থার্মোমিটার
থার্মোমিটার এর সংজ্ঞা
যে যন্ত্রের সাহায্যে কোন বস্তুর উষ্ণতা মাপা যায়, তাকে থার্মোমিটার বলে। যে থার্মোমিটারে পারদ ব্যবহার করা হয়, তাকে পারদ থার্মোমিটার বলে।
পারদ থার্মোমিটার এর গঠন বর্ণনা
১. পারদ থার্মোমিটার যন্ত্রটি হল সমান ব্যাসের সূক্ষ্ম ছিদ্রবিশিষ্ট কাচের একটি নল।
২. এই নলের এক প্রান্তে পারদপূর্ণ পাতলা দেওয়ালবিশিষ্ট একটি বাল্ব থাকে, অন্য প্রান্তটি বন্ধ করা থাকে।
৩. থার্মোমিটারের বাল্বটি সম্পূর্ণরূপে এবং নলটির কিছু অংশ পূর্ণ থাকে। নলের বাকি অংশে পারদ বাষ্প ছাড়া আর কিছু থাকে না।
৪. নলটির গায়ে তাপমাত্রা স্কেল আকা থাকে।
৫. যে বস্তুর উষ্ণতা মাপতে হবে সেই বস্তুর সংস্পর্শে থার্মোমিটারের বাল্বটি আনলে ওর মধ্যস্থ পারদের আয়তন বেড়ে যায়, ফলে বাল্বের পারদ, নলের সরু ছিদ্র দিয়ে উঠে যে দাগ পর্যন্ত পৌঁছায়, সেটি ওই বস্তুর উষ্ণতা নির্দেশ করে।
থার্মোমিটারের নিম্ন স্থিরাঙ্ক ও ঊর্ধ্ব স্থিরাঙ্ক
উষ্ণতা মাপার জন্য থার্মোমিটারে স্কেল তৈরি করতে হলে প্রমাণ চাপে বিশুদ্ধ জলের দুটি অবস্থান উষ্ণতা নেওয়া হয়। আর থার্মোমিটারের পাঠ নেওয়ার জন্য নিম্ন স্থিরাঙ্ক ও ঊর্ধ্ব স্থিরাঙ্ক এর বিশেষ প্রয়োজন হয়।
নিম্ন স্থিরাঙ্ক
প্রমাণ চাপে বিশুদ্ধ বরফের মধ্যে থার্মোমিটারের বাল্বটিকে ডুবিয়ে রাখলে ঠান্ডায় বাল্বের পারদের সংকোচন হয়, ফলে নলের পারদ সূত্র নিচের দিকে নেমে এসে এক জায়গায় স্থির থাকে। এখানে একটি দাগ দেওয়া হয়। এই দাগকে নিম্ন স্থিরাঙ্ক বলে।
নিম্ন স্থিরাঙ্কের সংজ্ঞা
প্রমাণ চাপে যে উষ্ণতায় বিশুদ্ধ বরফ গলে জল হয় অথবা জল জমে বরফ হয়, সেই উষ্ণ তাকে থার্মোমিটারের নিম্ন স্থিরাঙ্ক বলে।
থার্মোমিটারের ঊর্ধ্ব স্থিরাঙ্ক
থার্মোমিটারের বাল্বকে প্রমাণ চাপে ফুটন্ত জলের উপরে রাখলে বাল্বের মধ্যে পারদের আয়তন বাড়ে। পারদ সূত্রটি তখন উপরের দিকে উঠে যায়। এবং পরে এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়ায়; এখানে একটি দাগ দেওয়া হয়। এই দাগটিকে ঊর্ধ্ব স্থিরাঙ্ক বলে।
ঊর্ধ্ব স্থিরাঙ্ক সংজ্ঞা
প্রমাণ চাপে যে উষ্ণতায় বিশুদ্ধ জল বাস্পে পরিণত হয়, সেই উষ্ণতাকে থার্মোমিটারের ঊর্ধ্ব স্থিরাঙ্ক বলে।
এই ঊর্ধ্ব স্থিরাঙ্ক ও এবং নিম্ন স্থিরাঙ্ক ও মাঝের দূরত্বওকে মূল বা প্রাথমিক অন্তর বা ব্যবধান বলে।
উষ্ণতা মাপার বিভিন্ন স্কেল
উর্ধ ও নিম্ন স্থিরাঙ্ক এর মাঝের দূরত্বকে বিভিন্ন সংখ্যক সমান অংশে ভাগ করলে উষ্ণতার বিভিন্ন স্কেল পাওয়া যায়। প্রত্যেকটি অংশকে ডিগ্রী বলে। বস্তুর উষ্ণতা মাপার জন্য মোটামুটি দু’রকমের স্কেল ব্যবহার করা হয়।
১. সেন্টিগ্রেড বা সেলসিয়াস স্কেল এবং
২. ফারেনহাইট স্কেল
১. সেন্টিগ্রেড বা সেলসিয়াস স্কেল
