নিউটনের দ্বিতীয় গতিসূত্র : ভরবেগ এর একক – বল পরিমাপ – বলের একক

1
1428

নিউটনের দ্বিতীয় গতিসূত্র

নিউটনের দ্বিতীয় গতিসূত্র থেকে আমরা ১. ভরবেগ সম্বন্ধে ধারণা, ২. বল পরিমাপক সংজ্ঞা, ৩. বলের একক এবং ৪. বল পরিমাপের প্রণালী বিস্তারিত জানবো।

নিউটনের দ্বিতীয় গতিসূত্র সংজ্ঞা

কোন বস্তুর ভরবেগের পরিবর্তনের হার বস্তুর উপর প্রযুক্ত বলের সমানুপাতিক হয়। প্রযুক্ত বল যে দিকে ক্রিয়া করে, ভরবেগের পরিবর্তন সেই দিকেই হয়।

নিউটনের দ্বিতীয় গতিসূত্র থেকে আমরা ১. ভরবেগ সম্বন্ধে ধারণা, ২. বল পরিমাপক সংজ্ঞা, ৩. বলের একক এবং ৪. বল পরিমাপের প্রণালী জানতে পারি।

ভরবেগ

নিউটনের দ্বিতীয় গতিসূত্র বুঝতে হলে প্রথমে ভরবেগ কাকে বলে জানতে হবে। ধরা যাক ৫ পাউন্ড ভরের একটি চাকা ১০ ফুট/সেকেন্ড বেগে চলছে, ২৫ পাউন্ড ভরের আরেকটি চাকা ২ ফুট/সেকেন্ড বেগে চলছে, ৩০ পাউন্ড ভরের অপর একটি চাকা ১.৫ফুট/সেকেন্ড বেগে চলছে। চাকাগুলি সমানভাবে শক্ত একটি বেড়ার ওপর গিয়ে পড়লো। এখন দেখা যাবে প্রথম চাকাটি বেড়া সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে বেড়াকে ভেঙে ফেলল এবং বেড়াটিকে কিছুদূর ঠেলে নিজেও অচল হয়ে পড়ল।দ্বিতীয় চাকার ক্ষেত্রে দেখা গেল বেড়াকে ঠেলে একই দুরত্বে গিয়ে নিজে অচল হলো। এবং তৃতীয় চাকাটি বেড়াকে ধাক্কা খেয়ে অচল হলো কিন্তু বেড়াকে ঠেলে নিয়ে সরাতে পারল না।

ভরবেগের সংজ্ঞা বা ভরবেগ কাকে বলে

ভর এবং বেগের সমন্নয়ে কোন গতিশীল বস্তুর মধ্যে একটি ধর্মের সৃষ্টি হয় এই ধর্মকে বস্তুটির ভরবেগ বলে। অর্থাৎ ভরবেগ হলো গতিশীল বস্তুর ভর এবং বেগ উভয়ের সমন্বয়ে সৃষ্টি একটি ধর্ম।

ভরবেগ বস্তুর ভর এবং বেগের গুনফল দ্বারা পরিমাপ করা হয়।

কোন বস্তুর ভর m এবং বেগ v হলে বস্তুটির ভরবেগ সমান mv হবে। ভর বেগের মান এবং দিক দুইই আছে। বেগের অভিমুখ যেদিকে হয় ভরবেগের অভিমুখ সেই দিকে হয়। সুতরাং ভরবেগ একটি ভেক্টর রাশি

ভরবেগের একক

সব রাশির মত ভরবেগেরও একক আছে। নিচে ভরবেগের একক উল্লেখ করা হল–

সিজিএস পদ্ধতিতে ভরবেগের একক গ্রাম সেমি/সেকেন্ড।
এপিএস পদ্ধতিতে ভরবেগের একক পাউন্ড ফুট/সেকেন্ড।
এমকেএস পদ্ধতিতে ভরবেগের একক কিলোগ্রাম মিটার/সেকেন্ড।

