতৃত্বে। রাম মন্দিরটি ব্যাপকভাবে ধ্বংস করা হয় কামানের সাহায্যে। ভালো মন্দিরের উপর নির্মাণ করা হয় মসজিদ। নাম দেওয়া হয় বাবরি মসজিদ।

আজ থেকে প্রায় 500 বছর আগে থেকে শুরু করে হিন্দু সমাজের সাধু-সন্তরা রাম মন্দির ধ্বংস করে মসজিদের নির্মাণ মেনে নিতে পারেননি।

একাধিকবার সচেষ্ট হয়েছেন। উল্লেখযোগ্য হলো অযোধ্যা সংলগ্ন হিন্দু রাজারা (1528খ্রী:) সংঘর্ষ করেন রাম জন্মভূমিকে পুনরুদ্ধার করার জন্য। পরবর্তীকালে (1934খ্রী:)হিন্দু রাজারা সাধু-সন্ত হিন্দুসমাজ মন্দির পুনরুদ্ধার করতে সচেষ্ট হয়। এর ফলস্বরূপ মসজিদের বড় অংশের ক্ষতি হয়। পরে ইংরেজ প্রশাসন হিন্দুদের থেকে অর্থ সংগ্রহ করে(₹84000) মেরামতের কাজ করে। এর ফলস্বরূপ মসজিদটির নিত্যনৈমিত্তিক নামাজ বন্ধ হয়ে যায়।

শ্রীরামজন্মভূমি ও বাবরি মসজিদ নিয়ে যে বিতর্ক ও সমস্যা, একে কেবলমাত্র সম্পত্তির বিবাদ বলে দেখলে সেটা অনুচিত হবে। বাস্তবে এই লড়াইটি ন্যায় ও সত্যের সংগ্রাম। রাম জন্মভূমি ও মন্দির  ঘিরে হিন্দুধর্মের মূল্যবোধ, সহনশীলতা, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি, দর্শন ও আধ্যাত্মিকতা জড়িয়ে আছে। মুসলমান, খ্রিস্টান ও ইহুদীরা তাদের তীর্থক্ষেত্র মক্কা-মদিনা, ভ্যাটিকান ও জেরুজালেমকে রক্ষা করেছেন ও করেন।

সেই রূপ হিন্দুদের কাছে অযোধ্যার রাম মন্দির। শ্রী রামচন্দ্র হিন্দু দর্শনের (এমনকি রাজনৈতিক দর্শনেরও) প্রাণপুরুষ। তারই পথ অনুসরণ করে হিন্দুর দর্শন-ধর্ম ও জীবন শৈলী একই সূত্রে গাঁথা। সুতরাং অযোধ্যার শ্রীরামজন্মভূমিতে মন্দির রক্ষার জন্য হিন্দুরা যে কোন মূল্য দিতে প্রস্তুত।

আন্দোলনের ইতিহাস শুরুর দিকে

দেশ স্বাধীন হলো 1947 সালে। অযোধ্যার শ্রী রাম জন্মভূমিতে রামলালা বিরাজমান হলেন (12-13 ডিসেম্বর, 1949) তৎকালীন প্রশাসন শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিলো। হিন্দুসমাজ আদালতে যায়। রাম চবুতরা ও সীতা রসুইয়ে পূজার আরজি নিয়ে। যা এতদিন চলে আসছিল। আদালত তাদের প্রার্থনা অনুমোদন করেন। শ্রী রামের  নিত্য পূজা শুরু হয়।

এর পরের বছর (1950 সাল) গোপাল সিংহ বিশারদ আদালতে যান আর্জি নিয়ে যে কেউ যদি রামলালার দর্শন, পূজা ও আরতী করতে আসে তাহলে কোন ব্যক্তিত্ব বা প্রশাসন যেন বাঁধা না দেয়। এর ফলে ব্যবস্থাপনার জন্য একজন প্রশাসনিক কর্তা নিযুক্ত হন। নির্মোহী আখড়া (1959) আদালতে দাবি তোলে যে তাদের শ্রীরাম জন্মভূমির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হোক সরকারি ব্যবস্থার বিলোপ ঘটিয়ে।এরপর  (1961 সালের
18 ডিসেম্বর) উত্তর প্রদেশের সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড আদালতে যান তিন গম্বুজ যুক্ত ধাচাকে সর্বজনীন মসজিদ বলে ঘোষণা করার দাবি নিয়ে।