এই স্কেলে বরফের গলনাঙ্ককে জিরো (০) ডিগ্রী (নিম্ন স্থিরাঙ্ক) এবং জলের স্ফুটনাঙ্ককে (প্রমাণ চাপে) 100 ডিগ্রী (ঊর্ধ্ব স্থিরাঙ্ক) ধরে মাঝের স্থানকে সমান 100 ভাগে ভাগ করা হয়। প্রত্যেক ভাগ্যে 1 ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বা সেলসিয়াস ডিগ্রি বলা হয়।
২. ফারেনহাইট স্কেল
এই স্কেলে বরফের গলনাঙ্ক কে 32 ডিগ্রি (নিম্ন স্থিরাঙ্ক) এবং জলের স্ফুটনাঙ্ককে (প্রমাণ চাপে) 212 ডিগ্রী (ঊর্ধ্ব স্থিরাঙ্ক) ধরে মাঝের অংশকে সমান 180 ভাগে ভাগ করা হয়। প্রত্যেক ভাগকে 1 ডিগ্রি ফারেনহাইট বলে।
সেন্টিগ্রেড বা সেলসিয়াস স্কেল এবং ফারেনহাইট স্কেলের মধ্যে সম্পর্ক
সেন্টিগ্রেড স্কেলের 100 ঘর = ফারেনহাইট স্কেলের 180 ঘর
100 সেলসিয়াস ডিগ্রি = 180 ফারেনহাইট ডিগ্রী
অতএব এক সেলসিয়াস ডিগ্রি = 180/100 = 9/5 ফারেনহাইট ডিগ্রী।
এবং এক ফারেনহাইট ডিগ্রি = 100/180=5/9 সেলসিয়াস ডিগ্রি।
এখন কোন বস্তুর উষ্ণতা সেন্টিগ্রেড স্কেলে Cডিগ্রী এবং ফারেনহাইট স্কেলে F ডিগ্রী হলে দুই স্কেলের সম্পর্ক নিচে সমীকরণ দ্বারা প্রকাশ করা যায়
C/100 = (F-32)/180
বা, C/5 = (F-32)/9
ক্লিনিক্যাল থার্মোমিটার বা ডাক্তারি থার্মোমিটার
মানব দেহের উষ্ণতা মাপার জন্য বিশেষ ভাবে প্রস্তুত থার্মোমিটারকে ক্লিনিক্যাল থার্মোমিটার বা ডাক্তারি থার্মোমিটার বলে। সুস্থ অবস্থায় মানুষের শরীরের সাধারণ উষ্ণতা হলো 98.4 ডিগ্রী ফারেনহাইট। জীবিত মানুষের দেহের উষ্ণতা 95 ডিগ্রী ফারেনহাইটের কম বা 108 ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি হতে পারে না। তাই ডাক্তারি থার্মোমিটারে 95 ডিগ্রী ফারেনহাইট থেকে 110 ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত অংশায়িত করা হয়। এই থার্মোমিটারের বাল্বটির দেওয়াল খুব পাতলা হয়। সমান প্রস্থচ্ছেদবিশিষ্ট এবং সূক্ষ্ম হয়। বাল্ব ও নলের ছিদ্রের মাঝে একটা বাঁকানো ছিদ্রপথ থাকে। এই অংশটি গাটের মত কাজ করে।
থার্মোমিটারের সরু নলটি এই গাটের কাছে আরও শরু করা থাকে। দেহের উষ্ণতা মাপার সময় থার্মোমিটারের বাল্বটিকে জিভের নিচে বা বগলের মধ্যে মিনিট দুয়েক রাখতে হয়। এর ফলে বাল্বের পারদ দেহের উষ্ণতা লাভ করে। দেহের উষ্ণতা অনুযায়ী বাল্বের পারদ আয়তনে বেড়ে ওই গাটটির ভেতর দিয়ে সহজে চলে যায় এবং নলের ছিদ্রের মধ্যে এগিয়ে যায়।কিন্তু ঠান্ডায় বাল্বের পারদ যখন সংকুচিত হয় তখন নলের ছিদ্র দিয়ে যে পারদ চলে আসে তা আর গাটের মধ্যে দিয়ে বাল্বের মধ্যে ফিরে যেতে পারে না। ফলে পারদ সূত্রটি থার্মোমিটারের উপরের অংশেই থেকে যায়। এইজন্য শরীরের উষ্ণতা নেওয়ার পর থার্মোমিটারকে বাইরে নিয়ে এলেও পারদ নিচে নেমে আসে না। শরীরের উষ্ণতাই নির্দেশ করে। ফলে থার্মোমিটারের পাঠ নিতে সুবিধা হয়। এই জাতীয় থার্মোমিটারকে গরিষ্ঠ থার্মোমিটার বলে।
