স্বস্তিক চিহ্ন | এর তাৎপর্য ও ব্যবহার এবং ইতিহাস

0
1048

স্বস্তিক চিহ্নের তাৎপর্য ও ব্যবহার এবং ইতিহাস বহুদূর পরিব্যাপ্ত

স্বস্তিক চিহ্নের তাৎপর্য ও ব্যবহারকেবলমাত্র  ভারতবর্ষীয় হিন্দুদের কাছেই নয়, ‘ধর্মীয় ও ভৌগোলিক সীমানা ছাড়িয়ে বহুদূর পরিব্যাপ্ত। স্বস্তিককে কেউ কেউ রহস্যময় অতিন্দ্রিয় এক চিহ্ন বলে গণ্য করেছেন, যার সঙ্গে মিল রয়েছে ইউরোপের ফিলফট ’ বা ‘ গ্যাম্যাডিওন ’ চিহ্নের সঙ্গে ৷ এই চিহ্নগুলি ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জগুলি ছাড়াও এশিয়া মহাদেশ এমনকি আফ্রিকাতেও পাওয়া গেছে ৷

স্বস্তিক চিহ্ন শুভ 

 খ্রিস্টধর্মের নানা অনুযঙ্গে এই চিহ্নের ব্যবহার পাওয়া যাচ্ছে । জৈনরা তাদের আটটি শুভ বা ‘মঙ্গল’ চিহ্নের অন্যতম চিহ্ন হিসেবে জ্ঞান করেছে  ৷ বৌদ্ধদের কাছেও স্বস্তিক শুভ চিহ্ন হিসেবে গৃহীত হয়েছে I বুদ্ধের জম্মের পর তার হাতের তালুতে যে সমস্ত শুভ চিহ্নণ্ডলি দেখা গিয়েছিল তার মধ্যে এটি অন্যতম ছিল। 

স্বস্তিক চিহ্নের ইতিহাস ও হিন্দুত্বের প্রতীক 

 ভারতবর্ষের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্ভবত সর্বাপেক্ষা প্রাচীন। ঋক  বেদের শ্লোকে যে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে তা থেকে স্বস্তিক যে সূর্যের সঙ্গে সম্পর্কিত এমনটি অনুমান করছেন পণ্ডিতরা ।তাদের মতে, সূর্য উদিত  হলে চারদিক আলোয় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। স্বস্তিকের চারটি বাহু সেই সূর্যালোকিত  চতুর্দিকের প্রতীক ।

স্বস্তিক চিহ্নের ইতিহাস
স্বস্তিক চিহ্নের ইতিহাস

যদিও কানিংহামের মতে , এর সঙ্গে সূর্যের কোনো যেগেসূত্র নেই।  তিনি মনে করেন, ব্রাক্ষী হরফে ‘সু’ আর ‘অস্তি’ দূটি হরফের যােগফল স্বস্তিক । অপর একটি মত হলো, ভগবান বিষ্ণুর চক্রের স্পোক স্বস্তিকের মধ্যে প্রতিকায়িত।  যাইহোক, বিভিন্ন পণ্ডিতদের আলোচনার মধ্য দিয়ে স্বস্তিকের ‘ আর যে সমস্ত প্রতীকী অর্থ উঠে এসেছে তা হলো – কোনো প্রাচীন দেবতার  প্রতীক, প্রবাহিত জলধারা, স্ত্রী জননাঙ্গ ,বজ্রপাত ইত্যাদির ইঙ্গিত বহন করছে  স্বস্তিক ৷ 

ভারতীয় উপবমহাদেশে এই চিহ্নের প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া গেছে সিন্ধু সভ্যতার ৷ ভারতীয় সভ্যতার  অন্যতম উৎসও সিন্ধু সভ্যতা ৷ সিন্ধু সভ্যতার নানান কেন্দ্রে  এককভাবে একত্রিত অলংকাররূপে স্বস্তিক চিহ্ন মিলেছে ৷ ম্যাককে বলছেন, যে মুখের অলংকাররূপে এটি ব্যবহার করা হতো ৷ কিন্তু অচিরেই, মহেঞ্জদাড়ােতে পাওয়া একটি সীলমােহরে দেখা গেল স্বস্তিক চিহ্নের সামনে একটি  হাতি প্ৰণাম নিবেদন করছে ৷ এর থেকে বোঝা গেল যে স্বস্তিক আসলে কোনো অতিন্দ্রীয়  বা অলৌকিক শক্তির আধার হিসাবে পরিগণিত হতো সিন্ধু সভ্যতার সময়েই।

