অকালবোধন|সুরথ রাজা ও রামচন্দ্রের দুর্গাপূজা|বোধন শব্দের অর্থ

1
520

অকালবোধন কেন বলে এবং বোধন শব্দের অর্থ

যদি আশ্বিনের অর্থাৎ শারদীয়া দূর্গা উৎসব অকালবোধন হয় তবে, কালের বােধন কোনটা ? আর এই বোধন শব্দের অর্থই বা কি? অনেকে ইঙ্গিত করেন চৈত্র মাসের বাসন্তী উৎসবের দিকে। চৈত্র মাসে বাসন্তী পুজো হয় বটে, কিন্তু সে পুজোয় তাে বােধনই নেই। কালী, কাত্যায়নী, হৈমন্তী, জগদ্ধাত্রী পুজোতেও বােধন নেই— অধিবাস আছে মাত্র। সত্য কথা, বোধন শব্দের অর্থ জাগরণ। অকাল বােধন বলতে অসময়ে জাগরণ বােঝায়। বিষ্ণু প্রভৃতি দেবতাদের গাত্রোত্থানের সময় হল জগদ্ধাত্রী বিসর্জনের পরবর্তী উত্থান একাদশী তিথিতে। এই তিথিই হচ্ছে কালের বােধন। কিন্তু অসময়ে দুর্গাকে জাগানাে হয় বলেই আশ্বিনের বােধনকে অকাল বােধন বলে।

বলা বাহুল্য, আশ্বিনেই মহিষাসুরমর্দিনী মুর্তিতে দুর্গোৎসবের যথার্থ সময়। শরৎ ঋতুতে এই উৎসব হয় বলে কেউ কেউ একে ‘শারদীয় দূর্গোৎসব’ বলে। কিন্তু দুর্গার এক নাম হচ্ছে শারদা’। শরদ অর্থে জ্ঞান, ‘শারদ’ অর্থে জ্ঞানী, “শারদা স্ত্রী লিঙগবাচকা শব্দ। আশ্বিনের সিতসপ্তমী ছাড়া অন্য সময়ে মহিষাসুরমর্দিনী বিগ্রহে দুর্গোৎসব হতেই পারে না। কারণ, অন্য সময়ে মহিষাসুরকে পাওয়া যায় না। চৈত্রে সপরিবার হর-গৌরীর পূজা প্রশস্ত। মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তির দুই দিকে গণেশ-কার্তিক-লক্ষ্মী-সরস্বতীর বিগ্রহ বসানাে শ্রীশ্রী চণ্ডীদ্বেষণা মাত্র। মহিষাসুর মর্দনে এই চারজনের কোনােই ভূমিকা নেই। তবে মহিষাসুরমর্দিনী বিগ্রহের দুই দিকে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-পঞ্চানন-ইন্দ্র-অগ্নি-পবন থাকতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে আপত্তি না থাকারই কথা। শ্রীরাম কর্তৃক দুর্গার অকালবোধন কৃত্তিবাসের কথা মাত্র। সংস্কৃত রামায়ণে রাম-কর্তৃক মহিষাসুরমর্দিনী পুজোর কথা নেই, আশ্বিনে অকাল বােধন তাে দুর অস্ত।

সুরথ রাজা ও দুর্গাপূজার অকালবোধন

একথা সত্য, শ্রীশ্রী চণ্ডীতে সুরথ রাজা এবং সমাধি বৈশ্য-কর্তৃক মহিষাসুরমর্দিনী পুজোর কথা আছে। কিন্তু কোন ঋতুতে তার কোনাে উল্লেখ নেই। যেহেতু অন্য ঋতুতে মহিষাসুরমর্দন হয়নি সেহেতু সুরথ রাজা এবং সমাধি বৈশ্য আশ্বিনেই মহিষাসুরমর্দিনী বিগ্রহে দুর্গোৎসব করেছিলেন। যদিও এই পুজো ঋগ্বেদীয় যুগ থেকেই প্রচলিত ছিল। এই বিষয়ে আলােকপাত পরে করব। তার আগে খুঁজে বের করতে হবে সুরথ ও সমাধি কোথায় বােধন করেছিলেন?

