তর্পণ অর্থ
তর্পণ অর্থ হলো বিদেহী (অর্থাৎ যে আত্মা দেহ শরীর ত্যাগ করেছে) আত্মার শান্তি কামনা শ্রদ্ধাভরে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করা হয়। অর্থাৎ আমাদের পার্থিব শরীর ছেড়ে আত্মা যখন পরলোকে গমন করে তখন ওই আত্মার পার্থিব জগতের যে উত্তরসূরিরা থাকে তাদের কাছ থেকে জল তিল পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা শ্রদ্ধা ভক্তি সহকারে উৎসর্গ করাকে তর্পণ বলে। চলুন তাহলে তর্পণ সম্বন্ধে আরও বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা যাক।
তর্পণ শব্দের অর্থ কি
তর্পণের কথা বলার আগে অভিধানে শব্দটির অর্থ যেমন লেখা আছে, তা পর পর তুলে দিই। লেখা আছে —- তৃপ্তিকরণ, তৃপ্তিজনন, পিতৃযজ্ঞ, পিতৃলােকের প্রীত্যর্থে জলদান— এই অর্থগুলির মধ্যে প্রথম দুটি সজীব ইহজগতের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যায়। কিন্তু যখনই তর্পণ বলছি তখনই তা ইহলােক ছেড়ে পরলােককে নির্দেশ করে, অনেকটা ব্যাকরণের যােগরুঢ় শব্দের মতাে। হিন্দুর অবশ্য কর্ম পাঁচটি মহাযজ্ঞ, যথা ব্রহ্মযজ্ঞ, পিতৃযজ্ঞ, দেবযজ্ঞ, ভূতযজ্ঞ এবং নৃযজ্ঞ। পিতৃযজ্ঞ ছাড়া আর সবগুলিই আমরা কমবেশি পালন করি। কিন্তু পিতৃযজ্ঞ সকলে করেন না। পিতৃযজ্ঞ হলাে পিতৃ গণের উদ্দেশে শ্রাদ্ধ বা অপর্ণাদি ক্রিয়া। দেখা যাচ্ছে, এই জগতে থেকে অন্যলােকের অধিবাসী পিতৃগণকে স্মরণ করে জলদানই তর্পণের মুল উদ্দেশ্য। ইদানীংকালে খ্যাতনামা পরলােকগত মানুষের স্মরণ, মনন, কীর্তন বা জীবন আলােচনাকেও স্মৃতি তর্পণ বলা হয়ে থাকে— তর্পণের মধ্যে স্মরণ মনন ব্যাপারটাই প্রধান সন্দেহ নেই। কিন্তু তর্পণ বলতে এক সঙ্গে যা বােঝায় তা হলাে স্মরণ মননের সঙ্গে মৃতের উদ্দেশে জলদান।
তর্পণ কেন করা হয়
বস্তুনিষ্ঠ ঐহিক যুক্তিবাদী যাঁরা তাঁদের ঝুলিতে তর্পণকে অস্বীকার করার মতাে অনেক উপকরণ আছে। তাঁরা প্রায়ই বলে থাকেন, মরা গােরু কি ঘাস খায়? তারা বলেন, যে দেহ পুড়ে ছাই হয়ে গেল তার উদ্দেশ্যে জল দেওয়ার অর্থ জলেই জল দেওয়া। মরার পরে আর কিছু থাকে না। অতএব ‘ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ’— এই ভারতেই চার্বাক দর্শন এই কথা প্রচার করছে।