ভরবেগের উদাহরন ও প্রয়োগ

১. একটি মালবাহী ট্রাক এবং একটি খালি ট্রাক প্রতি ঘন্টায় ৩০ কিলোমিটার বেগে চলছে। ট্রাক দুটির গঠন হুবহু এক। কোনটিকে থামাতে বেশি বল প্রয়োগ করতে হবে?
ট্রাক দুটির গঠন হুবহু এক হলেও খালি ট্রাকটির চেয়ে মালভর্তি ট্রাকের ভর বেশি–উভয়ের বেগ কিন্তু একই অর্থাৎ ৩০ কিলোমিটার/সেকেন্ড।

যেহেতু ভরবেগ = ভর × বেগ। তাই উভয়ের বেগ সমান হলেও মাল ভর্তি ট্রাকের ভর, খালি ট্রাকের ভরের চেয়ে বেশি। সুতরাং মালভর্তি ট্রাকের ভরবেগ, খালি ট্রাকের ভরবেগের চেয়ে বেশি হবে। যেহেতু মাল ভর্তি ট্রাকের ভরবেগ বেশি তাই ওকে থামাতে বেশি বল প্রয়োগ করতে হবে। কারণ নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র অনুযায়ী ভরবেগের পরিবর্তনের হার প্রযুক্ত বলের সমানুপাতিক হয়।

২. খালি ট্রাকটি যদি দ্বিগুন বেগে চলে তাহলে ওকে থামাতে আগের চেয়ে দ্বিগুণ বল প্রয়োগ করতে হবে মাল ভর্তি ট্রাকের ক্ষেত্রেও সেই একই ব্যাপার হবে।

৩. একটি ভারী এবং একটা হালকা বস্তুর উপর যদি একই সময় ধরে একই বল প্রয়োগ করা হয় তাহলে হালকা বস্তুটির গতিবেগ ভারী বস্তুর গতিবেগ এর চেয়ে বেশি হবে। যদিও বস্তুটির ভরবেগ একই থাকবে।

বল: বলের পরিমাপ, বলের একক

নিউটনের দ্বিতীয় গতি সূত্র থেকে বলের পরিমাপ পাওয়া যায়। কোন বস্তুর ওপর বল যে দিক থেকে প্রযুক্ত হয় সেই দিকে ভরবেগের পরিবর্তন হয়। অচল বস্তুর ভরবেগ শূন্য; কাজেই বল প্রযুক্ত হলে ভরবেগের সৃষ্টি হবে এবং ক্রমাগত বাড়তে থাকবে।
বস্তুর ভর কখনও বাড়ে না বা কমে না — স্থির থাকে, কাজেই ভরবেগ বাড়তে থাকা মানেই বেগ ক্রমাগত বাড়তে থাকার ফলে ত্বরণের সৃষ্টি হয়

এখন কোন গতিশীল বস্তুর গতির দিকে বল প্রয়োগ না করে বিপরীত দিকে বল প্রয়োগ করলে সেই দিকেই ভরবেগের পরিবর্তন হবে, অর্থাৎ বিপরীত দিকে ত্বরণের সৃষ্টি হবে ফলে বেগ কমতে থাকবে।

ধরা যাক একটি বস্তুর ভর m। বস্তুটি একদিকে u বেগে ধাবিত হচ্ছে। বস্তুটির উপর P মান বিশিষ্ট একটি বল সেই দিকেই t সময়ের জন্য প্রয়োগ করা হলো। ধরি এর ফলে বেগ বেড়ে গিয়ে একটি সময় পরে v হলো।

এই ক্ষেত্রে
প্রথমে ভরবেগ ছিল mu,
t সময় পরে ভরবেগ হলো mv,
ভরবেগের পরিবর্তন mv – mu,
ভরবেগের এই পরিবর্তন t সময়ে হলো
অতএব ভরবেগের পরিবর্তনের হার = (mv-mu)/t হবে।

