নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্র ও উদাহরণ – ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া বল

1
2684

নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্র

স্কুলের বেঞ্চের উপর হাত রেখে খাড়াভাবে বল প্রয়োগ করা হলো। এই বল কার্যকর হলে প্রথম ও দ্বিতীয় সূত্র অনুযায়ী বেঞ্চের মধ্যে ত্বরণ সৃষ্টি হবে এবং বেঞ্চটি প্রযুক্ত বলের দিকে চলতে শুরু করবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে বেঞ্চটি প্রযুক্ত বলের দিকে চলছে না। হাত দিয়ে অনুভব করা যায় যে বেঞ্চটি বাধা দিচ্ছে। অর্থাৎ হাতের উপর সমান এবং বিপরীত মুখি বল প্রয়োগ করছে। এখন প্রযুক্ত বল বাড়ালে দেখা যাবে বিপরীত বল বাড়ছে এবং হাত স্থির অবস্থায় আছে। প্রযুক্ত বল কমানো হলে বোঝা যায় যে হাতের উপর বেঞ্চ দ্বারা প্রযুক্ত বিপরীত বল কমে গেছে। নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্র তে এ কথাই বলা হয়েছে।

নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্র সংজ্ঞা

প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।

ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া

কোন বস্তু অন্য একটি বস্তুর ওপর বল প্রয়োগ করলে প্রথম বস্তু দ্বারা দ্বিতীয় বস্তুর উপর প্রযুক্ত বলটিকে ক্রিয়া বলে। সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় বস্তুটিকে প্রথম বস্তুর উপর সমান এবং বিপরীত মুখি বল প্রয়োগ করবে। দ্বিতীয় বস্তু দ্বারা প্রথম বস্তুর উপর প্রযুক্ত বলটিকে প্রতিক্রিয়া বলে। উপরের উদাহরণে হাত বেঞ্চের উপর খারাপ হবে যে বল প্রয়োগ করে সেটি হলো ক্রিয়া। সঙ্গে সঙ্গে বেঞ্চটিও হাতের উপর বিপরীত দিকে যে সমান বল প্রয়োগ করলে সেটি প্রতিক্রিয়া। বস্তু দুটি স্থির বা সচল অবস্থায় থাকাকালে অথবা একটি অপরটিকে স্পর্শ করে বা স্পর্শ না করে পরস্পরের ওপর বল প্রয়োগ করতে পারে এবং সবক্ষেত্রেই নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্র টি প্রযোজ্য হবে।

ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া বল
ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া বল

নিউটনের তৃতীয় গতি সূত্র থেকে জানা যায় যে প্রকৃতিতে একক বিচ্ছিন্ন বল বলে কিছু নেই। বল সর্বদা দুটি বস্তুর মধ্যে ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া রূপে বর্তমান থাকে। যখন বলা হয় যে একটি বল ক্রিয়া করে তখন আসলে দুটি ক্রিয়াশীল বলের মধ্যে একটির কথাই বলা হয়। একটি বল হল অন্যটির পূরক এবং ওরা একসঙ্গেই ক্রিয়া করে। ক্রিয়া যতক্ষণ স্থায়ী হয় প্রতিক্রিয়াও ততক্ষণ স্থায়ী হয়, ক্রিয়া বন্ধ হলে প্রতিক্রিয়াও বন্ধ হয়ে যায়।

ক্রিয়া বল ও প্রতিক্রিয়া বল দুটির মান যে সমান এবং বিপরীত স্প্রিং তুলার সাহায্যে তা দেখানো যায়।
১. দুটি স্প্রিং তোলার হুক দুটি পরস্পর আটকে বাম ও ডান হাত দিয়ে স্প্রিং তোলার দু’দিকে ধরে বিপরীত দিকে টানলে দেখা যাবে যে দুটি স্প্রিং তুলার পাঠ একই হচ্ছে।
২. একটি স্প্রিং তুলাকে দেওয়ালে একটি হুকের সঙ্গে আটকে দেওয়া হল । এইবার অন্য একটি স্প্রিং তুলাকে প্রথম তুলার স্প্রিংয়ের আংটার সঙ্গে আটকে দ্বিতীয় তুলাটির অপর প্রান্তের হাতল ধরে টানা হলো। এই অবস্থাতেও দেখা গেল তুলাদুটির পাঠ একই হচ্ছে। প্রথম ক্ষেত্রে ডানহাত যত জোরে তুলায় টান দিচ্ছিল– বাম হাতটি সমান জোরে কিন্তু বিপরীত দিকে টান দিচ্ছিল। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে দ্বিতীয় তুলাটি প্রথম তুলাকে যে বলে নিজের দিকে টানে প্রথম তুলাও দ্বিতীয় তুলাকে সমান জোরে কিন্তু বিপরীত দিকে টান দিচ্ছে। প্রথম ক্ষেত্রে ডান হাতের টানটি ক্রিয়া হলে বাম হাতের টানটি হলো প্রতিক্রিয়া। এই পরীক্ষা দ্বারা স্পষ্টই প্রমাণিত হলো যে ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া পরস্পর সমান।

নিউটনের তৃতীয় সূত্রের উদাহরণ

নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্র এর বহু দৃষ্টান্ত আমরা আমাদের চারপাশের রোজই দেখতে পাই। কয়েকটি উদাহরণ নিচে দেওয়া হল