এই প্রসঙ্গে একটি কাহিনী বলা যেতে পারে। সকলের জানা অকালবোধন দুর্গাপুজার ঠিক আগের কৃষ্ণপক্ষ কে বলা হয় পিতৃপক্ষ। পিতৃপক্ষের শুরু থেকেই বিশ্বাসী মানুষ পিতৃগণের উদ্দেশ্যে পিণ্ড দেয় কেউ বা তর্পণ করে। অনেকে আছেন এই পক্ষের প্রতিদিনই তর্পণ করেন। শেষ দিন অর্থাৎ অমাবস্যাকে মহালয়া বলা হয়। এইদিন গঙ্গা-সহ প্রায় সমস্ত নদ নদীর তীরে তর্পণ অনুষ্ঠান হয়। এমনি এক মহালয়ার যােগে অসংখ্য মানুষ যখন তর্পণ করছেন তখন একটি পরলােক অবিশ্বাসী মানুষ গঙ্গায় নেমে অঞ্জলি ভরে জল নিয়ে তীরের দিকে ছুঁড়ে ফেলছে। একজন কৌতুহলীর চোখে এ দৃশ্য পড়তে তাকে প্রশ্ন করল কেন সে এমন করছে। উত্তরে লােকটি বলেছিল— আমার বাড়িতে একটি শাকের তলা আছে আমি এখান থেকেই তাতে জল দিচ্চি। স্বভাবতই লােকটিকে পাগল বলার জন্য সে উত্তর দিয়েছিল— এখান থেকে যদি পরলােকে জল যেতে পারে, আমার এ জল শাকের তলায় যাবে না কেন? কাহিনীটি যুক্তিসংগত বলা যেতে পারে। শুধু তাই নয়, লােকটির যুক্তিকে তারিফও করা যেতে পারে।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে আরেকটি কাহিনী বলা যেতে পারে। একবার স্বামী বিবেকানন্দ কে একজন রাজা প্রশ্ন করেছিলেন ভগবানকে তো দেখা যায় না তাহলে তাকে আমরা মানবো কেন? বিবেকানন্দ তখন তাকে তার মৃত বাবার ছবিটি আনতে বলেন। এবং তাতে থুতু সেটাতে অনুরোধ করেন। ওই ব্যক্তি তো ভীষণ রেগে গেলেন। তখন স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন যে মানুষটি মারা গেছে তার ছবিতে থুতু সেটাতে গিয়ে আপনার শ্রদ্ধা আর ভক্তির বহিঃ প্রকাশ পেয়েছে। ঠিক তেমনি ভগবান অদৃশ্য হলেও তার অস্তিত্ব আছে। ঠিক তেমনি পরলোক বর্তমান। শুধু আছে নয় স্বমহিমায় আছে। ইহলােকের সঙ্গে তার নিরন্তর যােগাযােগ আছে। কেবল আমাদের জানা নাই তার সঙ্গে সংযােগ রক্ষার পদ্ধতিটি কি?
পরলােক যে আছে তা জানতে হলে আগে জানতে হবে মৃত্যু কি? কাব্য, সাহিত্য, দর্শন, শাস্ত্র সমূহ মৃত্যু সম্বন্ধ ভূরি ভূরি কথা বলছে। এত শান্ত্রীয় কথার ব্যবহার না করে চোখ কান খােলা রেখে মৃত্যু কি তা যতটুকু জানা যায় তাতেই আমরা তর্পণের প্রয়ােজন বুঝতে পারব।
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমরা এক কথায় বলি জীবনযাত্রা। এখানে যাত্রা কথাটি লক্ষণীয়। সাধারণ অর্থে যদি একে ‘চলা’ ধরে নিই তাহলে মৃত্যু কি চলার সমাপ্তি? কোনাে হিন্দু কিন্তু তা স্বীকার করে না। জন্মের পর মৃত্যু হলেও আবার জন্ম হবে আবার মৃত্যু অর্থাৎ অফুরান চলা। এ যাত্রা যেন চিরন্তন। এটাই পুনর্জন্মবাদ। হিন্দু তথা সনাতন ধর্মের মূল স্তম্ভ। এমনও দেখা গেছে যারা শ্রাদ্ধ তর্পণে বিশ্বাস করে না তারা পুনর্জন্মবাদ স্বীকার করে। তারা গীতার ‘বাসাংসি জীর্ণানি’ মান, “উর্ধ্বং গচ্ছতি স্বত্ত্বস্থা মান”, পাপ ও পুণ্য ক্ষয়প্রাপ্ত হলে তাকে আবার মর্তে আসতে হয় এটাও মানে, কিন্তু তর্পণ বা শ্রাদ্ধের কোনাে উপযােগিতা নেই, এ বিশ্বাসও তাদের মধ্যে আছে।
