ভৌত রাশি | পরিমাপ এবং একক|স্কেলার ও ভেক্টর রাশির পার্থক্য

3
1540

ভৌত রাশি বা প্রাকৃতিক রাশি

সূচীপত্র দেখতে ক্লিক করুন show

দৈনন্দিন জীবনে আমরা বিভিন্ন বিষয়, বস্তু এগুলোর পরিমাপ করে থাকি। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে– ধরা যাক কোন এক ব্যক্তি মুদি দোকানে গেল এবং দোকানদারের কাছে এক কিলোগ্রাম ডাল এক লিটার তেল এবং একশ গ্রাম হলুদ চাইল। তারপর বাড়ি ফিরলেন। বাজার থেকে বাড়ি ফিরে তিনি দেখলেন তার আসতে কুড়ি মিনিট সময় লেগেছে।

এই উদাহরণ গুলোর মধ্যে দু’টি বিষয়ে আমাদের কাছে স্পষ্ট হল।
ডাল হলুদ এর ভর পরিমাপ করার জন্য আমরা কিলোগ্রাম গ্রামের ব্যবহার করেছি, তেল পরিমাপের জন্য লিটার এবং সময় পরিমাপ করার জন্য আমরা মিনিটের ব্যবহার করেছি।
অর্থাৎ আমরা ভর, আয়তন এবং সময়কে পরিমাপ করতে পারি তাই এরা এক একটি রাশি বা ভৌত রাশি।
গ্রা্‌ম কিলোগ্রাম, লিটার ও মিনিট এরা একক।

রাশি র সংজ্ঞা

প্রাকৃতিক বস্তু, ঘটনা ইত্যাদি সম্পর্কে যা পরিমাপ করা যায় তাকেই রাশি ভৌত রাশি বা প্রাকৃতিক রাশি বলে অর্থাৎ পরিমাপযোগ্য যেকোনো জিনিসকে এক কথায় আমরা রাশি বলতে পারি। যেমন দৈর্ঘ্য,প্রস্থ, ভর, আয়তন, ঘনত্ব এগুলো প্রত্যেকেই এক একটি রাশি কারণ এদেরকে পরিমাপ করা যায়।

রাশির প্রকারভেদ বা রাশি কত প্রকার


অভিমুখ নির্দেশ অনুসারে মূলত রাশি দুই প্রকার

. স্কেলার রাশি ও ২. ভেক্টর রাশি

[wpda_org_chart tree_id=7 theme_id=51]

স্কেলার রাশি

যেসব রাশির শুধুমাত্র মান আছে কিন্তু কোন অভিমুখ নেই তাদেরকে আমরা স্কেলার রাশি বা দিকহীন বলি । যেমন দৈর্ঘ্য, ভর, আয়তন, ক্ষেত্রফল, দ্রুতি, সময় ইত্যাদি কারণ এদের শুধুমাত্র মান আছে কিন্তু কোন অভিমুখ নেই এর উদাহরণ দিয়ে বলি একটি পাইপের দৈর্ঘ্য ২ মিটার বললে পাইপের শুধু দৈর্ঘ্যের মান বোঝায় ১ কিলোগ্রাম ডাল বললে ওই ডালের শুধু ভরকে বোঝায় কোন অভিমুখ বোঝায় না।

ভেক্টর রাশি

যেসব রাশির মান এবং দিক দুটোই আছে তাদেরকে ভেক্টর রাশি বলে । যেমন ওজন, বেগ, ত্বরন, বল, সরণ ইত্যাদি রাশিগুলি হল ভেক্টর রাশি। ধরা যাক একটি বাইক ৪০ কিলোমিটার / ঘন্টা বেগে উত্তর দিকে যাচ্ছে। এখানে বেগের মান হচ্ছে ৪০ কিলোমিটার / ঘন্টা এবং দিক হলো উত্তর দিক।


