স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো ভাষণ ও হিন্দুত্ব চিন্তা
স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো যাত্রার পটভূমি
স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো ভাষণ বুঝতে হলে প্রথমেই জানতে হবে স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো যাত্রার পটভৃমিটা ।
দীর্ঘ-কাল ভারতবর্ষ ঘুরে স্বামী বিবেকানন্দ দেখেছিলেন দেশের মানুষের নিদারুণ দুঃখ-কষ্ট ও দারিদ্রের করুণ ছবি। দেশ তখন দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অবহেলা ও অনাহারে দারুণ ক্লিষ্ট ৷ ধর্মের নামে অনাচার ও কুসংস্কার তখন দেশকে গ্রাস করেছে ৷ পাশ্চাত্যের নাস্তিকতা ও ভোগসর্বস্বত্ব দেশের সুপ্রাচীন সংস্কৃতিকে আঘাত করেছে ৷ ভারতবাসীর মন থেকে আত্মবিশ্বাস লোপ পেয়েছে ৷ এভাবে এগিয়ে গেলে ভারতের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।
স্বামী বিবেকানন্দ র তখন মনে হয়েছে এই ভারতবর্যকে জাগিয়ে তুলতে হবে। আত্মবিশ্বাস আনতে হবে, ফিরিয়ে আনতে হবে হারানো আত্মবিশ্বাস ও ধর্ম-চেতনা , আর সমৃদ্ধ করাতে হবে জীবনধারা ও আর্থিক অবস্থা ৷
সেই সময় স্বামী তুরিয়ানন্দকে বলেছিলেন, ‘হরিভাই…….. দেখছি আমার হৃদয়টা খুব বেড়ে গেছে, অপরের জন্য ভাবতে শিখেছি। বিশ্বাস কর, খুব তীব্রভাবে এটা অনুভব করছি ।’ এই সব কথা বলার সময় স্বামী বিবেকানন্দ র চোখে জল এসে গিয়েছিল ৷
আর একদিন সমুদ্রতীরে বেড়ানোর সময় তিনি কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন, ‘ ভগবান ! এই দুর্ভাগাদের সৃষ্টি করেছ কেন ? এই দৃশ্য যে অসহ্য ৷ কতদিন, প্রভু এই দৃশ্য দেখতে হবে।’
তখন স্বামী বিবেকানন্দের মনে হয়েছে, ভারতবর্ষকে আবার আর্থিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক দিক থেকে সমৃদ্ধ করতেই হবে। তিনি বলেছেন, দেশের দরকার বিদেশের সমৃদ্ধ দেশগুলোর সঙ্গে সংযোগ, আর্থিক ও বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা । তাছাড়া বিদেশিদের চোখে ভারতবর্ষ তখন এক দরিদ্র, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও অন্ধকারময় দেশ। তাই তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে এই দেশের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ও ধর্মীয় আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধির কথা। বোঝাতে হবে বিদেশি শাষণে ভারতবর্ষ তখন দরিদ্র শোষিত, কিন্তু ধর্ম, দর্শন ও সংস্কৃতিতে এটা এক মহান দেশ।
সেই সময়ই আমেরিকার চিকাগােতে ধর্ম-মহাসম্মেলনের দিনক্ষণ ঘোষিত হয়েছে। স্বামী বিবেকানন্দের মনে হয়েছিল-এই বিশাল মঞ্চকেই ব্যবহার করতে হবে। পৌঁছতে হবে চিকাগােতে । এভাবেই স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো ভাষণ এর পটভূমি তৈরি হয়েছিল।