১. নৌকা ঘাটে এসে পৌছালো। একজন লোক নৌকা থেকে লাভ দিয়ে ঘাটে নামলো। দেখা গেল, নৌকা থেকে কাটে লাফ দেওয়ার সময় লোকটি নৌকার উপর একটি বল ক্রিয়া প্রয়োগ করলো,ফলে নৌকাটি পেছনের দিকে সরে যায় আর নৌকাটি ও লোকটির উপর সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া বল প্রয়োগ করে। যার ফলস্বরুপ লোকটি সামনের দিকে ঘাটে এসে পৌঁছে যায়।
২. দীপাবলির রাতে আমরা হাওয়াই বাজি আকাশে ফুটাই। এখানে হাওয়াই বাজিতে আগুন দিলে হাওয়াই বাজির ভিতর বারুদের যে দহন হয়, তার ফলে উৎপন্ন গ্যাস তীব্র গতিতে হাওয়াই বাজির নিচের ছিদ্র দিয়ে বের হয়। সেই জন্য যে প্রচন্ড বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া বলের সৃষ্টি হয় সেই প্রতিক্রিয়া বল হাওয়াই বাজি থেকে তীব্রভাবে আকাশের দিকে ঠেলে নিয়ে যায়।
৩. ক্রিকেট খেলার সময় যখন বলটিকে ব্যাটসম্যানের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া হয় তখন ব্যাটসম্যান বলটিকে ব্যাট দিয়ে আঘাত করে। এর ফলে বলের উপর ব্যাটের ক্রিয়ায় বলটি সামনের দিকে এগিয়ে যায়। সেই সঙ্গে বলটি ব্যাটের উপর সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া বল প্রয়োগ করে। ফলে ব্যাট পিছন দিকে সরে যায়।
৪. বন্দুক থেকে গুলি ছোড়ার সময়, যে বন্দুক চালায় সে পেছনদিকে একটি ধাক্কা খায়। বন্দুক থেকে গুলিটি সজোরে নির্গত হওয়ার সময় গুলিটি বন্দুকের উপর প্রতিক্রিয়া বল প্রয়োগ করে। ফলস্বরূপ বন্দুকটি পিছনে সরে যায়।

বায়ুশূন্য স্থানে পাখি উড়তে পারে না কেন

পাখি তার দুই ডানার সাহায্যে আকাশে ওড়ে। দুই ডানা দিয়ে ডানার নিচে বাতাসে আঘাত করে অর্থাৎ বলপ্রয়োগ করে। এটি হলো ক্রিয়া। এর ফলে বাতাসও নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী পাখির ডানার উপর সমান ও বিপরীতমুখী বল প্রয়োগ করে। এটি হলো প্রতিক্রিয়া বল। এর ফলে পাখি উড়তে পারে।বায়ুশূন্য জায়গায় কিন্তু পাখি উড়তে পারে না কারণ ডানার নিচের দিকে আঘাত করলেও বাতাস না থাকায় ডানার উপর প্রয়োগ করার মতো বিপরীতমুখী বল অর্থাৎ প্রতিক্রিয়া বলের সৃষ্টি হয় না। নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্র অনুসারে তাই পাখি বায়ুশূন্য স্থানে উঠতে পারে না।

আকাশে রকেট এবং জেট প্লেন কিভাবে উড়ে

নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্র অনুযায়ী ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া বলের আরেকটি উদাহরণ হল জেট প্লেন এবং মহাকাশ রকেট। রকেট এর মধ্যে জ্বালানি রাখা থাকে। উপরে ওঠার আগে ওই জ্বালানিতে আগুন ধরানো হয়। জালালের দ্রুত দহনের ফলে যে গ্যাস উৎপন্ন হয়, ওই গ্যাস প্রচণ্ড চাপের মধ্যে থাকে। উচ্চ চাপের ওই গ্যাস রকেটের নিচের দিক থেকে একটি সরু নল এর মধ্য দিয়ে তীব্র বেগে বেরিয়ে আসে। এর ফলে বিপরীতমুখী এক প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়া বলের সৃষ্টি হয়। এই প্রতিক্রিয়া বল ইমো রকেট কে মহাকাশে পৌঁছে দেয়।
বর্তমানে যেসব জেট প্লেন প্রচন্ড গতিতে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যায়,তাদের মধ্যে সঞ্চিত জ্বালানির দ্রুত দহনের ফলে উৎপন্ন গ্যাস প্রচণ্ড চাপে একটি সরু নলের মধ্য দিয়ে তীব্র বেগে বেরিয়ে আসে। এর ফলে উৎপন্ন প্রতিক্রিয়া বলতে জেট প্লেন কে সামনের দিকে তীব্রবেগে এগিয়ে নিয়ে যায়।

গতির সৃষ্টি হয় কেন

নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্র অনুযায়ী কোন উপায়ে ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া বল দুটির একটিকে কার্যকর হওয়ার সুযোগ দিলে আর অন্যদিকে কার্যকর হতে না দিলে প্রথম বলটির জন্য প্রস্তুতিতে গতির সৃষ্টি হবে। ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া বল দুটি কখনো একই বস্তু থেকে সৃষ্টি হয় না। ক্রিয়া থেমে গেলে প্রতিক্রিয়াও থেমে যায়।

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here