প্রাক্ মৌর্য পাঞ্চমার্কড মূদ্রা স্বস্তিক চিহ্ন বহন করত ৷ সম্রাট অশোকের মূদ্রাগুলি স্বস্তিক চিহ্নের সঙ্গে সঙ্গে বজ্র, হস্তী প্রভৃতি চিহ্ন দ্বারাও অঙ্কিত ৷ আবার শ্রীলঙ্কায়  প্রাপ্ত মূদ্রায় স্বস্তিক চিহ্নের সঙ্গে সঙ্গে গজলক্ষী  খাদিত হয়েছে দেখতে পাওয়া যায় ৷ প্রাচীন মূদ্রা ছাড়াও স্বস্তিক চিহ্ন অন্যান্য বস্তুর ঊপরও খোদিত থাকতে দেখা যেত ৷ ভির থেকে মার্শাল একটি হাড়ের অংশ পেয়েছিলেন যেখানে তির, নন্দীপদ এবং স্বস্তিকা চিহ্ন যুগপতৎ  অ্বস্থান করছে  দেখা যায় ৷ তক্ষশীলায় পাওয়া একটি চতুস্কোণ তামার সীলমোহরে খরোষ্ঠি লিপিতে উত্কীর্ণ অক্ষরের সঙ্গে স্বস্তিক চিহ্ন পওেয়া গিয়েছে ৷ এই সমস্ত ছাড়াও মৃৎপাত্র এবং গুহাগাত্রে এটি খোদিত রয়েছে দেখা যায় ৷ খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে রানি গুম্ফা গুহাতে স্বস্তিক চিহ্নের উপস্থিতি লক্ষ্য করে। 

সুপ্রাচীনকাল বলতে গেলে প্রাক্-ইতিহাস পর্ব থেকে এই চিহ্নেে সূপরিব্যাপ্ত আন্তঃসাংস্কৃতিক উপস্থিতি তা এই চিহ্নটি অপরিসীম তাৎপর্যমণ্ডিত করেছে। ম্যাক্সমূলার তার বক্তব্যে ‘স্বস্তিক চিহ্ন’ যে একান্তরূপে ভারতীয় উত্সজাত এমন অভিমত প্রকাশ করলেও , এটি স্থান-কাল-পাত্রের ভিন্নতায় নানা তাৎপর্যে মণ্ডিত হয়েছে I উইলসন তার  গ্রন্থে (১৮৯৬) ‘স্বস্তিক’ আমাদের জানা সবচেয়ে প্রাচীন প্রতীক রূপে উল্লেখ করেছেন এবং এর স্থানান্তর গমনের ইতিবৃত্তান্ত  শুনিয়েছেন । এই সমস্ত বিবরণ ও বিস্তার থেকে এর ধর্মীয় এবং অলৌকিক বিভাটি বিশেষভাবে বিকশিত হয়েছে  লক্ষ্য করা যায়। আলাচা হুরুক এ  ২৩০০- ২১০০ খ্রিস্টপূর্ব যে হিট্টাহিটদের কবর পাওয়া গেছে সেখানে জাফরির মতো  বর্গক্ষত্রে পরপর খোপে খােপে স্বস্তিক চিহ্ন সজ্জিত রয়েছে । এটিকে ধর্মীয় তাৎপর্যযুক্ত বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন ৷ 

বাঙালী হিন্দুদের জীবনে স্বস্তিকের তাৎপর্য 

পরিবর্তিত স্বস্তিক চিহ্ন
পরিবর্তিত স্বস্তিক চিহ্ন

বাঙ্গালি হিন্দু সংস্কারে বিবাহের সময় ঘরের দেওয়ালে  যে ‘বসুধারা’ অঙ্কন করা  হয়, তাও এক ধরনের স্বস্তিক চিহ্নের পরিবর্তিত বা আঞ্চলিকরূপ। নান্দীমমুখ  বা নান্নীমূখ-এর সময় এই বসুধারা অঙ্কিত হয়। এখানে পূর্বপুরুষদের স্মরণ করার সঙ্গে সঙ্গে বংশবৃদ্ধির কামনাও ব্যক্ত হয় । বসুধারায় যে সমস্ত উপাদান ও রং ব্যবহৃত হয় তা একই কৃষি, বংশবৃদ্ধি , সূর্য, পৃথিবী এবং জন্ম জন্মান্তরের যােগসূত্রকে প্রতীকায়িত করে।   বাঙ্গালির এই সংস্কার স্বস্তিককে ঘিরে এর সর্বভারতীয় শুভদায়ক রূপটির সঙ্গে এভাবেই বাঁধা পড়ে যায়।

স্বস্তিক চিহ্ন কত প্রকার 

স্বস্তিক চিহ্ন  ২ প্রকারের হয়ে থাকে 
১.দক্ষিণ মুখী যা হিন্দুরা আলোকিত বা শুভ বলে মনে করে  এবং  
২. বাম মুখী  যা অন্ধকার বা অশুভ বলে গণ্য করা হয়। 

স্বস্তিক কোথায় স্থাপন এবং কিভাবে ব্যবহার করতে হয়

স্বস্তিকের  ব্যবহার সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। 
চিত্রটি হিন্দু উপাসনা ,গৃহ-প্রবেশ বিভিন্ন উৎসব, পূজা-পার্বণ, ইত্যাদিতে  ব্যবহার করতে হয়। এটি ব্যবহারে ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ লাভ হয়। সিঁদুর ও ভিজা কুমকুম দিয়ে তৈরি স্বস্তিক বাড়িতে, অফিসে, যন্ত্রপাতি, যানবাহন এবং ব্যবসার জায়গায় এগুলি ব্যবহার করতে হয়।

পরিবারে সুখ শান্তি সমৃদ্ধি বাড়াতে গৃহস্থের বাড়িতে প্রবেশদ্বারে স্বস্তিক ব্যবহার করতে হয়। 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here