স্বামী গস্তীরানন্দের মতে, স্বামী বিবেকানন্দ র উদ্দেশ্য ছিল স্বদেশের জন্য অর্থসংগ্রহ ও বিদেশের সঙ্গে আর্থিক সংযোগ স্থাপন করা। অবশ্য শঙ্করী প্রসাদ বসু জানিয়েছেন, স্বামী বিবেকানন্দ চেয়েছিলেন, বিদেশের বিজ্ঞান সাধনার সঙ্গে ভারতবর্ষকে যুক্ত করতে। কিন্তু মনে হয় এগুলো ছাড়াও স্বামী বিবেকানন্দ র উদ্দেশ্য ছিল দেশের প্রাচীন ঐতিহ্য ও হিন্দুধর্মের মাহাত্ম্য জগতের সামনে তুলে ধরা ।
স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো ভাষণ
তাঁর মতে ধর্ম যখন অন্যান্য জাতির কল্পনাতেও অদ্ভূত হয়নি তার অন্তত তিনশো বছর আগে আমাদের ধর্ম সুপ্রতিষ্ঠিত ৷ দর্শনের ক্ষেত্রেও আমরা এখন পর্যন্ত অন্য যেকোনো জাতির থেকেও অনেক উপরে আছি…আমাদের সংস্কৃত ভাষা যাবতীয় ইউরোপীয় ভাষার ভিত্তি।
এই স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো ভাষণ এ দেখেছি তিনি তখন ভারতের ধর্মীয় দূত ৷ তবে অন্যান্য দেশের ধর্মীয় প্রতিনিধিরা সেখানে গেছেন সসম্মানে। স্বামীজী কিন্তু উপস্থিত হয়েছেন অনাহুত এক সন্যাসী হিসেবে ৷ অনেক কষ্টে তিনি পাঁচ মিনিট বলার অনুমতি পেয়েছিলেন।
অন্যান্য বক্তারা বক্তব্য শুরু করেছেন_‘ladies and gentleman’ দিয়ে ৷ কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো ভাষণ এ প্রথমেই বলেছেন, ‘Brothers and sisters of America’ মুহূর্তে আপ্লুত হয়েছেন শ্রোতারা, তুমুল করতালিতে আকাশ যেন বিদীর্ণ হয়েছে, সেটা যেন চলছিল কয়েক মিনিট ৷ গেরুয়া বেশধারী সুদর্শন এই তরুণ সন্যাসী উঠতে দেখেই শ্রোতারা মুগ্ধ হয়েছিলেন। এবার সেই মূগ্ধতা এনে দিয়েছে বিস্ময় I
স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো ভাষণ এ নিজেকে হিন্দুধর্মের প্রতিনিধি বলেই দাবি করেছেন ৷ শুরুতেই তিনি বলেছেন সর্বধর্মের প্রসূতি স্বরূপ যে সনাতন হিন্দুধর্ম, তারই প্রতিনিধি হয়ে আমি আজ আপনাদের ধন্যবাদ দিচ্ছি-পৃথিবীর যাবতীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের হয়ে আমি আজ এখানে এসেছি। তারপর ধাপে ধাপে তিনি হিন্দুধর্মের মহিমা ও স্বরূপ বিশ্লেষণ করে সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন।
স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো ভাষণ এ আরও বলেছেন ‘আমি সেই ধর্মের অন্তর্গত বলে গৌরব বোধ করি যে ধর্ম জগৎকে শিখিয়েছে পরমত সহিষ্ণুতা ও স্বর্বজনীন গ্রহীষ্ণুতার আদর্শ, সেই ধর্মের আক্রমণকারীকেও আপন করে নিয়েছে–তারাও ক্রমে ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গেছে। তিনি আরও বলেছেন, আমরা শুধু সব ধর্মকে সত্য বলি না আমরা বিশ্বাস করি সব ধর্মের গোড়ার কথা এক ও অভিন্ন। আমরা সে জাতির অন্তর্ভুক্ত বলে গর্ব করি যে ধর্ম পৃথিবীর সব ধর্ম ও জাতির নিপীড়িত ও শরণার্থীদের চিরদিন আশ্রয় দিয়েছে। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন ইহুদিদের_একটা অংশকে আমরা দক্ষিণ ভারতে আশ্রয় দিয়েছিলাম, জরাথ্রুষ্টের অনূগামীদের এই হিন্দুধর্মই আদরে গ্রহণ করেছিল I এই প্রসঙ্গেই তিনি গীতার সেই কথা উল্লেখ করেছেন ‘ যে যথা মাং প্রপদ্যন্ত্যে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম। ’ ৷ সুতরাং হিন্দুধর্ম নিজেকে শ্রেষ্ঠবলে দাবি করে না, তার শিক্ষা হলো-যিনি ঈশ্বরকে যেভাবে ভজনা করেন, তিনি সেভাবেই তার কৃপা লাভ করেন ৷
স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো ভাষণ এর পর দুনিয়া জুড়ে সম্মান
স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো ভাষণেই বিস্মিত চমৎকৃত হয়েছেন শ্রোতারা ৷ আবেগপ্লুত হয়েছেন সমস্ত আমেরিকাবাসী ৷ পরাধীন ভারতের এই তরুণ সম্যাসী এভাবে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছেন প্রাচীন এই দেশের বিজয়-বৈজয়ন্তী ৷ স্বামীজী এভাবে শুধু চিকাগাে জয় করেননি সেই সঙ্গে ম্রিয়মান আত্মবিশ্বাসহারা ভারতবাসীর প্রাণে সঞ্চারিত করেছেন প্রাণ, চেতনা ও গর্ববােধ।
স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো ভাষণ সবাইকে এত মুগ্ধ করেছিল যে যখনই বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হতো স্বামীজী ভাষণ দেবেন, তখনই আসন সংগ্রহের জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে যেত। বিভিন্ন রাস্তায় তার ফোটো ঝোলানাে থাকত , তার সঙ্গে বিজ্ঞাপন থাকতো তিনি কোথায় কি বলবেন।
সেই জন্য বলা যায় ‘স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো ভাষণ সভায় তার আত্মপ্রকাশ ভারতবর্ষের নবজাগরণের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা’ .
এটা লক্ষণীয় যে, তিনি যেখানে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত হিন্দুধর্মের মহিমার কথা বলেছেন, কিন্ত কখনও এই ধর্মকে বলে দাবি করেননি। তিনি সমাপ্তি ভাষণে বরং বলেছেন; বিবাদ নয়, সহায়তা; বিনাশ নয়, ভাবগ্রহণ, বিরোধনয়, সমন্বয় ও শাস্তিই কাম্য।
স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো ভাষণ এ ছিল একটা গল্প। কয়েকজন বক্তা তাদের ভাষণে নিজের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের কথা ব্যক্ত করেছেন ৷ স্বাযীজী সবার শেষে যখন উঠে দাঁড়ালেন, তখন অনেকের মনে হয়েছিল তিনি হিন্দুধর্মের পক্ষে সওয়াল করবেন। কিস্তু তিনি উঠে কুয়াের ব্যাঙের কথা বলেছেন তাদের ধারণা ছিল কুয়োটি দুনিয়ার সর্ববৃহত্ জলাশয়।