এরকম একটা মাহেন্দ্রক্ষণ (1964) শ্রীকৃষ্ণ জন্মাষ্টমী তিথিতে সন্দীপন আশ্রম ও সাধনালয়ে বিশ্বহিন্দুপরিষদের স্থাপনা হয়। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের স্থাপনা ও হিন্দুশক্তি জাগরণ ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

উত্তর প্রদেশের মোজাফফরপুর শহরে (1983) প্রথম হিন্দু সম্মেলন আয়োজিত হয়।হিন্দু নেতারা ( বিশেষ করে দাউ দয়াল খান্না) জনতাকে আহবান জানান অযোধ্যা, মথুরা ও কাশির মন্দির গুলিকে পুনরুদ্ধারের জন্য।এরপরই সন্তদের প্রথম ধর্মসংসদ সম্মেলন  ( 1984 7-8 এপ্রিল) হয় দিল্লিতে। সেই সভায় সর্বপ্রথম শ্রীরাম জন্মভূমিকে মুক্ত করার ডাক দেওয়া হয়।

এরপর শুরু হয় জন-জাগরনের কর্মসূচি।সর্বপ্রথমে মুখ্য কর্মসূচি রাখা হয় শ্রীরাম জন্মভূমিতে লাগানো তালা খুলতে হবে এবং হিন্দু-সমাজকে অবাধে পূজা ও আরতির সুযোগ দিতে হবে। সীতামাঢ়িতে রাম-জানকী রথের পূজন হয়। এই রাম জানকী রব আনা হয় ( ১৯৮৪ , ৭ অক্টোবর) অযোধ্যার নদীতটে। রথকে সামনে রেখে হাজার হাজার রামভক্ত হাতে সরযু নদীর পূর্ণ বারি নিয়ে শপথ নেন, “শ্রীরাম জন্মভূমিকে মুক্ত করবেন, প্রয়োজনে প্রাণ দেবেন কিন্তু রামলালাকে দুর্দশা (বন্দি আছেন) থেকে মুক্ত করবেন।

শুরু হয় অযোধ্যার রাম মন্দিরের আন্দোলন

রথযাত্রা দিয়ে রথ-আন্দোলনের পুরোধারা হলেন লালকৃষ্ণ আদভানি, অশোক সিঙ্ঘল(বিশ্ব হিন্দু পরিষদ) ও অযোধ্যার হিন্দু তপস্বী পরমহংস রামচন্দ্র দাস। পরমহংস রামচন্দ্র দাস হলেন সেই ব্যক্তি যিনি অযোধ্যার বাবরি ধাচার কেন্দ্রীয় গম্বুজের ভিতরে রামলালার প্রতিমা স্থাপন করেন।

আর অশোক সিঙ্ঘল হলেন সেই কার্যকর্তা (বিশ্ব হিন্দু পরিষদ) যিনি রাম মন্দিরের আন্দোলনের বিষয়ে প্রথম ধর্মসংসদের(1984) আয়োজন করেন এবং সাধু-সন্ত-রামভক্ত-দর্শনার্থীদের একত্রিত করে রাম মন্দিরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। লালকৃষ্ণ আদবানি ছিলেন রাম-জানকী রথের সারথির ভূমিকায়।

রাম মন্দির ইতিহাস
রাম মন্দির ইতিহাস

রথযাত্রা

রাম-জানকী রথ লখনৌ পৌঁছায় 14 ই অক্টোবর। রথযাত্রা সঙ্গে সঙ্গে জনজাগরণ শুরু হয়। হিন্দু সমাজ ক্রমশই রথের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে। সমাজে আসতে থাকে পরিবর্তন, যা বিরাট হিন্দু জাগরণ রূপে প্রকাশ পায়।