বলের পরিমাপ ও একক
বলের পরিমাপ ও একক


নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র অনুযায়ী ভরবেগের পরিবর্তনের হার প্রযুক্ত বলের সমানুপাতিক।
অতএব P∞(mv-mu)/t
বা, P∞m(v-u)/t
এখন, (v-u)/t হলো বেগের পরিবর্তনের হার =ত্বরণ= f ধরি।
অতএব P∞mf;
ভেদের সূত্র অনুযায়ী P = kmf (k একটি ধ্রুবক)
এখানে P=প্রযুক্ত বলের পরিমাণ। k ধ্রুবকের মান বলের একক এর উপর নির্ভর করে।একক ভরের উপর যে বল প্রযুক্ত হয় একক ত্বরণ সৃষ্টি করে সেই বলকে যদি একক ধরা হয় তাহলে উপরের সমীকরণে P = 1, যখন m = 1, f = 1 বসিয়ে পাওয়া যায়
1 = k.1.1, অতএব k =1
উপরের সংজ্ঞানুসারে একক বলকে সূচিত করলে পাওয়া যায় P = mf
P = mf বলের মান নির্দেশক সমীকরণ। অর্থাৎ বল = ভর × ত্বরণ। এই সমীকরণের সাহায্যে বল পরিমাপ করা হয়।

P = mf সমীকরণ থেকে কি কি বিষয় জানা যায়

P = mf সমীকরণ থেকে নিচের বিষয়গুলো জানা যায়—-
১. প্রযুক্ত বল P এর অভিমুখ এবং বস্তুর গতির অভিমুখে একই হলে বস্তুটির বেগ বেড়ে যাবে ফলে ত্বরণের সৃষ্টি হবে । ত্বরন f = P/m হবে
২. বল যতক্ষণ ধরে প্রযুক্ত হয় ততক্ষণ প্রস্তুতির মধ্যে ত্বরণ সৃষ্টি হয় অর্থাৎ বস্তুটির বেগ বাড়তে থাকে।
৩. বলের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলে ত্বরণ সৃষ্টি হয় না অর্থাৎ বস্তুর বেগ আর বাড়ে না — বস্তুটি যে শেষ বেগ লাভ করেছিল সেই বেগে অর্থাৎ সমবেগে সরলরেখা ধরে চলতে থাকে।
৪. যদি প্রযুক্ত বলের অভিমুখ বস্তুটির গতির বিপরীত দিকে হয় তা হলে বস্তুটির বেগ কমে যাবে ফলে মন্দনের সৃষ্টি হবে
মন্দন f = P/m হবে

নিউটনের দ্বিতীয় গতিসূত্র থেকে প্রথম সূত্র প্রমাণ

নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র থেকে আমরা পাই m ভরবিশিষ্ট বস্তুর ওপর P বল প্রয়োগ করলে যদি বস্তুটি f ত্বরণ পায় তবে P = mf হয়। এখন P = 0 হলে f = 0 হবে। যেহেতু m কখনো শূন্য হয় না। অর্থাৎ বল প্রযুক্ত না হলে বস্তু ত্বরণহীন হবে।
এখন বস্তুটিই স্থির অবস্থায় থাকলে ত্বরণহীন হতে পারে আবার সমবেগে সরলরেখায় চলতে থাকলেও ত্বরণহীন হতে পারে।
সুতরাং বলা যায় যে বাইরে থেকে বস্তুর ওপর বল প্রযুক্ত না হলে স্থির বস্তুর স্থির অবস্থায় থাকবে অথবা গতিশীল বস্তুর বেগের সরলরেখায় চলতে থাকবে এটাই নিউটনের প্রথম সূত্র।

বলের একক

বলের একক দুই প্রকারের হয় যথা পরম একক এবং অভিকর্ষীয় একক।

সিজিএস পদ্ধতিতে বলের পরম একক

সিজিএস পদ্ধতিতে বলের পরম একক ডাইন
সিজিএস পদ্ধতিতে বলের একক ডাইনের সংজ্ঞা

1 গ্রাম ভরের কোন বস্তুর ওপর যে বল প্রয়োগ করলে 1 সেন্টিমিটার/সেকেন্ড² ত্বরণ সৃষ্টি হয় সেই বলকে এক ডাইন বল বলে।