গল্পটা শুনে পূর্ববর্তী বক্তারা লজ্জায় অধোবদন হয়ে রয়েছিলেন । ডেইলি হেরাল্ড লিখেছেন ‘এই মহান সন্যাসীর দেশে পাদরি পাঠানোর দরকার নেই।’ ‘নার্দম্পেটন ডেইলী’ জানিয়েছিল তার ভাষণ শোনার জন্য মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে।’ আর ‘ডেট্রইট জার্নাল’ জানিয়েছিল বহু মানুষ চেয়ারের অভাবে দাঁড়িয়ে স্তব্ধ হয়ে শুনেছেন স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো ভাষণ ।
বিশ্ব বিজয় করে ফিরে আসার পর স্বাভাবিক কারণেই চমৎকৃত ভারতবাসী রাজকীয় সম্মান দিয়েছেন। কলেজের ছেলেরা ঘোড়ার গাড়ির ঘোড়া খুলে তাকে টেনে নিয়ে গেছে ববক্তৃতা মঞ্চে ৷ শ্রীঅরবিন্দ লিখেছেন, ভারতে এক মহাজাগরণ করে দিয়েছেন স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো ভাষণ জয়ের মাধ্যমে। ‘ তিনি শুধু প্রাচীন ভারতের মহান ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির কথা তুলে ধরেননি , মনে করিয়ে দিয়েছেন হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্য ও উদারতার কথা I
আমাদের দেশের স্বল্প শিক্ষিত অনেক বুদ্ধিজীবী প্রগতিশীল সেজে সেটা অস্বীকার করতে চান। এটা অজ্ঞতা, সংকীর্ণ ও রুচি-বিকৃতির এক কদর্য মিশ্রণ।
স্বামী বিবেকানন্দের হিন্দুত্ব
স্বামী বিবেকানন্দ বীর, তিনি সন্যাসী ; তিনি যোদ্ধা। বীরপূজা যেহেতু মানুষের জন্মগত প্রবৃত্তি; যুদ্ধ যেহেতু আমাদের সর্বত্রই করতে হবে ; তাই আমরা মহাপূরুষদের মধ্যে যোদ্ধৃত্বরূপ খুঁজি আর সহজেই পেয়ে যাই হিন্দু বীর সন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দকে ৷ স্বামী বিবেকানন্দ মানবজাতির মৌলিক চিন্তা ভাবনার কথা বলেছেন। আগুনের ভাষায় যুবকদের মধ্যে অসীম শক্তি সঞ্চার করেছেন; নতুন উদ্যমে হিন্দু যুবককে উদ্বুদ্ধ করেছেন, আত্ম-চেতনা জাগিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, “তোমার মধ্যে অসীম শক্তি, তুমিই আনন্দময়।”
তিনি বলেছেন এগিয়ে যাবার কথা, “Arise, awake and stop not till the goal is reached” বলেছেন, শক্তিই জীবন এবং শক্তির শুভ প্রয়োগই ধর্ম। আমরা তার জীবনী পাঠ করে ধর্মের জন্যে শুভঙ্করী শক্তি প্রয়োগ করি। আমরা যোদ্ধা হই, আমরা ভারতবর্ষে বীর~পূজা করি। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শক্তির ও ধর্মের শুভ প্রয়োগ ঘটাতে চাই। স্বামীজী সেই বিবেক-শুভ্র বিবেকানন্দ।
স্বামীজী ভারতবর্ষ বলতে শুধুই ভারতবর্ষই বুঝতেন ৷ মনে করতেন, খ্রিস্টান মিশনারি ও নানান সংস্কার সভার হিন্দুদের প্রতি ঘৃণা ও হিংসার পরিমাণ এত বেশি যে, সে বিষয়ে তাদের কাছে কোনো রকম প্রশ্ন করা সম্পুর্ণ অর্থহীন। প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন–এরা কেন হিন্দুদের সংস্কার-চেষ্টায় বিরোধী হবেন ? এরা কেন এইসব আন্দোলনের প্রবল শত্রু হয়ে দাড়াবেন (আমার সমরনীতি, বিবেকানন্দ রচনা সমগ্র) ?
