জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড কত সালে ও কোথায় হয়
১৩ এপ্রিল ১৯১৯ সালে পঞ্জাবের নববর্ষ ও গুরুগােবিন্দ সিংহ দ্বারা খালসা পন্থ প্রতিষ্ঠার দিন। সেইদিন বিকেল সাড়ে পাঁচটায় অমৃতসরের বিশ্ববিখ্যাত শিখ ধর্মস্থান স্বর্ণমন্দির বা হরিমন্দির সাহিবের ঠিক পাশেই অবস্থিত জালিয়ানওয়ালাবাগ নামক উদ্যানে ব্রিটিশের গুলিতে নিহত হন প্রায় ১৫০০ নিরস্ত্র নির্দোষ ভারতীয়। এই ভয়ংকর ঘটনাই আমাদের রক্তরঞ্জিত স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড নামে প্রসিদ্ধ।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট
১. পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্য বিস্তারের লালসা ব্রিটিশ ভীষণভাবে লালায়িত হয়ে গিয়েছিল। দুনিয়াজুড়ে সাম্রাজ্য বানানোর স্বপ্ন দেখতে থাকে তারা। 1757 সালে পলাশীর আম বাগানে বাংলার সম্রাট সিরাজদৌলা যুদ্ধে পরাস্ত হওয়ার পর থেকে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা খুইয়ে বসে। অকথ্য অত্যাচার, স্বাধীনতা হীনতা, জুলুম প্রভৃতি ভারতীয়দেরকে সেই সময়ে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাবাপন্ন হতে বাধ্য করেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এই অত্যাচারের মাত্রা আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায়। অসম্ভব দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, লাগামছাড়া কর সবকিছু মিলিয়ে ভারতীয়রা ছিল ভীষণ উদ্বিগ্ন।
২. জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই পঞ্জাব এবং অখণ্ড বাঙ্গলার বিপ্লবীরা ব্রিটিশ শাসকের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। ১৯১৫ সালে রাসবিহারী বসু, বাঘাযতীন প্রমুখ এবং পঞ্জাবের গদর পার্টির নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে বিদ্রোহ ঘটানাের যে প্রচেষ্টা হয়েছিল, যা ইতিহাসে ইন্দো জার্মান ষড়যন্ত্র’ বলে খ্যাত।
৩. এই সমস্ত বিপ্লবী কার্যকলাপ কড়া হাতে দমন করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার ১৯১৮ সালে এক প্রাক্তন বিচারপতি সিডনি রাওলাট-এর নেতৃত্বে ‘সিডিশন’ বা রাজদ্রোহ কমিটি গঠন করে। ১৮ মার্চ ১৯১৯ এই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ‘Anarchical and Revolutionary Crime Act’ বা সাধারণ ভাষায় ‘রাওলাটি অ্যাক্ট’ আইন হিসাবে প্রবর্তিত হয়। এই আইন অনুযায়ী স্থানীয় প্রশাসন যে কোনাে ভারতীয়কে ইচ্ছামতাে পরােয়ানা ছাড়াই তল্লাশি বা গ্রেপ্তার করতে পারত এবং কেবলমাত্র সন্দেহের ভিত্তিতে বিচার ছাড়াই এক বছর পর্যন্ত বন্দি রাখতে পারত।
স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয়রা এই আইনকে সাধারণের মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতার পক্ষে বিপজ্জনক বলে মনে করে এবং এর বিরুদ্ধে চারিদিকে প্রতিবাদ শুরু হয়। দেশের বিভিন্ন শহরে সত্যাগ্রহ সভা হয় এবং সাধারণ ধর্মঘট বা হরতালের ডাক দেওয়া হয় প্রথমে ৩০ মার্চ পরে পিছিয়ে ৬ এপ্রিল। কংগ্রেস আনুষ্ঠানিকভাবে সত্যাগ্রহের ডাক দেওয়ার আগেই পঞ্জাবে জোরালাে প্রতিবাদ শুরু হয়।