রামচন্দ্রের অকালবোধন
রামচন্দ্রের অকালবোধন

সুরথ রাজা ও সমাধি মহিষাসুরমর্দনের কথকতা শুনেছিলেন— দেখেননি। যে আশ্রমে বসে কথা শুনেছিলেন বােধন সেই আশ্রমেই হয়। আশ্রমটি পুষ্পভদ্রা নদীর কুলে বালুকাময় ভূমিতে। পুষ্পভদ্রা নামে নদী কোথায়? এই নামে নদী আছে হিমালয় পর্বতমালার পশ্চিম অংশে। পুজো শেষে সুরথরাজা অশ্বপৃষ্ঠে আরােহণ করে স্বীয় রাজধানীতে প্রত্যাগমন করেন। কিন্তু এই পুষ্পভদ্রা নামে নদী-অঞ্চলে অশ্বপৃষ্ঠে যাতায়াত চলে না। ভারতের তুঙ্গভদ্রা নদীর কথা সবাই জানে, কিন্তু পুস্পভদ্রা নামে নদী কি ছিল বা আছে? ভারতবর্ষে একই নামে একাধিক নদীকে পাওয়া যায় বলেই এই প্রশ্ন উঠছে। যমুনা নামে গােটা পাঁচেক নদীর কথা পাওয়া যায়। সরস্বতী নামে গােটা দুই তাে আছেই। আবার অলকানন্দা নামেও গােটা দুই নদী তাে বটে। ঐতিহাসিক সুধীর কুমার মিত্র বর্তমান কুন্তী তথা কানা নদীর পূর্ব নাম লিখেছেন ‘পুষ্প শিপ্রা’ নদী। কিন্তু এই নাম ঠিক মনে হয় না। মধ্যভারত অঞ্চলের শিপ্রা নদীর কথা সকলের জানা। যমুনা- সরস্বতী-অলকানন্দা হিমালয়াগত নদী। তাই মনে হয়, কুন্তীর নামই পুস্পভদ্রা। (নবদ্বীপ অঞ্চলে অলকানন্দা, ত্রিবেণী ক্ষেত্রে হূগলী জেলায় সরস্বতী এবং চব্বিশ পরগণায় যমুনা।) তাই কুন্তীর মােহনায় ত্রিবেণী অঞ্চলেই ঋষির আশ্রম থাকা স্বাভাবিক।

মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর বর্ণনা থেকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। এই স্থান হতেই অশ্বপৃষ্ঠে আরােহণ করে সুরথ রাজা নিজ রাজধানীতে ফিরে যান। রাজধানীর নাম ‘কোলা’। দামােদর প্রবাহ পথে বর্তমান বর্ধমানের একটি সমৃদ্ধ গ্রাম। অতীতে বর্ধমান নগরটি ছিল অস্থিক গ্রামে। চণ্ডীর বর্ণনায় কোলা রাজধানী যবন কর্তৃক অধিকৃত হয়। পুষ্পপুর তথাকুসুমগ্রাম কিন্তু যবন কর্তৃক অধিকৃত হয়নি। যবনেরা কোলা অধিকার করে নাম দিয়েছিল পার্থেনিস। নামটি যে পার্থিয়ান গ্রীক যবনদের দেওয়া তা সহজেই বােঝা যায়। গ্রিক যবন আলেকজাণ্ডার বৃহৎবঙ্গে আসেননি। এসেছিলেন মনেন্দার। কোনাে কোনাে গবেষক মনে করেন সুরথের বাড়ি গৌড় এবং সমাধির বাড়ি ছাটিগ্রাম অর্থাৎ চট্টগ্রামে। কিন্তু এই তথ্য ঠিক মনে হয় না। গ্রীক যবন কর্তৃক গৌড় দখল হয়নি। তাছাড়া গৌড় কোনাে প্রাচীন শহর নয়। বারেন্দ্রে প্রাচীন শহর হচ্ছে পৌন্ড্রবর্ধন। সমাধি বৈশ্যের বাড়ি চট্টগ্রামের বদলে সপ্তগ্রামে হওয়াই সম্ভত। ত্রিবেণী নতুন কোনাে শহর নয়, প্লিনির ভ্রমণ কথায় এই নামটি আছে, যদিও সােনারগাঁও অঞ্চলে আর একটি ত্রিবেণী আছে। আবার বর্ধমানে সুরথগড় বলে একটি জায়গা আছে যা মঙ্গলকোটের ন্যায় হরপ্পা সভ্যতার ঐতিহ্য বহন না করলেও প্রাচীনতায় কম কিছু যায় না। সুরথ নামে একজন বিখ্যাত রাজা যে ওই অঞ্চলে ছিলেন তা অবশ্য বােঝা যায়। যাইহোক কোথায় করেছিলেন তা জানা না গেলেও সুরথ রাজা যে দুর্গার অকালবোধন করেছিলেন তা জানা স্পষ্ট।

রামচন্দ্রের দুর্গাপূজা (অকালবোধন)

পিতৃপক্ষ শেষ দেবিপক্ষের শুরু অর্থাৎ, মহালয়া থেকেই দেবীর পূজার প্রারম্ভ হয়। এটি আসলে আমরা শ্রীরামচন্দ্রের অকালবোধনের অনুকরণ করে থাকি। হ্যা, দেবী দুর্গার অকাল বোধনের বিষয়ে রামচন্দ্রের কথা এড়িয়ে যাওয়া যায় না। বর্তমানে বাংলা জুড়ে তথা বিশ্বজুড়ে যে দুর্গাপুজো শরতকালের অনুষ্ঠিত হয় বলা যেতে পারে তা রামচন্দ্রের সময় থেকেই উৎপত্তি ঘটেছিল। এখন রামচন্দ্র অকালবোধন দুর্গাপুজোর বিষয় অবশ্যই আলোচনা করাটা আমাদের প্রয়োজন। আমরা সকলেই জানি ভগবান শ্রীরামচন্দ্র লঙ্কেশ্বর রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন তার স্ত্রী সীতাকে উদ্ধার করার জন্য। রাবণ ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী এবং মহাদেব ও অম্বিকা দেবীর আশীর্বাদধন্য পুরুষ। দেবী পার্বতীকে বাসন্তী পূজার মাধ্যমে রাবণ তুষ্ট করেছিলেন এবং বরপ্রাপ্ত হয়েছিলেন যে কোন বিপদ থেকে মা দুর্গা তাকে উদ্ধার করবেন। লক্ষণ হনুমান এবং অন্যান্য বীর যোদ্ধার সেনা সামন্তদেরকে নিয়ে রাবণসেনাদের পরাস্ত করলেও রাবনকে কোন মতেই পরাস্ত করা যাচ্ছে না।একবার হনুমানের হাতে প্রহৃত হয়ে রাবণ সংজ্ঞা হারান কিন্তু দেখা গেল মা হৈমবতী এসে কালীরূপে রাবণকে কলে তুলে নিলেন।