স্বামী বিবেকানন্দের স্বাজাত্যবোধ
বিবেকানন্দের স্বাজাত্য বোধের উৎস ছিল হিন্দুত্ব -“হিন্দুজাতি সমগ্র জগৎ জয় করিবে ৷” তিনি বলেছেন হিন্দুসমাজে যে সমস্ত বিশেষ দোষ রয়েছে, তা বৌদ্ধধর্মজাত ; তার উত্তরাধিকার স্বরূপ এই অবনতি।
প্রাচীন ভারতে হিন্দুদের ইসলাম গ্রহণকে তিনি ‘ বেশ্যাবৃত্তির সঙ্গে তুলনা করে তিরস্কার করেছেন। হিন্দু সমাজত্যাগী মুসলমানদের স্বামীজী ‘ দেশের শত্রু’ বলে চিহ্নিত করেছেন। বলেছেন, ‘ কোনো লোক হিন্দুসমাজ ত্যাগ করে অন্য ধর্ম গ্রহণ করলে সমাজে শুধু যে একটি লোক কম পড়ে তা নয় , একটি করে শ্ত্রু বৃদ্ধি হয়। ’ তিনি বেদান্ত দর্শনকে মহাসত্য বলে মনে করেছেন ৷ “বেদান্ত –কেবলই বেদান্তই সার্বভৌম ধর্ম হতে পারে, আর কোনো ধর্মই নয়।
” ভারতবর্ষ হিন্দু প্রধান দেশ। হিন্দুধর্মের এই জল হাওয়া পছন্দ না হলে তিনি তাকে প্রকারান্তরে দেশ ত্যাগ করবার পরামর্শ দিয়েছেন“ এ দেশে সেই বূড়াে শিব ডমরু বাজাবেন, মা কালী পঁ৷ঠা খাবেন আর কৃষ্ণ বাঁশি বাজাবেন এ দেশে চিরকাল। যদি না পছন্দ হয়, সরে পড় না কেন।”
১৮৯৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ধর্ম মহাসভায় স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো ভাষণ মাধ্যমে খ্রিস্টানদের উদ্দেশ্য করে বলেন, “তোমরা খ্রিস্টানরা পৌত্তলিকদের আত্মাকে উদ্ধার করবার জন্য তাদের কাছে ধর্ম প্রচারক পাঠাতে খুবই উৎসাহী ; কিন্তু বল দেখি অনাহার ও দুর্ভিক্ষের হাত থেকে দেহগুলাে বাঁচাবার জন্য কোনো চেষ্টা করো না কেন ? ভারতবর্ষে ভয়ংকর দুর্ভিক্ষের সময় হাজার হাজার মানুষ খিদেয় মৃত্যুমুখে পড়ে, কিন্তু তোমরা খ্রিস্টানরা কিছুই করোনি। তারা ভাত চাইছে আর আমরা তাদের পাথরের টুকরো তুলে দিচ্ছি। ক্ষুধার্ত মানুষকে ধর্মের কথা শোনানো বা দর্শনশাস্ত্র পড়ানো হলো তাকে অপমান করা। ”
স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো ভাষণ এ পরিষ্কার করেই বলে দিয়েছেন, ‘যদি কোনো সম্প্রদায়ের ওঙ্কারোপাসনায় আপত্তি থাকে, তবে তার নিজেকে হিন্দু বলার অধিকার নেই। ’ মনে করেছেন, কেবল তখনই কেউ প্রকৃত হিন্দুপদবাচ্য যখন ওই নামটিতে তার ভেতরে বৈদ্যুতিক শক্তি সঞ্চারিত হয়। যখন যেকোনো দেশীয়, যেকোনো ভাষাভাযী হিন্দু নামধারী হলেই পরমাত্মীয় বোধ হবে ; যখন ইিন্দু নামধারী যে কোনো ব্যক্তির দুঃখ কষ্ট তার হৃদয় স্পর্শ করবে, নিজের সন্তান বিপদে পড়লে যে রকম উদ্বিগ্ন হয় তার কষ্টেও সেরকম ঊদ্বিগ্ন হবে, তখনই তিনি প্রকৃত হিন্দু হয়ে উঠবেন ৷ তিনি হিন্দুদের মধ্যে পরস্পর বিরোধ ভুলে, চারিদিকে প্রেমের প্রবাহ বিস্তার করতে বলেছেন।
স্বামী বিবেকানন্দের হিন্দুধর্ম বনাম খ্রিষ্টধর্ম