দুর্ভাগ্যবশত এই সময়ে ( 1984 30 শে অক্টোবর ) তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী হঠাৎ খুন হন। সারাদেশ শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। রাম-জানকী রথের যাত্রা এক বছরের জন্য স্থগিত রাখা হয়।

সাধুসন্তদের আগ্রহ অনুযায়ী করসেবা (1990 24 শে জুন) শুরু করার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ করা হয় এবং সেই মতো ঠিক হয় (1990 30 শে অক্টোবর)। অযোধ্যায় পুতজ্যোতি জালানো হয়। “আরণী মন্থন” (কাঠের সাহায্যে অগ্নি প্রজ্বলিত হয়) সাহায্যে। এই পুতময় অগ্নি সারা ভারতের গ্রামে গ্রামে পাঠানো হয়। ক্ষতির আশঙ্কায় আদালতের দ্বারস্থ হয় বাবরি মসজিদ একশন কমিটি।

করসেবা (পর্ব 1)

নানান ঘটনার ঘটনায় রাম ভক্তরা অযোধ্যায় জড়ো হতে থাকে। কারণ এই বার করসেবা শুরু হবে। যার তারিখ অনেক আগেই ঠিক ছিল (30 শে অক্টোবর)। এই করসেবায় নেতৃত্বে দেয় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং সংঘ

ভারতজুড়ে শ্রীরাম রথযাত্রার ঐতিহাসিক মিছিলের গতিরোধ হয় বিহারে লালু প্রসাদের নেতৃত্বে। বলা হয় বিহার রাজ্যের শান্তিশৃঙ্খলাজনিত কারণে রথযাত্রা গতিরোধ।

উত্তরপ্রদেশে মুলায়ম সিং যাদবের নির্দেশে করসেবকদের প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাজ্য সরকারের আদেশে অযোধ্যায় প্রবেশের সমস্ত পথ অবরুদ্ধ ছিল। পরিবহন এর সমস্ত যানবাহন, রেলগাড়ি, বাস ( সরকারি ও বেসরকারি) এবং মোটরগাড়ি বন্ধ যাতে কোনোভাবেই প্রবেশ না করতে পারেন। সারা শহর ও শহরতলীতে নাকাবন্দি করে দেয়া হয় যাতে করে ‘মাছিও না গলতে পারে’।

সরকারের এই কঠোর আচরণ কিন্তু হিন্দুদের মনোবলকে দমন করতে পারেনি, বরং হাজার হাজার করসেবক তৈরি হন অযোধ্যার রাম জন্মভূমির জন্য প্রাণ দিতে

বাবরি মসজিদ
বাবরি মসজিদ

করসেবকরা যাত্রা শুরু করেন, পুলিশ গুলি চালায় ( 2 নভেম্বর 1990)। করসেবকরা শহীদ হন ( সরকারি হিসাবে 10 বেসরকারি হিসাবে অনেক বেশি)। যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কলকাতা নিবাসী দুই সহোদর ভাই শ্রীরাম কোঠারি ও শ্রীশরৎ কোঠারি।

দিনের শেষে সরকার বাধ্য হন করসেবকদের অনুমতি দিতে দর্শনের জন্য। কারণ করসেবকরা বদ্ধপরিকর ছিলেন, রামলাল আদর্শ না করে ফিরবেন না। সম্পূর্ণ নিরস্ত্র, নিরপরাধ ও শান্তিপূর্ণ করসেবকদের উপর গুলি চালালে সত্যাগ্রহ শুরু হয় এবং রোজ শতাধিক মানুষ এতে যোগদান করেন। দিল্লির বোটক্লাবে ( 4 এপ্রিল 1991) এক বিশাল ভারত হিন্দু সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। বিশাল জনসমাবেশ 25 লক্ষ লোকের বেশি।