তাদের যে বিশ্বাস তা তাদেরই থাক, আমরা দেখি একটা মানুষ কীভাবে মরছে। ঋষি কথন বা শাস্ত্রবচন যাই বলি না কেন তাঁদের প্রত্যেকের একমত যে, মানুষের এই স্থূল শরীর মধ্যেই আরও দুটি শরীর মিশে আছে। তার একটির নাম সুক্ষ্ম শরীর, অন্যটি কারণ শরীর। তর্পণ কেন করব- এর উত্তরে সুক্ষ্ম শরীরের অস্তিত্বটি জানতে হবে। স্থুল শরীরের কার্যন্দ্রিয়, জ্ঞানেন্দ্রিয় স্থুল চোখে দেখা গেলেও এর কাজ কিন্তু সুক্ষ্ম ভাবে মস্তিস্কের ভেতরে অবস্থিত শিরা উপশিরাগুলি দিয়ে হয়। যে কথা কানে শুনলাম, যেদৃশ্য চোখে দেখলাম, বাইরের কান চোখ কেবল প্রেরকের মতাে নিজ নিজ কেন্দ্র পৌঁছে দেয়, মানুষের মন বুদ্ধি অহস্কার সেগুলিকে সংস্কারের সঙ্গে মিশিয় কর্মন্দ্রিয়কে নির্দেশ দেয় তবেই হয় শােনা ও দেখার কাজ। এরকম ঘ্রাণ, স্বাদ গ্রহণ, স্পর্শ সব কিছুই একই নিয়মে চলে। এবার ইহজগতে মানুষ যখন মরছে তার ওই স্থুল যন্ত্রপাতি মনকে আশ্রয় করে বুদ্ধি, অহঙ্কার এবং এ জীবনে অর্জিত কর্মফল সঙ্গে নিয়ে জীবাত্মায় মিশে।
যদিও সঠিক নয় তবু বােঝার জন্য জীবাত্মাকে প্রাণই বলি। এই প্রাণ জীবের কর্ম অনুসারে বিশেষ বিশেষ নাড়ী দিয়ে বেরিয়ে যায়। একেই বলা হয় মৃত্যু। এখানে শেষ বলা হলাে না বলা হলাে দেহটা ছেড়ে গেল। সে দেহ কেমন? ঠিক মৃত্যুর পর অদৃশ্য অথচ সুক্ষ্মইন্দ্রিয় স্বলিত একটি দেহ ধারণ করে। তার নাম অতিবাহিক দেহ। এ সময়টা বড় কষ্টের। সদ্য ছেড়ে যাওয়া জাগতিক কামনা বাসনা ক্ষুধা তৃষ্ণা সবই থাকে কিন্তু গ্রহণ করার কোনাে উপায় নেই। সূক্ষ্ম অদৃশ্য কর্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রীয় থাকলেও মনের প্রভুত্বে পরিচালিত হওয়ার জন্য মনের ক্রিয়া সেখানে একমাত্র ক্রিয়াশীল। ইহজগতের প্রিয়জন যদি স্মরণে মননে তাকে তৃষ্ণার জল দান করে, ক্ষুধার অন্ন দেয় তবে সুক্ষ্ম দেহ পরিতৃপ্ত হয়।