অস্বীকার করার উপায় নেই স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্য কীর্তনীয়া। শিকাগােতে স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো ভাষণ এর নেপথ্যে তিনি হিন্দুধর্মের প্রচারের জন্যেই গিয়েছিলেন ৷ তিনি খ্রিস্টান মিশনারিদের সূস্পস্টভাবে জানিয়েও দেন ভারতব্বর্ষ কখনই অধ্যাত্ম সম্পদে দরিদ্র নয়, দরিদ্র অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানে ৷ মনে রাখতে হবে স্বামীজী অন্য ধর্ম থেকে ভাব নেবার ব্যাপারে খুবই selective ছিলেন ৷ যিশুর সাম্যনীতি তার প্রাণ স্পর্শ করে থাকবে; জগতের কল্যাণের জন্য যে ত্যাগ দরকার হয়, তার রসদও যিশুখ্রীষ্টের মধ্যে তিনি পেয়ে থাকবেন।
ঔপনিবেশিক শাসনে থাকবার পর মানুষ স্বভাবতই তাদের ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়, নতুবা নানান মত ও পথে তা অতিক্রমণ করতে মনস্থ হয় , কখনও কখনও ঔপনিবেশিক শক্তির মান্য ধর্মকে তীব্রভাবে অস্বীকার করার মানসিকতা জন্মায় ৷ ব্রিটিশ শাসনে থেকে স্বামী বিবেকানন্দ হয়তো সেই ধর্মীয় পরিমণ্ডল অতিক্রম করার জন্য তাদের ধর্মীয় সেরা দিনটিকেই গ্রহণ করেছিলেন। আর সেই দিনটির মধ্যে হিন্দুধর্মের নবযুগের ইতিহাস রচনা করতে চাইলেন।
১৮৮৬ সালের বড়ােদিনের পুর্বসন্ধ্যায় ( ১৩ পৌষ, ১ ২৯৩) নয়জন গুরুভাই হুগলীর আটপুর গ্রামে বাবুরাম ঘোষের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে ভারতের আধ্যাত্মিক ও সামাজিক কল্যাণে সন্ন্যাস গ্রহণের সংকল্প করলেন।
অন্যদিনও তো করতে পারতেন, কারণ আটপুরে তার বেশ কয়েকদিন আগেই তিনি পৌঁছেছিলেন ৷ মনে রাখতে হবে, ১৮৮৬ আগস্ট মাসে ঠাকুরের শরীর যায়। সে বছর ক্রিসমাসের আগের দিন অশ্বখ তলায় ধূনি জ্বেলে তারা বসলেন গভীর ধ্যানে, তারপর ঈশ্বর আলোচনা। জানা যায়, স্বামী বিবেকানন্দ যিশু খ্রিস্টের কথা সেদিন বলেছিলেন।
এখন প্রশ্ন, এইভাবে দিনটি পালনের পরও পরবর্তীকালে পুরীতে গিয়ে সেই বাবুরাম মহারাজীই কেন খ্রিস্টান পাদরিদের ধ্র্মপ্রচারে জনসমাগমকে বিভ্রান্ত করার জন্য এবং স্বধর্ম চেতনাকে জাগ্রতকরার জন্য ‘হরিবােল হরিবোল হরিবােল’ ধ্বনি দিয়ে উত্তাল করেছিলেন এবং উপস্থিত মানুষকে তাতে শামিল করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন ? আর তাতে সফলও হয়েছিলেন।
দ্বিতীয় ঘটনা ১৮৯২ সালের ২৫, ২৬, ২৭ ডিসেম্বরের ; স্থান কন্যাকুমারী। আবারও ২৫ ডিসেম্বরকে ব্যবহার করলেন স্বামী বিবেকানন্দ। স্বামী বিবেকানন্দ অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন। ডাইনে-বামে-পশ্চাতে ঢেউ আর ঢেউ, অগণিত অনন্য ; মহাসাগরের বুকে মিশে যেতে চায় সাগর আর উপসাগর অনাদিকাল থেকে তাদের অভিসার যাত্রা।