এই জনসভা শেষ হবার আগেই উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিং যাদব পদত্যাগ করেন। প্রদেশ আবার নির্বাচন হয়। কল্যাণ সিং সরকার ক্ষমতায় আসেন। উত্তর প্রদেশের সরকার 42 একর জমি অধিগ্রহণ করেন (বির্তকিত ধাচার 2.6 একর ছাড়া) এবং “শ্রীরামজন্মভূমি  ন্যাসকেপ্রদান করেন

করসেবা পর্ব 2

রাম পাদুকা পুজো শুরু করা হয় (সেপ্টেম্বর 1992) সারা দেশজুড়ে এবং পুনরায় রাম-ভক্তদের আহবান করা হয় অযোধ্যা করসেবার জন্য। দিল্লিতে পঞ্চম ধর্ম সংসদের আয়োজন করা হয় (29-30 অক্টোবর 1992)। ঘোষণা করা হয় সরকারের অধিকৃত জমিতে বির্তকিত ধাচার (2.6 একর) পুনরায় করসেবা শুরু করা হবে। দিনটি ঠিক হয় ‘গীতা জয়ন্তী’ (6 ডিসেম্বর 1992)।

এলাহাবাদ হাইকোর্ট

রামজন্মভূমি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা মামলার রায় ঘোষণা করার তারিখ ছিল 3 ডিসেম্বর। যা পিছিয়ে দেওয়া হয় 11 ডিসেম্বর পর্যন্ত। ফলস্বরূপ তখন অযোধ্যায় উপস্থিত প্রায় এক লক্ষ করসেবকদের মধ্যে ভীষণ অস্থিরতা তৈরি হয়। 5 ডিসেম্বর অযোধ্যায় প্রায় 5 লক্ষ করসেবক উপস্থিত হন।

শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে কেন্দ্রের 25000 আধাসামরিক বাহিনী নামানো হয়। কল্যান সিংহ ঘোষণা করেন করসেবকদের উপর গুলি চালানো হবে না। করসেবকদের মধ্যে আক্রোশ ছিল লখনৌ বিচার পিঠের রায়ের তারিখ পিছিয়ে দেওয়ার জন্য।

অশোক সিংহাল, লালকৃষ্ণ আদ্ভানি, রামচন্দ্র দাস, ওমা ভারতী, বিনয় কাঠীয়া, গিরিরাজ কিশোর ও বিভিন্ন সাধু-সন্তরা “শ্রীরাম করসেবা সমিতি র বৈঠক করেন। সংকল্প নেওয়া হয় প্রতিকী করসেবা হবে এবং আদালতের রায়ের জন্য অপেক্ষা করা হবে। বলা হয় 6 ডিসেম্বর বেলা 12 টা 15 মিনিটে করসেবা শুরু হবে। সমস্ত করসেবককে শান্ত অনুশাসনের মধ্যে থাকতে বলা হয়।

বিচারালয়ের দীর্ঘসূত্রিতা ও সরকারের টালবাহানার জন্য শান্তিপ্রিয় করসেবকদের মন ভারাক্রান্ত ও নিদারুন চাপের মধ্যে ছিল।এই মনোকষ্ট নিয়ে করসেবকরা পবিত্র সুরময় তট থেকে যাত্রা শুরু করে শিলান্যাসস্থলে চলে আসেন। ঘড়িতে কাঁটা তখন দুপুর বারোটা, বিশাল সংখ্যক প্রায় এক লক্ষ করসেবক শ্রীরাম জন্মভূমির শিলান্যাস স্থানে জড়ো হন। দূরে সভা হচ্ছিল। লালকৃষ্ণ আদভানিজী  অন্যান্য নেতারা মাইকে বার বার ঘোষণা করেছিলেন করসেবা প্রতীকী হবে এবং অনুশাসনে থাকতে হবে।