৪. এই সময়ে পঞ্জাবে ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের তীব্র জনরােষের অনেকগুলি কারণ ছিল— দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য নির্মমভাবে সৈন্য নিয়ােগ ও সরকারের আর্থিক দাবিদাওয়া আদায়, খাদ্যশস্যের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি, ব্রিটিশ যড়যন্ত্রের ফলে স্বদেশি ‘পিপলস ব্যাঙ্ক অব পঞ্জাব’ ধ্বংস ইত্যাদি। গদর পার্টির বিপ্লবের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর ব্রিটিশ ধরপাকড় আরও তীব্র হয়ে উঠেছিল। ভারতীয় সংবাদপত্রগুলিতে রাওলাট অ্যাক্টের বিরুদ্ধে লেখা প্রকাশিত হয় ও লাহাের, অমৃতসর, লুধিয়ানা, শিয়ালকোট, রাওয়ালপিন্ডি প্রভৃতি শহরগুলিতে প্রতিবাদ সভা আয়ােজিত হয়।
এর ফলে সারা প্রদেশে প্রতিবাদের পরিবেশ নির্মিত হয়- হরতালের দিন দোকানপাট বন্ধ থাকে ও মানুষ কালাে ব্যাজ ধারণ করে। পঞ্জাবের এই প্রতিবাদের নেতৃত্বে ছিলেন ডাঃ সত্যপাল, ডাঃ সাইফউদ্দিন কিচলু, রামভজ দত্ত চৌধুরী, শার্দল সিংহ কৌশীর প্রমুখ। ৯ এপ্রিল ছিল রামনবমী। হান্টর কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী ওই দিনের শােভাযাত্রায় চোখে পড়ার মতাে মুসলমান অংশগ্রহণ করে। সেই দিনই সন্ধ্যায় ডাঃ সত্যপাল এবং কিচলুকে গ্রেপ্তার করে ধর্মশালা শহরে প্রেরণ করা হয়।
৫. নেতাদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ১০ এপ্রিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে শহরের দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায় ও মানুষ রাস্তায় নামে। পুলিশ শান্তিপূর্ণ মিছিলের পথ আটকায় যার ফলে পাথর ছোড়া শুরু হয়। পুলিশ গুলি চালায় যার ফলে দশজন মারা যায় ও অনেকে আহত হয়। উন্মত্ত জনতা এর ফলে সরকারি সম্পত্তি অফিস, ব্যাঙ্ক, ডাকঘর রেল স্টেশন ইত্যাদি ব্রিটিশ শাসনের প্রতীক মনে করে ধ্বংস করত উদ্যত হয়। আক্রোশের শিকার হয়ে কয়েকজন ইউরােপীয় নিহত হয় ও এক ইংরেজ মহিলা সিটি মিশনারি স্কুলের ম্যানেজার মিস শারউড আক্রান্ত হন।
স্থানীয় নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তারের ফলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে সরকারের হাতের বাইরে বেরিয়ে যায় এবং শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহ পরিণত হয় গণ অভ্যুত্থান। ১৮৫৭র মহাবিদ্রোহের মতাে পরিস্থিতি আসন্ন ভেবে পঞ্জাবের লেফটেনান্ট গভর্নর স্যার মাইকেল ও’ডায়ার আতঙ্কিত হন। ১১ এপ্রিল তিনি সামরিক আইন ঘােষণা করেন এবং বিদ্রোহ দমনের জন্য জেনারাল রেজিনাল্ড ডায়ারকে অমৃতসর প্রেরণ করেন। জেনারাল ডায়ার বাহিনী নিয়ে সারা শহর দাপিয়ে বেড়িয়ে সমস্ত সভা ও জমায়েত নিষিদ্ধ করেন। গণঅভ্যুখান দমন করার জন্য তিনি শহরের বাসিন্দাদের উপর নিপীড়ন শুরু করেন।
যে ‘কুচা কুচিয়ানওয়ালা’ গলিতে মিস শারউড আক্রান্ত হয়েছিলেন সেখানে সমস্ত ভারতীয়দের হামাগুড়ির নির্দেশ দেওয়া হয়। এসম্বন্ধে পরবর্তীকালে হান্টর কমিশনের সামনে তার বয়ানে তিনি বলেছিলেন, “ভারতীয়রা তাদের দেবতার সামনে ভূমিতে মাথা ঠকিয়ে প্রণাম করে। আমি তাদের বােঝাতে চেয়েছিলাম যে একজন ব্রিটিশ মহিলা হিন্দু দেবতার মতােই পবিত্র, তাই তার সামনেও তাদের হামাগুড়িই দিতে হবে!” তবে সামরিক আইন এবং দমনপীড়ন তােয়াক্কা না করেই কয়েকজন স্থানীয় নেতা জালিয়ানওয়ালাবাগে প্রতিবাদ সভা ডাকেন। এই সভার দিনক্ষণ ঠিক হয় ১৩ এপ্রিল বিকেল সাড়ে চারটে। বৈশাখীর দিন।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পটভূমি