১৮৯২ সালের ২৫ ডিসেম্বর; আকাশের এক তারা এসেছেন মত্ত সাগরের ত্রিকােণ প্রেমের জলধারায় নীনীলকর দিয়ে। সুনীল জলধি থেকে সন্তানসম ভারতবর্ষের আবির্ভাব; মহাকালের সেই মহান অধ্যায় দেখতে এসেছেন সপ্তষির্মিণ্ডলের এক আশ্চর্য নক্ষত্র ; তার অতীত আর ভবিষ্যৎ মেলাবেন সমাধিতে বসে। পাশেই সমুদ্র-তনয়া কন্যাকুমারী।
বড়ােদিনই ঘটে, তার প্রাক্কালে পায়ে হেঁটে কন্যাকুমারী পৌঁছেছেন স্বামী বিবেকানন্দ, তারপর মূল ভূখণ্ড থেকে সাগর-সঙ্গমে ৫০০ মিটার সাঁতরে ভারতীয় পাহাড়ের শেষ বিন্দুতে পৌঁছলেন তিনি; দেখলেন অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন, তারপর অতুল্য কিস্তু অভুক্ত ভারতের জন্য গ্রহণ করলেন এক আধ্যাত্মিক সৎকল্প। ধ্যানের শঙ্খনাদে একাদিক্রমে তিনদিন কাটলাে২৫,২৬, ২৭ ডিসেম্বর।
যে খ্রিস্ট মানুষকে ‘ পাপী’ বলে, সেই ধর্মের প্রতিবাদ কেবল স্বামীভীইি করেননি, করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণও। মানুষ দেবতা, মানুষ ব্রহ্ম; সে পাপী হবে কীভাবেঃ সে অমৃতের সন্তান, সে পবিত্র, সে পূর্ণ; পূর্ণতা প্রাপ্তির সব যোগই তার মধ্যে আছে ।উপনিষদের ঋযির মতো আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, “শৃনন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা আ যেন ধমানি দিব্যানি তস্তু। “
হে অমৃতের পুত্রেরা, শোনো আমি এই অজ্ঞানের অন্ধকার থেকে আলোয় যাওয়ার রাস্তা পেয়েছি। আমি সেই প্রাচীন মহান পুরুষকে জেনেছি, যিনি সকল আঁধারের ওপারে, মৃত্যুকে অতিক্রম করে। এই প্রাচীন বাণী শুনিয়ে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন হিন্দু ধর্মে আমাদের পাপী বলতে চাওয়া হয় না।
আমরা পবিত্র ঈশ্বরের সন্তান, আমরা মর্ত্য ভৃমির দেবতা। মানুষকে পাপী বলার মতো মহাপাপ আর নেই। এ যে মনুষ্যত্বের স্বরূপের ওপর একটা মিথ্যের কলঙ্ক আরোপের প্রচেষ্টা। স্বামীজী এই ভুল বদলে দিতে চেয়েছেন ।
শুধু তাই নয়, ব্রাহ্মসমাজের শশীপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হিন্দু বিধবা আশ্রমের জন্য তিনি বিদেশে বক্তৃতা দিয়ে টাকা তুলে পাঠিয়েছেন কেবল খ্রিস্টান ধর্মান্তরিত ভারতীয় বিদুষী মহিলা রামাবাইয়ের তৈরি বিধবা আশ্রমকে ঔচিত্য দেখানোর জন্য ।কারণ এই মহিলাসহ অন্যান্য খ্রিস্টধর্মাবলম্বী ও মিশনারিরা গলা মিলিয়ে ভারতীয় বিধবাদের দুঃখের অতিরঞ্জন করতেন, স্বামীজীর তা পছন্দ ছিল না।
