তাপ ও তাপমাত্রা | তাপ ও তাপমাত্রার (উষ্ণতা) মধ্যে পার্থক্য

1
1958

তাপ ও তাপমাত্রা

তাপ

কোন বস্তুতে হাত দিলে গরম লাগে আবার কোন বস্তুতে হাত দিলে ঠান্ডা অনুভব করা যায়। গরম জলে কিংবা সাধারণ কলের জলে অথবা বরফে হাত দিলে আমাদের শরীরের বিভিন্ন রকম অনুভূতি সৃষ্টি হয়। জলের এই তিন রকম অবস্থার মধ্যে যে পার্থক্য আছে তার প্রধান কারণ হলো তাপ। আজ আমরা তাপ ও তাপমাত্রা বিষয়ে জানবো।
যে বাহ্যিক কারণের জন্য কোন ঠান্ডা বস্তু গরম হয় বা গরম বস্তুর ঠান্ডা হয়ে যায় সেই কারণই হল তাপ । তাপ এক প্রকার শক্তি।

তাপ সম্বন্ধীয় ধারনা (বস্তু নাকি শক্তি)

তাপের স্বরূপ সম্বন্ধে দুটি মতবাদ প্রচলিত ছিল—

  • ক্যালোরিক মতবাদ
  • তাপের গতীয় মতবাদ
  • ক্যালোরিক মতবাদ
    100 বছরেরও আগে বিজ্ঞানীরা ভাবতেন যে, ক্যালোরিক নামে এক অদৃশ্য ভারহীন তরল বা গ্যাসীয় পদার্থ কোন বস্তুর ঠান্ডা বা গরম হওয়ার জন্য দায়ী। কোন বস্ততে কিছু পরিমাণ ক্যালোরি ঢুকে পড়লে বস্তুটি গরম হয় এবং কোন বস্তু থেকে কিছু পরিমাণ ক্যালোরি বের হয়ে গেলে বস্তুটি ঠান্ডা হয়ে যায়। কিন্তু এখন এই ধারণা ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে।
  • তাপের গতীয় মতবাদ
  • 1798 খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী রামফোর্ড লক্ষ্য করেন যে, কামানের নল তৈরি করার সময় বড় একটি ধাতু খণ্ডকে তুরপুন দিয়ে ছিদ্র করার সময় যে ধাতুর টুকরোগুলি ছিটকে বেরিয়ে আসে। সেগুলো খুবই উত্তপ্ত এই দেখে তার মনে প্রশ্ন জাগলো এই তাপ কোথা থেকে এলো। অনেক ভেবে তিনি সিদ্ধান্ত করেন যে, তুরপুন চালাতে যে যান্ত্রিক শক্তি খরচ হয়েছে, সেই যান্ত্রিক শক্তি এই তার সৃষ্টির কারণ। এই যান্ত্রিক শক্তি ধাতু খন্ডের অনুগুলির মধ্যে গতির সৃষ্টি করে, অনুকুলের এই গতি শক্তি তাপ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।
    বিজ্ঞানী জুল পরীক্ষার সাহায্যে এই মতবাদের সত্যতা প্রমাণ করেন এবং এটি সঠিক যে তাপ একটি শক্তি।

তাপ এর সংজ্ঞা বা তাপ কাকে বলে

আলোর মতো তাপও অদৃশ্য এবং তরঙ্গধর্মী। উৎস থেকে তরঙ্গের আকারে একস্থান থেকে অন্যস্থানে সঞ্চালিত হয়।
কোন পদার্থের অনুগুলির গতিশক্তি যদি কোনো উপায়ে বাড়ানো যায়, তবে পদার্থটি উত্তপ্ত হয়, অনুগুলির গতিশক্তি কমে গেলে পদার্থটি ঠান্ডা হয়।
নানা পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, তাপ সৃষ্টি করতে হলে শক্তির প্রয়োজন হয়। শক্তির অবিনশ্বরতা সূত্রে দেখা যায় যে, তাপ সৃষ্টির জন্য যে শক্তি ব্যয়িত হয় সেই শক্তি নষ্ট না হয়ে তাপে রূপান্তরিত হয়। এজন্য তাপকে একরকম শক্তি বলে ধরা হয়। সুতরাং বলা যায় যে,
তাপের সংজ্ঞা: তাপ হল এক রকম শক্তি, যা গ্রহণ করলে বস্তু উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং বর্জন করলে ঠান্ডা হয়ে যায়।

তাপের প্রকারভেদ

তাপ ও তাপমাত্রার মধ্যে পার্থক্য
তাপ ও তাপমাত্রার মধ্যে পার্থক্য

তাপকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়
১. বোধগম্য তাপ
২. লীন তাপ
৩. বিকীর্ণ তাপ