স্কেলার রাশি ও ভেক্টর রাশির পার্থক্য

স্কেলার রাশি ও ভেক্টর রাশির পার্থক্য নিচে পয়েন্ট সহকারে উল্লেখ করা হল—-

স্কেলার রাশিভেক্টর রাশির
স্কেলার রাশির শুধুমাত্র মান আছে কিন্তু কোনরকম দিক নির্দেশ করে না।ভেক্টর রাশির মান আছে এবং সাথে সাথে দিক বা অভিমুখ নির্দেশ করে থাকে।
দুটো স্কেলার রাশি গুন করলে সব সময় গুণফল স্কেলার রাশি হয়। দুটি ভেক্টরের গুণ করলে গুণফল একটি ভেক্টর রাশি বা স্কেলার রাশিও হতে পারে।
দুটি স্কেলার রাশির মান শূন্য না হলে এদের গুণফল কখনোই শূন্য হবে না।দুটি ভেক্টর রাশির মধ্যে একটির মান যদি শূন্য হয় তাহলে গুণফল শূন্য হতে পারে।
সাধারণ গাণিতিক নিয়মে যোগ বিয়োগ গুন ভাগ করা যায় ।সাধারণ গাণিতিক নিয়মে যোগ বিয়োগ গুন ভাগ করা যায় না।
স্কেলার রাশি শুধুমাত্র মান পরিবর্তন করলে এর পরিবর্তন হয়।ভেক্টর রাশি পরিবর্তন করতে গেলে মান অথবা দিক অথবা উভয়ের পরিবর্তন করতে হয়।
স্কেলার রাশি ও ভেক্টর রাশির পার্থক্য

এই ছিল স্কেলার ও ভেক্টর রাশির মধ্যে পার্থক্য।

পরিমাপের একক এবং এককের প্রয়োজনীয়তা

আধুনিক বিজ্ঞান পরিমাপের উপর দাঁড়িয়ে আছে। আমরা কোন রাশির আনুমানিক পরিমাপ করতে সক্ষম কিন্তু সঠিক এবং নির্ভুল পরিমাপ শুধু ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে করা সম্ভব না। একটি উদাহরণের সাথে বোঝা যাক—
আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রমেশের উচ্চতা সম্বন্ধে কেউ জিজ্ঞাসা করলে আমি বলতে পারি আনুমানিক ৫ ফুট কিন্তু স্কেল দিয়ে মাপলে দেখা গেল রমেশের উচ্চতা ৫ ফুট ২ ইঞ্চি। সুতরাং কোন রাশির সঠিক মাপ জানার জন্য নির্ভুল পরিমাপের প্রয়োজন। কোন ভৌত রাশির মান প্রকাশ করতে হলে দুটি বিষয়ের প্রয়োজন ১. রাশির একক এবং ২. এককের তুলনায় রাশিটি কত গুণ সেই সংখ্যা।

পরিমাপের একক কাকে বলে বা কি ( সংজ্ঞা)

কোন একটির ভৌত রাশির একটি নির্দিষ্ট এবং সুবিধাজনক পরিমাণকে প্রমাণ রাশি ধরে, প্রদত্ত রাশিটির পরিমাণ, এই প্রমাণ মানের কতগুণ হয় হিসাব করে, ওই জাতীয় সব রাশির পরিমাপ করা হয়। এই নির্দিষ্ট প্রমাণ রাশিকে পরিমাপের একক বলে।

এককের প্রয়োজনীয়তা

কন ভৌত রাশিকে পরিমাপ করতে হলে নির্দিষ্ট এককের প্রয়োজনীয়তা আছে। কারন ভৌত রাশির পরিমাপের ক্ষেত্রে একক-বিহীন সংখ্যা অর্থহীন হতে পারে। যেমন – বাশটি বেশ লম্বা বললে বাঁশটির দৈর্ঘ্য সম্বন্ধে এক একজনের মনে এক এক রকম ধারণা হবে। কিন্তু বাঁশটি ২০ ফুট লম্বা বললে বাশের দৈর্ঘ্য সম্বন্ধে আমাদের সকলের মনের সঠিক ধারণা তৈরি হয়। এখানে দৈর্ঘ্য একটি ভৌত রাশি । এর পরিমাপের জন্য ফুটকে একক রূপে ব্যবহার করা হয়েছে।১ ফুট কতটা লম্বা জানা আছে সকলের। কাজেই বোঝা গেল বাঁশের দৈর্ঘ ১ ফুট দৈর্ঘ্যের কুড়ি গুন।

বাজার থেকে অনেক চাল কেনা হল অথবা বাজার থেকে ১০০ চাল কেনা হলো একথা বললে চালের সঠিক পরিমাণ সম্বন্ধে কিছু ধারণা করা যায় না। কিন্তু যদি বলা হয় বাজার থেকে ১০০ কেজি চাল কেনা হয়েছে তাহলে চালের পরিমাণটি সঠিক বোঝা যায়। এখানে কিলোগ্রামকে ভরের একক হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে।