এককথায় সভায় থাকা করসেবকরা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। কিছু সংখ্যক করসেবক বাবরি মসজিদের  দিকে চলে যায় এবং হাতের কাছে যা পায় তা দিয়ে বাবরি মসজিদকে  প্রহার করতে থাকে। প্রশাসন প্রথমে বাধা দিলেও পরে তারা হাল ছেড়ে দেয়। দেখতে দেখতে সসস্ত্র করসেবক ধাচার গম্বুজে উঠে পড়েন। চারিদিকে তখন একটাই ধ্বনি একই নারা একই নাম জয় শ্রীরাম জয় শ্রীরাম।” পুরনো চুন-সুরকির তৈরি ধাচাটি কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপ সরানো হয়। অস্থায়ী মন্ডপ তৈরি করা হয়। শ্রী রামকে মন্দিরে  প্রতিষ্ঠা করা হয়। ঘটা করে পূজা-অর্চনা আরম্ভ করা হয়। আজও রামলালা মন্দিরে বিরাজমান।

পরেরদিন কেন্দ্রীয় সরকার কার্ফু জারি করেন। করসেবকরা স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হন। বিতর্কিত বাবরি মসজিদটি ধুলিস্যাৎ এর ফলে হিন্দু বিরোধী শক্তি সহিংস হয়ে ওঠে। সারাদেশের জাতিদাঙ্গা বেঁধে যায়। প্রায় 2 হাজার লোকের জীবন নাশ হয়। দেশের 135 টি শহর শহরতলীতে কার্ফু লাগানো হয়।

কেন্দ্রীয় সরকার রাম জন্মভূমি অধিগ্রহণ করেন। কেন্দ্রীয় সরকার হিন্দু বিরোধী শক্তিকে সন্তুষ্ট করার জন্য রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও তার সংযোজক আয়াম বজরং দলের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে ( 10 ডিসেম্বর 1992)।এর চার দিন পর 15 ই ডিসেম্বর রাজস্থান, হিমাচল প্রদেশ ও মধ্য প্রদেশের ভারতীয় জনতা পার্টির সরকারকে বরখাস্ত করা হয়। সেই থেকে অযোধ্যায় রাম জন্মভূমিতে দর্শনের উপর বাধা ও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।

আদালতে রাম জন্মভূমি

রামজন্মভূমি বিতর্কিত বাবরি মসজিদ ধাচার বিলোপনের ঠিক একমাস পরে (7 জানুয়ারি 1993) তৎকালীন ভারতের রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টে একটি প্রশ্ন করে তার উত্তর চেয়ে পাঠান। যার মূল প্রতিপাদ্য ছিল অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ তৈরি হবার পূর্বে কি কোন হিন্দু মন্দির বা ধর্মস্থান ছিল? এই মন্দির ভেঙে কি ধাচাটি তৈরি করা হয়েছে?

এই সময় (1993) অযোধ্যা রামজন্মভূমির জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে মুসলমান সমাজ সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়। মামলার রায়ে (অক্টোবর 1994) সুপ্রিম কোর্ট রাষ্ট্রপতিকে তার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি । সেই সঙ্গে আদালত বিতর্কিত বাবরি মসজিদ  ও রাম জন্মভূমির অধিগ্রহণ রদ করে। কোর্ট ভারত সরকারকে বিতর্কিত ধাচা ও ভূমির স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে এবং সমস্ত স্থানটিকে নিরাপত্তা প্রদান করতে বলেন। যদিও কোর্ট অবশিষ্ট জমির অধিগ্রহণ সঠিক বলেছিলেন।