তাপের এই তিন প্রকারকে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো।

১. বোধগম্য তাপ:
অবস্থার পরিবর্তন না ঘটিয়ে কোন বস্তুর উপর যে তাপ প্রয়োগ করলে বস্তুর তাপমাত্রা বেড়ে যায়, সেই তাপকে বোধগম্যতা বলে। তাপমাত্রার এই পরিবর্তন থার্মোমিটারে ধরা যায়।

২. লীন তাপ
যে তাপ বস্তুর উপর প্রয়োগ করলে বস্তুর উষ্ণতা না বেড়ে বস্তুর অবস্থান পরিবর্তন ঘটে তাকে লীন তাপ বলে। এই তাপ থার্মোমিটারে ধরা পড়ে না।

৩. বিকীর্ণ তাপ
যে তাপ কোন উৎস থেকে বিকিরণ প্রণালীতে সঞ্চালিত হয় তাকে বিকীর্ণ তাপ বলে। অর্থাৎ যে তাপ জড় মাধ্যম ছাড়া অথবা মাধ্যম থাকলেও মাধ্যমকে উত্তপ্ত না করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সঞ্চালিত হয়, তাকেই বিকীর্ণ তাপ বলে। সূর্য থেকে যে তাপ পৃথিবীতে আসে তা হলো বিকীর্ণ তাপ।

তাপ পরিমাপের একক

তাপ পরিমাপ করার একক গুলি নিম্নে আলোচনা করা হল
সিজিএস পদ্ধতিতে তাপের একক হল ক্যালরি, এপিএস পদ্ধতিতে তাপের একক হল ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট, এস আই পদ্ধতিতে তাপের একক জুল । তাপ পরিমাপের যেসব একক প্রচলিত আছে সেগুলো হল

১. ক্যালোরি
এক গ্রাম বিশুদ্ধ জলের উষ্ণতা এক ডিগ্রি সেন্টিগ্রেট বাড়াতে যে পরিমাণ তাপের প্রয়োজন হয় সেই পরিমাণ তাপকে এক ক্যালোরি বলে।

২. ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট
এক পাউন্ড জলের উষ্ণতা এক ডিগ্রি ফারেনহাইট বাড়াতে যে পরিমাণ তাপের প্রয়োজন হয় সেই তাপকে এক ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট বলে।
এক ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট = 252 ক্যালরি।
তাপ পরিমাপের বড় একক হল থার্ম।
এক থার্ম = এক লক্ষ ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট। অর্থাৎ বলা যেতে পারে যে এক লক্ষ পাউন্ড বিশুদ্ধ জলের উষ্ণতা এক ডিগ্রি ফারেনহাইট বৃদ্ধি করতে যে পরিমাণ তাপের প্রয়োজন হয় তাকে এক থার্ম বলে।

উষ্ণতা বা তাপমাত্রা

উষ্ণতা বা তাপমাত্রা কি

প্রত্যেক বস্তুর মধ্যেই কিছু না কিছু তাপ থাকে। একটি বস্তু গরম কিংবা ঠান্ডা যাই হোক না কেন ওর মধ্যে কিছু তাপ থাকবেই। পাশাপাশি দুই বালতি গরম জল আছে। এদেরকে স্পর্শ করা হলো। দেখা গেল প্রথম বালতি জল বেশি গরম এবং দ্বিতীয় বালতি জল প্রথম বালতির তুলনায় কম গরম। অর্থাৎ দ্বিতীয় বালতির তুলনায় প্রথম বালতি তাপমাত্রা বেশি বোধ করা যায়। কোন বস্তুর মধ্যস্থ তাপের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এই বহিঃপ্রকাশটি হলো বস্তুর উষ্ণতা বা তাপমাত্রা। উষ্ণতা বা তাপমাত্রা বলতে পদার্থের মধ্যে তাপের একটি বিশেষ অবস্থাকে বুঝায়।
ধরা যাক, একটি বস্তু A কে অন্য একটি বস্তু B এর সংস্পর্শে রাখা হলো। এখন A যদি B কে তাপ দেয়, তবে বুঝতে হবে যে A এর উষ্ণতা B এর চেয়ে বেশি। বেশি উষ্ণতা বিশিষ্ট বস্তু থেকে কম উষ্ণতা বিশিষ্ট বস্তুর তাপ প্রবাহিত হয়। উষ্ণতাই তাপের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে।

উষ্ণতা বা তাপমাত্রার সংজ্ঞা

উষ্ণতা বা তাপমাত্রা হলো বস্তুর তাপীয় অবস্থা। এই অবস্থাই স্থির করে দেয় যে,একটি বস্তুকে অন্য একটি বস্তুর সংস্পর্শে রাখলে, প্রথম বস্তুটি দ্বিতীয় বস্তকে তাপ দেবে নাকি দ্বিতীয় বস্তু থেকে তাপ গ্রহণ করবে।