প্রতি বছরের মতাে বৈশাখী উপলক্ষ্যে আয়ােজিত মেলায় কেনাকাটা করতে বহু মানুষ আশপাশের গ্রামগুলি থেকে অমৃতসরে আসে। সারা শহর জুড়ে আনন্দ-ফুর্তি ও উৎসবের পরিবেশ। সকাল থেকেই বহু মানুষ মহিলা শিশু-সহ হরিমন্দিরে গুরুস্থানে প্রণাম করে পাশ্ববর্তী জালিয়ানওয়ালাবাগে এসে বিশ্রাম করে। এই উদ্যানটি মহারাজা রণজিৎ সিংহের আমলের অভিজাত জালিয়ানওয়ালা পরিবারের সম্পত্তি বলে এই নামে খ্যাত। উদ্যানটি উঁচু প্রাচীর বেষ্টিত এবং একটি সরু গলি তার একমাত্র প্রবেশ বা প্রস্থান পথ ছিল। উদ্যানের একদিকে একটি কুয়া এবং অন্যদিকে একটি সুফি কবরখানা।
ইতিমধ্যে জেনেরাল ডায়ারও সকাল থেকে শহরের চতুর্দিকে সামরিক আইন ও কার্ফু জারি সংক্রান্ত নির্দেশ বলবৎ করার জন্য ঘুরছিলেন। তবুও জালিয়ানওয়ালা বাগে বিভিন্ন অনুমান অনুযায়ী দশ থেকে কুড়ি হাজার মানুষ সমবেত হয়। এই সমাবেশ বন্ধ করার জন্য তিনি সকাল থেকে কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি, ফলে মানুষ নির্ভয়েই সমবেত হয় এবং নির্ধারিত সময়ে সভাও শুরু হয়।
বিকেল সাড়ে পাঁচটায় গাের্খা ও বালুচবাহিনী-সহ তিনি উদ্যানে প্রবেশ করেন কিন্তু তখনও কোনােরকম বিপদের আশঙ্কা না করেই সভার কাজ চলতে থাকে। ডায়ার যখন কোনােরকম সতর্কবাণী ছাড়াই গুলি করার নির্দেশ দেন। তখনও প্রথম কয়েক মূহূর্ত জনগণ মনে করে বােধহয় ‘ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার’ করা হচ্ছে। পরমূহূর্তেই চারপাশে গুলিবিদ্ধদের পড়ে যেতে দেখে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়নের চেষ্টা করে। কিন্তু একমাত্র বাহির পথ সেনাবাহিনী দ্বারা রুদ্ধ এবং চারপাশে প্রাচীর। অনেকে কুয়ার মধ্যে ঝাপ দিয়ে প্রাণরক্ষার চেষ্টা করে কিন্তু সেভাবেও বাঁচা সম্ভব ছিল না।
দশ মিনিট অবিরাম ১৬৫০ রাউন্ড গুলি চালনার পর যখন অবশেষে গুলির জোগান শেষ হয় তখন বাহিনী-সহ তিনি সেখান থেকে চলে যান। আহত ও নিহতরা একসঙ্গে স্তূপীকৃত হয়ে সারারাত সেই খােলা উদ্যানে পড়ে থাকে। সরকারি পক্ষ থেকে কোনাে চিকিৎসার বন্দোবস্ত হয়নি, আহতদের পানীয় জলও দেওয়া হয়নি। অমৃতসরের এক শিখ মহিলা নিহত স্বামীর খোঁজে সেখানে এসে স্বামীর নিথর দেহ আগলে জনমানবহীন মৃত্যুর স্তুপের মধ্যে কুকুর ও জংলি জানোয়ারের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য কীভাবে সারারাত সেই আহত-নিহতদের মাঝে কাটিয়েছিলেন, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের সেই মর্মান্তিক বিবরণ বর্তমানের জালিয়ানওয়ালাবাগ প্রদর্শনীস্থলে রক্ষিত আছে।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের গুরুত্ব ও প্রতিক্রিয়া
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের গুরুত্ব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের গুরুত্ব নিচে পয়েন্ট আকারে আলোচনা করা হল।