অকালবোধন
অকালবোধন

অবস্থা বেগতিক দেখে সেই সময়ে রাম ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন। ব্রহ্মা তখন শ্রী রামকে আদেশ দিলেন দূর্গা পুজা করার জন্য। কিন্তু এই সময় তো দেবদেবীদের শয়নের সময়। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো যে পৃথিবীতে 24 ঘন্টায় 1টি দিন ও রাত সংগঠিত হয়। কিন্তু দেবতাদের একদিন ও রাত সংঘটিত হয় পৃথিবীর হিসাবে এক বছরে। শ্রাবণ থেকে পৌষ মাস পর্যন্ত যখন সূর্যের দক্ষিণায়ন ঘটে তখন দেবতাদের রাত্রি এবং মাঘ থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত যখন সূর্যের উত্তরায়ন থাকে তখন দেবতাদের দিন সংঘটিত হয়। অর্থাৎ এই আশ্বিন মাস বা শরৎকালের দেবতাদের নিদ্রা সময়। আগেই বলেছে বোধন শব্দের অর্থ জাগানো। তাহলে এই সময় দেব দেবীদেরকে তাদের ঘুম থেকে জাগাতে হোলে অকালবোধন করতে হবে। রাম ব্রহ্মাকে যখন এই কথা জানান তখন ব্রহ্মা রামকে বলেন আমি তোমাকে বিধান দিচ্ছি তুমি দেবী দুর্গাকে পুজো করো সেই পারে একমাত্র তোমাকে রাবণকে বধ করার বর দিতে।

যথাবিহিত তাই হল। শুক্লাপক্ষের সন্ধ্যার সময় বেল তলাতে দেবীর বোধন হল। রাম নিজেই নবপত্রিকা বাধলেন। প্রভাতে স্নান শেষে সপ্তমীর দিন থেকে শ্রীরামচন্দ্র দেবীর পূজা শুরু করলেন। পূজা চলল অষ্টমী তিথি পর্যন্ত; পূজা হলো চণ্ডীপাঠের মাধ্যম দিয়ে তন্ত্র মন্ত্র সহ। সেখানে আছে বনফুল বনফলের সমাহার। অষ্টমী-নবমীর সন্ধিক্ষণে রামচন্দ্র সন্ধ্যাপুজা করলেন। কিন্তু এই তিথিতে ও দেবীর আবির্ভাব ঘটল না। নবমী তিথিতে বিভীষণ বললেন নীলকমল দিয়ে মাকে পুজো করলে নিশ্চয়ই মা সন্তুষ্ট হবেন এবং শ্রী রামচন্দ্রের সামনে অধিষ্ঠিত হবেন। কিন্তু এই নীলপদ্ম ধরাধামে একমাত্র দেবীদহ হ্রদে পাওয়া যায় যেখান থেকে আনা অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার কারন দেবিদহ হ্রদ ছিল লঙ্কা থেকে বহুদুরে। কিন্তু সংকটমোচন শ্রীহনুমান এই অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেললেন। হনুমান ১০৮টি নীলপদ্ম নিয়ে উপস্থিত হলেন। শুরু হলো নবমী তিথিতে মা দুর্গার আরাধনা। কিন্তু একই সেখানে এক ১০৮ টি পদ্মের জায়গায় ১০৭ টি পদ্ম মিলল; একটা অমিল কেন। রামচন্দ্র ও তার প্রতিজ্ঞায় অনড় দেবী মাকে তিনি সন্তুষ্ট করবেনই। রামচন্দ্র নির্ণয় করলেন যে তার অক্ষিদ্বয়ও তো নীল। সুতরাং তিনি একটি নীলপদ্ম যা অমিল ছিল তা তার অক্ষি দান করে মাকে সন্তুষ্ট করবেন। সেইমতো রামচন্দ্র নিজের চোখ উপড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং মা এসে সেই সময় তার হাত আটকে ধরেন এবং রামচন্দ্র মায়ের বর প্রাপ্ত হলেন। আর তারপর রাবণকে বধ করলেন নবমী তিথিতে। এই ভাবেই রামচন্দ্রের দ্বারা মা দুর্গার অকাল বোধন হয়েছিল। বিজয় দশমীতে রাবণের চিতা জ্বলল। এভাবেই মায়ের অকাল বোধনের মাধ্যম দিয়ে রাম রাবণের যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা হয়। আর এই উপলক্ষ্য করে রামচন্দ্রের (অকালবোধন) দুর্গাপূজা সূচনা হয়।