তাপ এবং তাপমাত্রা বা উষ্ণতার মধ্যে পার্থক্য

তাপ ও তাপমাত্রা নিয়ে আমাদের মধ্যে বুঝতে অনেক সময় একটু অসুবিধা হয়। যদিও তাপ এবং তাপমাত্রার মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে। সহজে তাপ ও তাপমাত্রা বুঝতে পারলে আর কখনো এই বিষয় নিয়ে কনফিউশন সৃষ্টি হবে না। তাহলে দেখা যাক তাপ ও তাপমাত্রার মধ্যে পার্থক্য কি।

  • ১. তাপ হল পদার্থের মধ্যে একরকম শক্তি এবং উষ্ণতা হলো ওই শক্তির প্রকাশ।
  • কোন বস্তুর তাপ বলতে বোঝায় যে, কি পরিমাণ তাপশক্তি প্রস্তুতির মধ্যে বর্তমান আছে। কোন বস্তুর উষ্ণতা বলতে বস্তুটির তাপীয় অবস্থা বোঝায়, যা দ্বারা বুঝা যায় যে, বস্তুটিকে অন্য এক বস্তু সংস্পর্শে আনলে প্রথম বস্তুটি তাপ গ্রহণ করবে নাকি ত্যাগ করবে। বস্তুর উষ্ণতা, তাপ শক্তির পরিমাণ নির্ণয় করে না।
  • ২. অবস্থার পরিবর্তন না ঘটলে তাপ কোন বস্তুর উষ্ণতা বৃদ্ধি করে। কোন বস্তুর মধ্যে তাপের পরিমাণ বাড়লে উষ্ণতা বাড়ে। তাই বলা যেতে পারে যে, তাপ বৃদ্ধি হল কারণ এবং উষ্ণতা বৃদ্ধি হল তার ফল।
  • ৩. দুটি বস্তু একই উষ্ণতায় থাকলেও ওদের মধ্যে তাপের পরিমাণ সমান নাও হতে পারে।
  • এক কেটলি ফুটন্ত জল থেকে এক কাপ জল পৃথক করলে দেখা যাবে উভয়ের উষ্ণতা একই, কিন্তু কেটলির জলে যে পরিমান তাপ আছে, কাপের জলে তাপের পরিমাণ তার চেয়ে অনেক কম। দুটিকে একসঙ্গে ঠান্ডা হতে দিলে দেখা যাবে যে, কাপের জল অনেক আগেই ঠান্ডা হয়ে গেছে। কাপের জলে তাপের পরিমাণ কম ছিল, তাই ওর তাপ কম সময়ের মধ্যেই বেরিয়ে গেছে, ফলে তাড়াতাড়ি ঠান্ডা হয়ে গেছে। কেটলির জলে বেশি পরিমান তাপ ছিল, তাই কেটলির জল কিন্তু তখনও গরম থেকে গেছে।
  • ৪. দুটি বস্তুর মধ্যে সমপরিমাণ তাপ থাকলেও ওদের উষ্ণতার পার্থক্য লক্ষ্য করা যেতে পারে।
  • ৫. দুটি বস্তুকে পরস্পরের সংস্পর্শে রাখলে, যে বস্তুর মধ্যে তাপের পরিমাণ বেশি, সেই বস্তু থেকে, যার তাপ কম তার মধ্যে তাপ চলে যাবে, এমন কোন কথা নেই।বরং যে বস্তুর উষ্ণতা বেশি সেই বস্তু থেকে কম উষ্ণতা বিশিষ্ট বস্তুর তাপ সঞ্চালিত হবে।
  • ৬. কিছু পরিমাণ জলের সঙ্গে ওর উপর তলের উচ্চতার সম্পর্ক, তাপের সঙ্গে উষ্ণতার সেই সম্পর্ক। অর্থাৎ তাপকে কোন পাত্রে রাখা জলের পরিমাণের সঙ্গে, এবং উষ্ণতাকে ওই পাত্রে রাখা জলের উপরিতলের উচ্চতার সঙ্গে তুলনা করা যায়।
  • ধরা যাক দুটি পাত্রে বিভিন্ন পরিমাণ জল আছে। যে-পাত্রে কম জল আছে তার উপরতল, যে-পাত্রে বেশি জল আছে তার উপরতলের চেয়ে বেশি উচ্চতায় আছে। এখন পাত্র দুটিকে একটি নল দিয়ে যোগ করলে উচু উপরতল বিশিষ্ট পাত্র থেকে অন্য পাত্রে জল আসতে থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত না উভয় ক্ষেত্রে জলের উচ্চতা এক হয়। ঠিক এইভাবে দুটি বিভিন্ন উষ্ণতাবিশিষ্ট দুটি বস্তুকে পরস্পরের সংস্পর্শে আনলে বেশি উষ্ণতার বস্তু থেকে কম উষ্ণতার বস্তুতে তার চলে আসবে যতক্ষণ পর্যন্ত না ওভার উষ্ণতায় এক হয়।

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here