এই ভয়ংকর দশ মিনিটের মধ্যে ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৩৭৯ নিহত ও ১২০০ আহত। বেসরকারি অনুমান অনুষায়ী প্রকৃত সংখ্যা তার তিনগুণ বেশি। কংগ্রেস তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী অন্তত ১,০০০ মৃত ও অন্যান্য স্থানীয় অনুমান অনুযায়ী প্রায় ১,৫০০ মৃত। ঘটনার পর প্রথম কয়েক সপ্তাহ ব্রিটিশ সরকার জেনারাল ডায়ারের কাজের সমর্থন করে এবং সামরিক আইন বলবৎ রাখে অর্থাৎ নিবিচারে গ্রেপ্তার ও নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা চলতে থাকে। ঘটনার পরের দিন অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল গুজরানওয়ালাতে ক্ষিপ্ত জনগণকে দমন করার জন্য তাদের উপর আকাশ থেকে বােমাবর্ষণ হয়।
হান্টার কমিশন গঠন
কিন্তু ঘটনার বীভৎসতার খবর যখন পঞ্জাবের বাইরে ছড়িয়ে পড়ে এবং নিন্দা ও প্রতিবাদে সারাদেশ মুখর হয় তখন সরকার বাধ্য হয় ঘটনার তদন্তের জন্য হান্টার কমিশন গঠন করতে। এই কমিশন জেনেরাল ডায়ারকে দোষী সাব্যস্ত করে। কারণ তিনি কোনােরকম সতর্কবাণী ছাড়ই নিরপরাধ ও নিরস্ত্র মহিলা, পুরুষ ও শিশুদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কমিশনের সামনে ডায়ার বলেন যে তিনি এভাবে গুলি চালানার নির্দেশ দিয়েছিলেন বিদ্রোহী ভারতীয়দের মধ্যে ‘নৈতিক প্রভাব’ তৈরি করার উদ্দেশ্যে, অর্থাৎ ত্রাস তৈরি করে ভারতীয়দের দমিয়ে রাখার জন্য। সরকার তাঁকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয় যদিও কোনাে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। কিন্তু উগ্র ব্রিটিশ মহলে জেনারাল ডায়ারকে প্রশংসা ও সমর্থন করা হয়। হাউস অব লর্ডস তাকে সমর্থনের প্রস্তাব গ্রহণ করে ১২৬-৮৬ সংখ্যা গরিষ্ঠতায়। ব্রিটিশ সংবাদপত্র ‘মর্নিং স্টার’ তার সমর্থনে তহবিল গঠন করে ২৬,০০০ পাউন্ড চাঁদা তােলে।
হান্টার কমিশনের সামনে ভারতীয় বন্দিদের সাক্ষ্য প্রদান করতে না দেওয়ায় কংগ্রেস এই কমিশনকে বয়কট করে ও নিজস্ব তদন্ত কমিটি গঠন করে। এই তদন্ত কমিটিতে মদনমাহন মালব্য, মােতিলাল নেহরু, চিত্তরঞ্জন দাশ, আব্বাস ত্যাবজী ও পরে গান্ধীজীও সদস্য ছিলেন। এই কমিশন দীর্ঘ পরিশ্রমের ফলে ঘটনার সঠিক তথ্যগুলি ভারতবাসী এবং আন্তজ্জাতিক মহলে তুলে ধরতে পারে।
গান্ধীজী সত্যাগ্রহ প্রত্যাহার
গান্ধীজী হিংসার জন্য বেদনা প্রকাশ করেছিলেন কিন্তু ব্রিটিশদের হত্যাকাণ্ডের চাইতে তিনি অধিক বিচলিত হয়েছিলেন জনগণের শান্তিভঙ্গে। সত্যাগ্রহের আহ্বানকে তিনি ‘হিমালয় প্রমাণ ভুল ‘বলে উল্লেখ করেন। ঘটনার পরের দিন অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল ১৯১৯ বড়লাটের ব্যক্তিগত সচিব জে, এল. ম্যাফিকে লিখিত পত্রে তিনি বলেন, “আমি ভুল শুধরে নিচ্ছি। আমার নিজের গ্রহণ করা পদক্ষেপ আমি ফিরিয়ে নিচ্ছি। যতদিন পর্যন্ত আমার সহকর্মীরা জনগণকে শান্ত ও সংযত রাখতে সক্ষম না হচ্ছে, ততদিন আমি দিল্লি ও পঞ্জাবে প্রবেশ করব না। ফলে বর্তমানে আমার সত্যাগ্রহ আমার নিজের দেশবাসীর বিরুদ্ধেই চালিত হবে।”
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের দুই মাস পর গান্ধীজী সত্যাগ্রহ সম্পূর্ণভাব প্রত্যাহার করেন। অনেকের অভিযােগ, তিনি এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদের চাইতে খিলাফৎ আন্দোলনকে অধিক গুরুত্ব দেওয়ার ফলেই কংগ্রেস-এর বিরুদ্ধে কোনাে বৃহত্তর দেশব্যাপী আন্দোলন করেনি।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড ও রবীন্দ্রনাথ