উত্তর প্রদেশের হাইকোর্টের লখনৌ বিচারপিঠ রামজন্মভূমি সংক্রান্ত সকল মামলাগুলোকে একসঙ্গে শোনার জন্য তিন ন্যায়াধীশকে নিয়ে এক পূর্ণবিচারপিঠ তৈরি করেন (1995) বিতর্কিত ধাচার বিতর্কের মূল রহস্যকে ( বিতর্কিত মূলের মাটির নিচে প্রাচীন সত্য অর্থাৎ হিন্দু মন্দির বা উপাসনা স্থল ছিল কিনা) জানার জন্য লখনৌ ন্যায়াধীশের বিচারপিঠগন রাডারের তরঙ্গের দ্বারা মাটির তলায় অবস্থিত মন্দিরের ভগ্নাবশেষের ছবি তোলার জন্য আদেশ দেন( পহেলা আগস্ট 2002)।

জমির তলার নিরীক্ষনের কাজটি করেন বিদেশের একটি সংস্থা। এই বিজ্ঞানভিত্তিক অনুসন্ধান এর ফলে যে তথ্য পাওয়া যায় তা প্রচলিত সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে। মাটির তলার ছবি থেকে এটা পরিষ্কার হয় যে বিতর্কিত ধাচার নিচে অনিয়মের চিহ্ন আছে। এই চিহ্ন গুলি হল স্তম্ভ, দেওয়াল, ঢালাই করা পাথর বসানো মেঝে রয়েছে ইত্যাদি।

এই চিহ্ন গুলি সবই সুপ্রাচীন। রাডার ফটোগ্রাফিতে প্রাপ্ত সত্যকে পুনঃ যাচাই করার জন্য কোর্ট ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগকে ওই স্থানে খননের আদেশ দেন। এই খননকার্যের নির্দেশ ছিল আগের রাডার বিবৃতিতে এবং শুরু হয় এই বছরেই ( 23 শে অক্টোবর 2002)। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ তাদের খনন কাজের বিবরণ আদালতে জমা করেন ( 22 শে আগস্ট 2003)।

যে তথ্য সামনে আছে তার থেকে সত্য আরও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। রাডার তরঙ্গের আলোকচিত্র ভিত্তি এবং ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের দ্বারা প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজের তথ্যে এটা পরিষ্কার হয় যে মাটির নিচে এক বিশাল সুপ্রাচীন ভবনের অবশেষ রয়েছে। এই খননকার্যের ধ্বংসাবশেষ থেকে একাধিক ভাস্কর্য (পদ্মফুল, দেবদেবীর মূর্তি, খোদাই-করা ইট) পাওয়া যায় যা দেখে সহজেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় যে বিতর্কিত ধাচার নিচে উত্তর ভারতীয় শিল্পরীতির একটি হিন্দু মন্দির ছিল।

রাম মন্দির ইতিহাস
রাম মন্দির ইতিহাস

 রাম জন্মভূমি এর উপর সন্ত্রাসবাদীদের হামলা হয় (5 জুলাই 2005) রামলালর কৃপায় কোন অঘটন ঘটেনি এবং বিস্ফোরণও হয়নি।

রাম জন্মভূমি মন্দির নির্মাণ সমিতি সারাদেশ জুড়ে (2006) হিন্দু সম্মেলন করেন। প্রয়াগের অর্ধ কুম্ভ (13 ই জানুয়ারি 2008)  দ্বাদশ ধর্ম সংসদ আয়োজন করা হয় এবং সর্বসম্মতিক্রমে যেখানে রামলালা বিরাজমান সেখানেই ভব্য মন্দির করার সংকল্প নেওয়া হয়। হরিদ্দারে পূর্ণ কুম্ভ (6 এপ্রিল 2010 ) আয়োজিত সাধুসন্তদের মহাসম্মেলনে শ্রী রাম জন্মভূমিতে মন্দির নির্মাণ নিয়ে পুনরায় সংকল্প নেওয়া হয় এবং সারা ভারতে হনুমান শক্তির জাগরণ কার্যক্রম করার কথা বলা হয় মন্দির নির্মাণ দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