শারদীয়া দুর্গাপূজাকে কালের বোধন বলা যায় কি

ঋকবেদে অহনা দেবীর উল্লেখ আছে। এই অহনা হলেন উষা দেবীর নামান্তর। উষা দুই প্রকার। পার্থিব উষা বা নিত্য উষা, অন্যটি হলেন দৈবী উষা। উষাকে দক্ষিণা উষা বলা হয়েছে ঋথ্বেদের ১/১২৩/১-৪ ঋকে। গ্রিকগণের অথিনা এবং হিন্দুদের অহনা একই দেবী। গ্রিস দেশে গ্রিকগণের মধ্যে সিংহবাহনা মহিষাসুরমর্দিনী প্রত্নতত্ত্বের কোদালে উঠে এসেছে। তবে, এই গ্রিক কিন্তু আলেকজণ্ডার-মনেন্দারের সময়কার গ্রিক নয়, আরও দেড়-দুই হাজার বৎসর আগেকার গ্রিক, পারস্যরাজ দারাউসের চাইতেও অধিক প্রাচীন যুগের মানুষ। এই দক্ষিণায়ণ কালের উষা অহনা দেবী হলেন পরবর্তীকালে দশোভূজা দুর্গা এবং সুরথ-সমাধি কর্তৃক পুজিতা। উষা নিজে জাগ্রতা হয়ে দ্বিপদ-চতুষ্পদ জঙ্গম ও দেবতাগণকেও জাগরিত করেন। প্রাচীন ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরে শ্রীশ্রী চণ্ডী রচিত হয়েছে গুপ্ত যুগে। মনে রাখতে হবে, এই দুর্গা মহিষাসুরমর্দিনী কিন্তু কুমারী–বিবাহিতা ও বাগদত্তা নহেন।

দেবীর পূজায় সাত সমুদ্রের জল ব্যবহার হয় মহাস্নানে। দুধ-দই-ঘৃত-মধু-লবন-চিনি-ইক্ষুরস এই সাতটিকে জলে মিশ্রিত করলে সপ্তসমুদ্রোদক হয়। প্রাচীন যুগে তাে সাবান ছিল না, তখনকার মানুষেরা সরিষার খৈল ও মাটি দিয়ে কেশ-গাত্র-মার্জন- প্রক্ষালন করত। দেবীর মহাম্নানে নববিধ মাটি লাগে, তন্মধ্যে বেশ্যাদ্বার মৃত্তিকা একটি। এখানে বেশ্যা অর্থে গণিকা মােটেই না। ‘বি’ অর্থে বিশেষ, ‘শী’ অর্থে বিদ্বান, ‘বি’ যােগ শী’ অর্থ বিশেষ বিদ্ধান বা বিশেষজ্ঞ। বিশেষ বিদ্বান বা বিশেষজ্ঞ। আ-কার অন্তঃ স্ত্রী লিঙ্গে বেশ্যা শব্দ নিষ্পন্ন হয়। অতএব এখানে বেশ্যা অর্থ বিদূষী-পণ্ডিত বিশেষজ্ঞা-বিদ্যাবতী। তবে, বেশ্যা অর্থে সুবেশা রমণী-গৃহ-আকন্দ প্রভৃতি, বৃক্ষ-গণিকাও হয়। তন্ত্রে সাত প্রকার বেশ্যার বর্ণনা আছে। রাজবেশ্যা-দেববেশ্যা- ব্রহ্মা বেশ্যা-মহাবেশ্যা-ভববেশ্যা-কুলবেশ্যা। এই সপ্তপ্রকার বেশ্যার বর্ণনা দিয়ে আগম তন্ত্র বলছে- “বিধাভবেদ্বেশ্যা ন বেশ্যা কুলটা প্রিয়ে। কুলটা সঙ্গমাদ্দেবী রৌরবং নরকং ব্রজেৎ।” অর্থাৎ গণিকাগমন আর নরক গমন সমান।