কলকাতা থেকে খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি এলাম বললে কোলকাতা থেকে বাড়ি আসতে ঠিক কতটা সময় লাগলো তার সঠিক ধারণা করা সম্ভব হলো না। তবে যদি বলা হয় কলকাতা থেকে ফিরতে ১ ঘণ্টা সময় লেগেছে তাহলে স্বচ্ছ ধারনা হয়। এখানে ঘণ্টাকে সময়ের একক রূপে ব্যবহার করা হয়েছে।

সুতরাং দেখা গেলো প্রত্যেক ভৌত বা প্রাকৃতিক রাশি সঠিক পরিমাপের জন্য একটি এককের প্রয়োজন। এককহীন পরিমাপের কোন মানে হয় না। একক না থাকলে কোন রাশি পরিমাপ করা যায় না। ভৌত রাশি পরিমাপের দুটি অংশ প্রথমটি হল সংখ্যা এবং দ্বিতীয়টি হলো একক।

বিভিন্ন ভৌতরাশির এককগুলি পরম্পর আলাদা হয়। কিন্তু এই অসংখ্য ভৌতরাশির এককণুলিকে মাত্র তিনটি রাশির এককের সাহায্যে প্রকাশ করা যায়। এই রাশি তিনটি হল দৈর্ঘ্য, ভর ও সময়।

একক কত প্রকার ও কি কি ( মৌলিক একক এবং লব্ধ একক )

একক দুই প্রকারের

১.মৌলিক বা প্রাথমিক একক এবং ২. লব্ধ একক বা যৌগিক একক

[wpda_org_chart tree_id=8 theme_id=51]

মৌলিক একক কি বা কাকে বলে ( সংজ্ঞা )

পদার্থবিজ্ঞানে হাজার হাজার ভৌত রাশি আছে, কিন্তু দেখা গেছে রাশির সংখ্যা অনেক হলেও মাত্র তিনটি রাশির একক এর সাহায্যে বাকি সব রাশির একক গুলিকে সহজে প্রকাশ করা যায়। এই তিনটি রাশি হল দৈর্ঘ্য, ভর, এবং সময়। এই তিনটি রাশির এককগুলি পরস্পরের উপর নির্ভরশীল নয় অর্থাৎ একটি অন্যটির উপর নির্ভর করে না। সেই জন্য দৈর্ঘ্য, ভর, এবং সময়ের একককে মূল একক বা মৌলিক একক বা প্রাথমিক একক বলা হয়।

দৈর্ঘ্য ভর এবং সময় এই তিনটি রাশির একক পরস্পরের উপর নির্ভর করে না এবং এই তিনটি রাশির একক থেকে অন্যান্য সমস্ত রাশির একক গঠন করা যায় এদেরকে মৌলিক বা মূল বা প্রাথমিক একক বলে।

আগে প্রধানত তিনটি পদ্ধতিতে প্রাথমিক এককগুলিকে প্রকাশ করা হত। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে পরিমাপের আন্তর্জাতিক একক পদ্ধতি (Intenational System of Units) বা S.I. একের ব্যাপক প্রচলন ঘটেছে।

লব্ধ বা যৌগিক একক কি বা কাকে বলে ( সংজ্ঞা)

অন্যান্য রাশির একক যা এক বা একাধিক মৌলিকের সাহায্যে গঠন করা যায় তাদেরকে লব্ধ একক বলে।
যেমন আয়তাকার ক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল একটি ভৌত রাশি। ক্ষেত্রফল= দৈর্ঘ্য ×প্রস্থ । সুতরাং ক্ষেত্রফলের একক =দৈর্ঘ্যের একক ×দৈর্ঘ্যের একক = (দৈর্ঘ্যের একক)²। এখানে দেখা যায় ক্ষেত্রফল বা আয়তনের একক দৈর্ঘ্যের একক এর সাহায্যে গঠিত হয়েছে। সুতরাং ক্ষেত্রফল এবং আয়তনের একক হল লব্ধ একক।