এলাহাবাদ হাইকোর্টের লখনৌ বিচার পিঠ রাডার ফটোগ্রাফির প্রাপ্ত তথ্য এবং ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রমাণের ভিত্তিতে রায় দেন (30 সেপ্টেম্বর 2010)। বিচারপতিরা বলেন পুরাতন হিন্দুধর্ম স্থান ও ভবন ভেঙে বিতর্কিত ধাচা তৈরি করা হয়েছিল। বিতর্কিত ধাচাটি বাবরের নির্দেশে তৈরি হয়েছিল। তিনটি গম্বুজ যুক্ত নাচার কোন পতিত জমিতে তৈরি করা হয়নি। এটি অবৈধভাবে হিন্দু মন্দিরের উপর তৈরি করা হয়েছিল।

সেই সঙ্গে নির্মোহী ( 1959 সালে দায়ের করা মামলা) ও সুন্নি ওয়াকআপ বোর্ড ( 1961 সালে দায়ের করা মামলা) মামলাগুলি খারিজ করে দেন। পরিশেষে বিচারপতিরা বিতর্কিত ভূমিকে তিন অংশে বিভাজিত করে সমান অংশে রামলালা, নির্মোহী আখড়া ও সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে ভাগ করে দেয়। যদিও এই মামলাটি জমি বাটোয়ারা বিষয়ক ছিলনা।

সুপ্রিমকোর্টে রাম জন্মভূমি

হাইকোর্টের জমি ভাগের রায় ন্যায়সঙ্গত ছিলনা। সুপ্রিম কোর্টে সনির্বন্ধ আবেদন করা হলে (ডিসেম্বর 2010) আবেদনের শুনানি দীর্ঘদিন ঝুলে রইল (জুলাই 2017)। মামলাটি কোর্টে উঠলো (সেপ্টেম্বর 2017)। সমস্যা দেখা দিল বহু ভাষাভিত্তিক (হিন্দি, উর্দু, সংস্কৃত, ফারসি ও পারসিক) দলিল দস্তাবেজ। যার ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ প্রয়োজন। কারণ সুপ্রিমকোর্টের কার্যক্রম ও ইংরেজি ভাষায়। উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকার চারমাসে দস্তাবেজ (14 হাজার পৃষ্ঠা) অনুবাদ করে দেন।

আদালতে শুনানি শুরু হয় 29 শে অক্টোবর 2018। বিচারালয় মামলাটি গুরুত্বপূর্ণ নয় বলে শুনানি স্থগিত রাখেন জানুয়ারি 2019 পর্যন্ত। বলা হয় পাঁচ সদস্যের বিচার পিঠ ওই মামলাটি শুনবেন। বার্তালাপ এর মাধ্যমে সমাধান সূত্র বের করার জন্য ইচ্ছে প্রকাশ করেন। তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। 6 মাস সময় দেওয়া হয়। আদালত 6 আগস্ট থেকে আবেদনের নিয়মিত শুনানির আদেশ দেন। টানা 40 দিন ধরে শুনানীর প্রশ্নোত্তর পর্ব চলে। এই পর্ব চলাকালীন উভয় পক্ষের বার্তালাপ এর কথা ওঠে কিন্তু রামলালার পক্ষ এর বিরোধিতা করেন এবং পত্র দিয়ে জানিয়ে দেন। শুনানি শেষ হয় 16 ই অক্টোবর। বিচারালয় ঘোষণা করে যে চূড়ান্ত নির্ণয় সুরক্ষিত।

সুপ্রিম কোর্ট রায় ঘোষণা করেন 1045 পৃষ্ঠার 9 নভেম্বর 2019। বলা হয় শ্রীরামচন্দ্র বিতর্কিত স্থানেই জন্মেছেন। এ নিয়ে যুক্তি নয়; বিশ্বাস, আস্থা ও উপলব্ধি মুখ্য। হিন্দুরা স্মরণাতীত কাল থেকে রামচবুতরা ও সিতারসুইয়ে পূজার্চনা করে এসেছেন। বিতর্কিত ধাচার নিচে প্রাচীন মন্দিরের অবশেষ পাওয়া গেছে যা বিজ্ঞানভিত্তিক। যেটি উত্তর ভারতীয় হিন্দু ধর্ম পূজা মূলের পরিচয় বহন করে। সুতরাং সমগ্র রাম জন্মভূমি হিন্দুদের দেওয়া হল।