হিন্দুধর্মের প্রচারে আনূকুল্য পাবার জন্য যতটুকু যিশু ভজনা দরকার স্বামীজী তাই করেছেন । তিনি জানতেন একদিন শ্রীরামকৃষ্ণ প্রচার ধারায় অখণ্ড ভারতবর্ষ-সহ প্লাবিত হবে বিশ্বের নানান অংশ , তাই বড়োদিনের মতো দিনটির মধ্যে হিন্দুধর্মের মাহাত্ম্য র্কীর্তনের বীজ বপন পূর্বেই করে দিলেন তিনি। এটা কলােনিয়াল প্রভাব মুক্তিরই সাধনা, সাধনা ২৫ ডিসেম্বরকে অতিক্রমের। এই দিনে বরং বেশি করে শ্রীরামকৃষ্ণের ও স্বামী বিবেকানন্দের স্মরণ-মনন ও পুজন জরুরি ।জরুরি শ্রীরামকৃষ্ণ-স্বামীজী যুগলবন্দির আরাধনা। খ্রিস্টের মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণকে না দেখে শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যেই যিশুখ্রিস্টকে আবিষ্কার করার সাধনা বরং অতিউৎসাহিতদের শুরু করা উচিত। সম্প্রীতির বার্তা দিতে খ্রিস্টানরা প্রভু যিশুর মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণকে খুঁজে নিক ৷
রামনামে মত্ত স্বামী বিবেকানন্দ
১৮৮৬ সালের ৭ জানুয়ারি; তখনও নরেন্দ্রনাথ স্বামী বিবেকানন্দ হয়ে ওঠোনি। কল্পতরু দিবস অতিবাহিত হয়েছে ( ১৮৮৬ সালের ১ জানুয়ারি); শ্রীরামকৃষ্ণ তখন অসুস্থ। তাকে নরেন্দ্রনাথ বলছেন, এখন থেকে তাকে প্রত্যহ বলে দিতে হবে সে সাধন ভজন কীভাবে করবেন ৷ শ্রীরামকৃষ্ণ সেদিন তার আদরের নরেনকে নিজের কূলদেবতা রামের ইষ্টমন্ত্র দিলেন।
নরেনের শ্রীরাম ভজনা শুরু হলো। শ্ৰীম (মাস্টারমশাই ) য়ের দিনলিপি উদ্ধৃত করে স্বামী প্রভানন্দ লিখেছেন সেই কথা। ১৩ জনুেয়ারি শ্রীম দেখছেন, নরেন্দ্রনাথ পাগলের মতো রামনাম গাইছেন; অবশেষে ১৬ জানুয়ারি নরেনকে শ্রীরাম সন্ন্যাসীবেশে দীক্ষাদিলেন।
আর ১৯ জানুয়ারি নরেন্দ্রনাথ-সহ নিরঞ্জন প্রমুখ সে সন্ন্যাসীবেশী রামের মতো রামাইত সাধূর বেশ ধারণ করলেন ।নরেনের গেরুয়াবেশে মা ভূবনেশ্বরী যারপরনাই চিন্তিত হলেন I নরেন যে সপার্ষদ সন্ন্যাসী হতে চান এবং তা ক্ষত্রিয় রামের সন্ন্যাস-বেশী-রূপে তা অত্যন্ত তাৎপর্যপুর্ণ। পিতৃসত্য পালনের জন্য শ্রীরাম বনবাসী হয়েছিলেন, কিন্তু তার ক্ষাত্র ধৰ্ম অক্ষুন্ন ছিল ।
শ্রীরামের এই অনন্য রূপের মধ্যেই রয়েছে চিরন্তন ভারতবর্ষের শাশ্বত চিন্তন; শৌর্যশালী অথচ তাপসমালী। ভারতবর্ষের তপোবন ভারতীয় সভ্যতার অনন্য ঊপাচার আর নগরে-রাজধানীতে বিক্রমশালী প্রজারঞ্জন রাজা — এ দুইয়েএক অমিত মেলবন্ধন হলো শ্রীরামের সন্ন্যাসরূপ।
স্বামী বিবেকানন্দ যে বীর সন্ন্যাসী হয়ে উঠেছেন তা হয়তো এই রঘুবীরেরই সাধনার। গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ তার প্রিয় শিষ্যকে কুলের ইষ্টনাম দিয়ে সেই সাধনার ধারাকে পরিপৃষ্ট করেছেন, বঙ্গপ্রদেশে শ্রীরাম সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন। বঙ্গপ্ৰদেশের ধর্মীয় সংস্কৃতিতে শ্রীরামচন্দ্রকে পূজন-আরাধনা যে প্রচলিত ছিল তা কবি কৃত্তিবাসের ‘শ্রীরাম পাঁচালী’-ই অমােচ্য প্রমাণ।