ভালো থার্মোমিটারের কি কি গুন থাকা দরকার
নিচের গুণগুলো একটি থার্মোমিটারকে ভালো থার্মোমিটার হিসাবে পরিচয় দেয়।
১. থার্মোমিটারকে দ্রুত ক্রিয়াশীল করতে হলে বাল্বটির কাচ খুব পাতলা হতে হবে।
২. থার্মোমিটারের বাল্বের আকার ছোট হওয়া প্রয়োজন।এর ফলে বাল্বের পারদ দ্রুত অন্য বস্তু থেকে তাপ গ্রহণ করে বস্তুর উষ্ণতা লাভ করবে।
৩. নলের ব্যাসের প্রস্থচ্ছেদ সব জায়গায় সমান হতে হবে। তা না হলে সরু জায়গায় পারদ সূত্রটি বেশি উঠে যাবে এবং মোটা জায়গায় কম উঠবে। ফলে এস্কেল তৈরি করা কষ্টকর হবে।
৪. নলটি যত সরু এবং দীর্ঘ হবে থার্মোমিটার ততো সুবেদী হবে।
থার্মোমিটারে পারদ ব্যবহারের সুবিধাগুলি কি বা থার্মোমিটারে পারদ ব্যবহার করা হয় কেন
থার্মোমিটারে অন্যান্য তরল এরচেয়ে পারদ ব্যবহার করার সব দিক থেকে সুবিধাজনক। থার্মোমিটারে পারদ ব্যবহারের সুবিধা গুলি নিম্নরূপ—
১. পারদ অসচ্ছ এবং চকচকে বলে কাঁচের ভেতর দিয়ে স্পষ্ট দেখা যায়, ফলে পাঠের সুবিধা হয়।
২. জল বা অন্যান্য তরলের মত পারদ কাঁচের দেয়ালের সঙ্গে আটকে থাকে না। ফলে নলের মধ্যে সহজে ওঠানামা করতে পারে।
৩. বিশুদ্ধ পারদ সহজলভ্য।
৪. উষ্ণতার বিস্তীর্ণ পাল্লার মধ্যে পার্থক্য থাকে। পারদের হিমাঙ্ক -39 ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড এবং স্ফুটনাঙ্ক 357 ডিগ্রী সেন্টিগ্রেট। যার ফলে এর মাঝের যেকোনো উষ্ণতা মাপা যায়।
৫. অন্যান্য তরলের চেয়ে নির্দিষ্ট উষ্ণতার অন্তরে পারদের প্রসারণ বেশি হয়। ফলে পারদ থার্মোমিটার দিয়ে উষ্ণতা সূক্ষ্মভাবে মাপা যায়।
৬. অন্য বস্তু থেকে খুব কম তাপ গ্রহণ করেই পারদের প্রসারণ হয়। ফলে বস্তুর উষ্ণতা পাওয়া যায়।
৭. উষ্ণতা বৃদ্ধির সঙ্গে পারদের প্রসারণ একই মাত্রায় হয়।
৮. অন্যান্য তরল এর চেয়ে পারদ অনুদ্বায়ী, তাই থার্মোমিটারের শূন্যস্থানে নগণ্য পরিমাণে পারদ বাষ্প বর্তমান থাকে।
৯. পারদ তাপের সুপরিবাহী,তাই উষ্ণ প্রস্থ সংস্পর্শে আসা মাত্র বস্তুর উষ্ণতা গ্রহণ করে।
40 ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড উষ্ণতাকে ফারেনহাইট স্কেলে প্রকাশ করো
এখানে = 40 ডিগ্রি
ধরি, ফারেনহাইট স্কেলে পাঠ = F
অতএব, 40/5 = (F-32)/9
বা, F-32 = (9×40)/5 = 72
বা, F = 72+32 = 104
40 ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড = 104 ডিগ্রি ফারেনহাইট
কোন উষ্ণতায় সেন্টিগ্রেড ও ফারেনহাইট স্কেলের পাঠ একই হবে
ধরি, সেন্টিগ্রেড স্কেলে পাঠ = x অতএব ফারেনহাইট স্কেলে পাঠও x হবে
এখন x/5 = (x-32)/9
বা, 9x = 5(x-32)
বা, 9x-5x = -160
বা, 4x = -160
বা, x = -40
অর্থাৎ – 40 ডিগ্রি উষ্ণতায় সেন্টিগ্রেড এবং ফারেনহাইট থার্মোমিটার এর পাঠ একই হবে।