মূল এককের বিভিন্ন পদ্ধতি বা এককের বিভিন্ন পদ্ধতি


মূল একককে প্রকাশ করার প্রধানত তিনটি পদ্ধতি আছে ।

সি জি এস পদ্ধতি বা মেট্রিক পদ্ধতি বা C.G.S. পদ্ধতি

সি জি এস পদ্ধতিতে দৈর্ঘ্যের একককে সেন্টিমিটার, ভরের একক গ্রাম এবং সময়ের একক সেকেন্ড দ্বারা প্রকাশ করা হয়। সেন্টিমিটার-গ্রাম-সেকেন্ড (C.G.S. System) পদ্ধতিতে দৈর্য্যের একক সেন্টিমিটার, ভরের একক গ্রাম, এবং সময়ের একক সেকেন্ড। C.G.S. পদ্ধতিতে C অক্ষরটি সেন্টিমিটার G অক্ষরটি গ্রাম এবং S অক্ষর সেকেন্ড বোঝায় । একে সংক্ষেপে সি-জি-এস (C.G.S.) বা মেট্রিক পদ্ধতি বলে। মেট্রিক পদ্ধতিতে দৈর্য্য এবং ভরের এককের ভগ্মাংশ এবং গুণিতাংশগুলাে একে অন্যের সঙ্গে দশ বা দশের বিভিন্ন ধাত (power) দ্বারা সম্বন্ধযুক্ত । এই কারণে পদ্ধতিটিকে দশমিক পদ্ধতি বলা হয়। এই পদ্ধতিতে এক একক থেকে অন্য এককে যেতে দশমিক বিন্দুকে ডান বা বামদিকে এক বা একাধিক ঘর সরাতে হয়। যেমন, 27.35 সেন্টিমিটার = 273.5 মিলিমিটার এবং 52.5 গ্রাম = 5.25 ডেকাগ্রাম । এই কারণে সি-জি-এস. পদ্ধতিতে দৈর্ঘ্য এবং ভরের গণনা করা সহজ হয়।

FPS পদ্ধতি বা ব্রিটিশ পদ্ধতি

FPS পদ্ধতিতে দৈর্ঘ্যের একক কি ফুট ভরের একক পাউন্ড এবং সময়ের একক সেকেন্ড দ্বারা প্রকাশ করা হয়। এখানে F অক্ষরটি ফূট P অক্ষরটি পাউন্ড এবং S অক্ষর টি সেকেন্ড বোঝায়। পূর্বে ব্রিটিশ কমনওয়েলথ দেশগুলিতে এই পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। একে সংক্ষেপে এফ পি এস. (F.P.S.) বা ব্রিটিশ পদ্ধতি বলা হত। বর্তমানে ব্রিটিশ পদ্ধতি এমনকি ব্রিটেনেও অপ্রচলিত হয়ে গেছে।

এম কে এস পদ্ধতি

এই পদ্ধতিতে দৈর্ঘ্যের একক মিটার ভরের একক কিলোগ্রাম এবং সময়কে সেকেন্ড দ্বারা প্রকাশ করা হয়। এখানে M অক্ষরটি মিটার K অক্ষরটি কিলোগ্রাম এবং S অক্ষর টি সেকেন্ড বোঝায়।
বর্তমানে সারা বিশ্বে এম কে এস পদ্ধতিকেই আন্তর্জাতিক একক এসআই ইউনিট পদ্ধতির স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু সিজিএস পদ্ধতি ও অনেক ক্ষেত্রে প্রচলিত আছে। 1964 সালে ওজন ও পরিমাপের আন্তর্জাতিক কমিটি এককের এই পদ্ধতিটি অনুমােদন করেন। বর্তমানে আমাদের দেশে এই পদ্ধতিটির ব্যাপক প্রচলন ঘটেছে। এম-কে-এস. পদ্ধতি প্রকৃতপক্ষে দৈর্ঘ্য, ভর ও সময়ের এককের আন্তর্জাতিক পদ্ধতি।

আন্তর্জাতিক একক বা এস-আই পদ্ধতি (International System of units) :

একক নির্ধারণ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সংস্থা 1960 সালে এই পদ্ধতির প্রবর্তন করেন। এই পদ্ধতিতে এম.কে.এস. পদ্ধতির মৌলিক এককগুলির সঙ্গে আরও তিনটি রাশির একককে নেওয়া হয়েছে। এখানে দৈর্ঘ্য, ভর, সময়, তডিৎপ্রবাহ, উষ্ণতা ও আলােক দীপ্তির মৌলিক এককগুলি হল যথাক্রমে মিটার, কিলােগ্রাম, সেকেন্ড, অ্যাম্পিয়ার, কেলভিন ও ক্যান্ডেলা । আজকাল বৈজ্ঞানিক কাজকর্মের জন্য পৃথিবীর সব দেশে এস-আই. পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে।

3 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here