ভারত সরকারকে রাম মন্দির নির্মাণের জন্য একটি ন্যাস ( কমিটি ) তৈরি করতে বলা হয় তিন মাসের মধ্যে। যার মধ্যে নির্মোহী আখড়াকেও নিতে বলা হয়। অযোধ্যার মধ্যে 5 একর জমি দিতে বলা হয় যেখানে মসজিদ নির্মাণ করা হবে।

উপসংহার

রাম জন্মভূমির নিষ্পত্তি ভারতবর্ষের জন্য এক নতুন অধ্যায়। আজকের ভারতবর্ষের যখন জাতীয়তাবাদী বনাম বাম-ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির লড়াই চলছে তখন আরো একবার জাতীয়তাবাদীদের জয় হল। কারণ রাষ্ট্রকে কেবল ভূখণ্ড নয়। বরং ওই ভূমিতে জন্মগ্রহণকারী এক জনগোষ্ঠীর একাত্মতার ভাবনা। এই একাত্মতাই ইতিহাস, পরম্পরা ও সংস্কৃতির নির্মাতা। তাই ভারতীয়রা জাতীয়তাবাদী অহিংস এবং সহিষ্ণু। যার জন্য হিন্দুসমাজ সবাইকে মর্যাদা ও সম্মান দিয়ে চলে।

ফলে এরা এরপরে কোন বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস ও আক্রমণাত্মক ভাষা ও ভঙ্গি দেখা যায়নি। বাস্তবে এই রায়ে কেউ পরাজিত হয়নি কারণ শ্রী রাম জন্মভূমি মন্দির নির্মাণ মন্দিরমসজিদ নয় বা হিন্দু-মুসলমান সংঘর্ষ নয় –এটা সত্যের জয়।

বর্তমান প্রজন্মের প্রত্যাশা অনেক। আমরা অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি। আরো অনেক পথ যেতে হবে। প্রাচীন ঋষি বলেছিলেন “চরৈবেতি চরৈবেতি”। বর্তমান পৃথিবীর অশান্ত, যার ছায়া আমাদের দেশেও পড়ছে। রাস্ট্র বিমুখ শক্তি প্রকাশ পাচ্ছে। সুতরাং প্রয়োজন সদিচ্ছা, প্রয়োজন সাক্ষরতা, প্রয়োজন শুভবুদ্ধি এবং প্রয়োজন জন-হিন্দু জাগরণ। চাই বিকাশ ও উন্নয়ন। সুতরাং সেকিউলারবাদীদের খন্ডিত ভারতবর্ষে চাই না, চাই সকলের বিকাশ ও সৃজনশীল সমাজ। সুতরাং ভারত নির্মাণের কাজ (সঙ্গে মন্দির নির্মাণের কাজ) যত এগোবে, সমাজে মর্যাদা, বিকাশ, সমরসতা, স্থিতিশীলতা ও হিন্দু শৈলীতে জীবনযাপন ততই সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। নতুন প্রজন্ম পাবে শক্তি, বল ও সাহস। ভারত আবার জগৎসভায় ‘শ্রেষ্ঠ আসন লবে’।

শ্রীরাম জন্মভূমির আন্দোলনের ইতিহাস ও তার পরিণতি আরো একবার প্রমাণ করলো হিন্দু জনজাগরণ ও তার সংহতি ক্ষমতার উৎস।এই জনজাগরণ, সংহতি ও একতা সঠিকভাবে বজায় থাকলে ও দিশা পেলে ভারতবর্ষের ইতিহাস সহজেই নতুন করে লেখা যাবে যা এতদিন মূলত সেকুলার বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছে এবং তারাও ইতিহাসকে বিকৃত করেছেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here