আমরা নিত্য দিন দেখছি, সূর্যোদয়ের চব্বিশ মিনিট আগে উষার আবির্ভাব। উষার আগে অশ্বিদ্বয়ের আবির্ভাব। অশ্বিদ্বয়ের আগে মহারুদ্রের আবির্ভাব, ইনি দেবাদিদেব মহাদেব। এখানে বিষ্ণু উত্থানের এক মাস আগে উষার আবির্ভাব উষার (দক্ষিণা উষা) পক্ষে অকাল নয়— কাল। যদিও বিষ্ণু প্রভৃতি দেবতার পক্ষে অকাল। মনে রাখতে হবে মহিষ অর্থে এখানে দৈবরাত এবং মহিষাসুর হচ্ছেন জমজমাটে মেঘ। গ্রীকদের মহিষাসুর মহিষের জনি ভেদ করে বেরিয়েছে। আসলে দৈবী রাতের পৃশ্নী হলেন এই মহিষ যােনী। মূর্তিটি দেখনদার এবং প্রতীক মাত্র। অতি সাধারণ রূপকের মাধ্যমে বর্ষার বর্ণনা।

ঋগ্বেদ মতে নিত্য উষার চরণ নেই। কিন্তু অহনা দৈবী উষার চরণ আছে। শ্রীশ্রী চণ্ডী গ্রন্থের অন্য নাম ‘সপ্তশতী’। এই ‘সপ্তশতী’ গ্রন্থের পাঠক ও মহিষাসুরমদিনী দুর্গা পূজার উত্তম অধিকারী হলেন ‘সপ্তশতী’ ব্রাহ্মণ। এই সপ্তশতী ব্রাহ্মণ বৃহৎবঙ্গ ছাড়া ভারতবর্ষের অন্যত্র ছিল না হাজার বৎসর আগেও। তবে, কনৌজিয়াদের দাপটে সপ্তশতী ব্রাহ্মণেরা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। “পঞ্চগােত্র ছাপ্পান্ন গাঁই, এই ছাড়া ব্রাহ্মণ নাই। যদি থাকে দুই চার ঘর, সপ্তশতী পরাশর।” এই হচ্ছে কনৌজিয়াদের বক্তব্য। তবে, কনৌজিয়া আগমনের পূর্বেও বৃহৎবঙ্গে বিস্তর ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাঁরা যাগযজ্ঞ করতেন। যজ্ঞার্থে ভূমিদানের তাম্রপট্ট পাওয়া গিয়েছে যা কনৌজিয়া আগমনের পূর্বকার ঘটনা। আগেই বলেছি, সপ্তশতী ব্রাক্ষণেরা মহিষাসুরমর্দিনী পুজোর উত্তম অধিকারী তবে, পরাশরদের কী কাজ ছিল? অনুমান করা হয়, নব্যপরাশর বিধি নিয়েই এরা কালক্ষয় করতেন। যা হােক, মহিষাসুরমর্দিনী অহনা দেবীর উল্লেখ ঋগ্বেদে থাকলেও অহনা পুজোর কাল ও পুজোপদ্ধতি ওই গ্রন্থে নেই। তবে, মহিষাসুরের আবির্ভাব ও দক্ষিণা উষা তথা অহনা দেবীর অভ্যুদয় বিবেচনা করে শরৎ ঋতুতে আশ্বিন মাসের শুক্ল ষষ্ঠী সপ্তমী-তে শারদা দুর্গা মহিষাসুরমর্দিনীর পুজোকে সঠিক কালের জাগরণ তথা কালের বােধনই বলা যায়। কেননা, উষা নিজে জাগরিতা হয়ে অন্য দেবতাদের জাগরিত করেন।

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here