মানুষের কর্ম অনুসারে এই অতিবাহিক দেহ যতদিন থাকবে, তদিনই তার কামনাবাসনা থাকবে। প্রিয়জন যদি স্মরণে মননে জলের ধারার সঙ্গে তার প্রিয় বস্তু মনের দ্বারা উৎসর্গ করে তবে তার তৃপ্তি হয়। তর্পণের প্রয়ােজনীয়তা এই জন্য। জগতে থেকে যাঁরা স্নেহ দিয়ে ভালবাসা দিয়ে সুখে রেখে গেলেন, তাঁদের পারলৌকিক শান্তির জন্য এটা অবশ্য প্রয়ােজন। এই প্রসঙ্গে বলে নেওয়া ভাল অতিবাহিক দেহের পর সুক্ষ্মদেহ ধারণ, তারপর কর্মানুসারে স্বর্গে অথবা নরকে গমন, ভােগকাল শেষ হলে আবার জন্মগ্রহণ। এই জন্যই পৃথিবীকে বলা হয় কর্মভূমি, পরলােককে বলা হয় ভােগভূমি।
তর্পণ করার নিয়ম: তর্পণ কেমন করে করব
শাস্ত্রীয় বিধানে ব্রাহ্মণের প্রতিদিন দিন কৃত্য হিসাবে তর্পণ করা বিধি। অব্রাহ্মণদের জন্য পবিত্রযােগ আগে যেমন মহালয়ার কথা বলা হয়েছে তেমন পুণ্যযােগে তীর্থস্থানে বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে তর্পণ করার বিধান আছে। গয়া বা বদ্রীনাথে প্রেতশিলা, পুঙ্কর প্রভৃতি কয়েকটি ক্ষেত্রে পিতৃলােকের উদ্দেশ্যে পিণ্ডদানের বিধি আছে। ওড়িশার is viagra covered by insurance হিন্দু অধিবাসীদের অনেকেই জগন্নাথের সিংহদুয়ারের পর যে সিঁডিগুলি আছে সেখানে বসে পিণ্ডদান করতে ভালবাসেন। যােখানেই যেমন ভাবেই হােক স্মরণ, মনন ও তর্পণ অকুণ্ঠভাবে হলেই পিতৃগণ তৃপ্ত হন। শাস্ত্রে বলা হয়েছে—
নাস্তিক্য ভাবাৎ যশ্চাপি ন তর্পয়তি বে সুতঃ।
পিবন্তি দেহ রুধিরং পিতরাে বৈ জলা বিনা।।
ব্রাহ্মণদের নিত্য তর্পণের একটা ক্রম আছে, যাকে স্তরে বিন্যাস করলে— দেব তর্পণ, ঋষি তর্পণ, পিতৃতর্পণ, বিশ্ব তর্গণ প্রভৃতি পাওয়া যায়। কালের গুণে এখন সবাই নানাভাবে ব্যস্ত। তাই সম্পূর্ণ তর্পণ এখন খুব অল্প ব্রাহ্মণই করে থাকেন। এখনকার পণ্ডিতমণ্ডলী একটি সংক্ষিপ্ত তর্পণ বিধি চালু করেছেন। অনেকে সেটাই অনুসরণ করেন। যাঁরা কিছু না করাটা অন্যায় অথচ কিছু করতেই হয় তাঁরা পিতা, মাতা, পিতামহ, মাতামহ, পিতামহী, মাতামহীর উদ্দেশে তর্পণ করে শেষে ‘আব্রহ্মস্তস্ব পর্যন্তং জগৎ তৃপ্যতু’ বলে তিনবার জল অর্পণ করে তর্পণ শেষ করেন। ব্রহ্ম থেকে তৃণ পর্যন্ত সবার তৃপ্তি কামনাই তর্পণের মুখ্য উদ্দেশ্য।
তর্পণ অনুভব:
শরীর তৈরি হয়েছে বাবা-মায়ের থেকে পাওয়া জীবকোষ দিয়ে, তারাও তাদের পিতামাতার জীবকোষ থেকে সৃষ্টি হয়েছিলেন। আমরা যখন তর্পণে তাঁদের কথা স্মরণ করি তখন আমি যে ছিন্নমূল কেউ নয়, আমার অস্তিত্ব চিরন্তন— এই ভাবনাটাও মনে বাড়তি আনন্দ দেয়। এটা ব্যাখ্যা করে বােঝানাে সম্ভব নয়, নিজস্ব উর্বর অনুভবে এটা বােঝা যায়।