এফ পি এস. পদ্ধতিতে বলের পরম একক

এপিএস পদ্ধতিতে বলের পরম একক পাউন্ডাল
এপিএস পদ্ধতিতে বলের একক পাউন্ডাল এর সংজ্ঞা
এক পাউন্ড ভরের কোন বস্তুর উপরে যে বল প্রয়োগ করলে 1 ফুট/সেকেন্ড² ত্বরণ সৃষ্টি হয় সেই বলকে এক পাউন্ডাল বল বলে।

পাউন্ডাল ও ডাইনের মধ্যে সম্পর্ক

এক পাউন্ডাল = এক পাউন্ড × 1 ফুট/সেকেন্ড²
= 453.6 গ্রাম × 30.48 সেন্টিমিটার/সেকেন্ড² সুতরাং 1 পাউন্ডাল 13825.7 ডাইন।

এম কে এস পদ্ধতিতে বলের পরম একক

এম কে এস পদ্ধতিতে বলের একক এর নাম নিউটন
এম কে এস পদ্ধতিতে বলের একক নিউটন এর সংজ্ঞা
1 কিলোগ্রাম ভরের কোন বস্তুর ওপর যে বল প্রয়োগ করলে 1 মিটার/সেকেন্ড² ত্বরণ সৃষ্টি হয় সেই বলকে এক নিউটন বলে। এক নিউটন সমান 10⁵ ডাইন।

নিউটন ও ডাইনের মধ্যে সম্পর্ক

নিউটন = 1 কিলোগ্রাম × 1 মিটার/সেকেন্ড² অতএব, 1000 গ্রাম × 100 সেন্টিমিটার/সেকেন্ড² সুতরাং, 1 নিউটন সমান 10⁵ ডাইন

নিউটন ও পাউন্ডাল মধ্যে সম্পর্ক

1 নিউটন = 1 কিলোগ্রাম × 1 মিটার/সেকেন্ড² অতএব, 2.2 পাউন্ড × 3.28 ফুট/সেকেন্ড², অতএব 7.2 পাউন্ডাল ( প্রায় )

বলের অভিকর্ষীয় একক

সিজিএস পদ্ধতিতে বলের অভিকর্ষীয় একক গ্রাম ভার
গ্রাম ভার এর সংজ্ঞা 1 গ্রাম ভরের কোন বস্তুকে পৃথিবী যে বল দ্বারা নিজের কেন্দ্রের দিকে আকর্ষণ করে সেই বলকে 1 গ্রাম ভার বলে।

এপিএস পদ্ধতিতে বলের অভিকর্ষীয় একক
এপিএস পদ্ধতিতে বলের অভিকর্ষীয় একক পাউন্ডাল ভার
পাউন্ডাল ভার এর সংজ্ঞা
এক পাউন্ড ভরের কোন বস্তুকে পৃথিবী যে বল দ্বারা তার নিজের কেন্দ্রের দিকে আকর্ষণ করে সেই বলকে এক পাউন্ডাল ভার বল বলে।

এম কে এস পদ্ধতিতে বলের অভিকর্ষীয় একক কিলোগ্রাম ভার।
কিলোগ্রাম ভার এর সংজ্ঞা
1 কিলোগ্রাম ভরের বস্তুকে পৃথিবী যে বল দ্বারা নিজের দিকে আকর্ষণ করে সেই বলকে এক কিলোগ্রাম ভার বলে।

এই ছিল নিউটনের দ্বিতীয় গতিসূত্র এবং তার থেকে পাওয়া ভরবেগ সম্বন্ধে ধারণা, বল পরিমাপক সংজ্ঞা, বলের একক এবং বল পরিমাপের প্রণালী বিস্তারিত ধারনা।

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here