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত ‘নাইট’ উপাধি পরিত্যাগ করেন। ৩০ মে বড়লাটকে প্রেরিত পত্রে তিনি লেখেন,“অদ্যকার দিনে আমাদের ব্যক্তিগত সম্মানের পদবিগুলা চতুর্দিকবর্তী জাতিগত অবমাননার অসামঞ্জস্যের মধ্যে নিজের লজ্জাকেই স্পষ্টতর করিয়া প্রকাশ করিতেছে, অন্তত আমি নিজের সম্বন্ধে এই কথা বলতে পারি যে, আমার যে সকল স্বদেশবাসী তাহাদের অকিঞ্চিৎকরতার লাঞ্জনায় মানুষের অযােগ্য অসম্মান সহ্য করিবার অধিকারী বলিয়া গণ্য হয়, নিজের সমস্ত বিশেষ সম্মান চিহ্ন বর্জন করিয়া আমি তাহাদের পার্শ্বে নামিয়া দাঁড়াইতে ইচ্ছা করি।” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই উপাধি বর্জন জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের গুরুত্ব অনেক বাড়িয়ে দেয়।
মাইকেল ও’ডায়ার হত্যা
জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডে আহত এক উনিশ বছর বয়সের যুবক ঘটনার প্রতিশােধকেই তার জীবনের লক্ষ্য বলে স্থির করেন। ১৯৪০ সালে অর্থাৎ ঘটনার একুশ বছর পর লন্ডনের ক্যাক্সটন হল-এ ভূতপূর্ব লেফটেনান্ট গভর্নর মাইকেল ও’ডায়ারকে হত্যা করে সমগ্র ভারতীয় জাতির পক্ষ থেকে প্রতিশােধ নেন সরদার উধম সিংহ। ব্রিটিশ সরকার তার মৃত্যুদণ্ড ঘােষণা করে ও কৃতজ্ঞ দেশবাসীর দ্বারা “শহিদ উপাধিভূষিত হয়ে উধম সিংহ ফাসির মঞ্চে প্রাণ বলিদান করেন।
শক্তিশালী স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড স্বাধীনতা আন্দোলনের মােড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। কংগ্রেসের সূচনালগ্ন থেকে যে নরমপন্থী ‘আবেদন-নিবেদন’-এর রাজনীতি বিদ্যমান ছিল সেই রাজনৈতিক ধারা অবলপ্ত হয়ে যায়। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয়দের মধ্যে ব্রিটিশদের কল্যাণকারী উদ্দেশ্য সম্বন্ধ যে ভ্রান্ত ধারণা ছিল তা চূর্ণ হয়ে যায়। হত্যাকাণ্ড এবং তার জন্য ব্রিটিশ জনমতের সমর্থন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্বার্থ এবং ভারতীয় জনগণের স্বার্থ সম্পূর্ণ পৃথক দিশায় ধাবিত। এই ঘটনাকে ঘিরে বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় বহু দেশাত্মবােধক গান, নাটক, কবিতা প্রভৃতি রচিত হয় এবং এর প্রভাবে পরবর্তীকালে স্বাধীনতা আন্দোলন আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। নরমপন্থীদের ‘আবেদন নিবেদন’ নীতি ছেড়ে শক্তিশালী স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা তৈরি করতে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের গুরুত্ব অপরিসীম।
নরেন্দ্র মোদী ও জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড
স্বাধীন ভারতে দেশভক্ত মানুষের জন্য জালিয়ানওয়ালাবাগ একটি তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। প্রাচীরের গায়ে গুলির দাগ দেখে এখনও আমাদের গায়ে কাঁটা দেয়। আর মনে মনে সেই দিনের সমস্ত শহিদ ও তাদের পরিবারবর্গকে আমরা শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করি। ২০১৯ সালের ১৩ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডস্থলে উপস্থিত হয়ে সমস্ত দেশবাসীর পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। ভারতের বাইরেও বিভিন্ন দেশে প্রবাসী ভারতীয়রা হত্যাকাণ্ডের শতবর্ষ পালন করেছেন এবং ব্রিটিশ সরকারের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনার দাবি বিভিন্ন মহল থেকে রাখা হয়েছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে এই দাবির যথার্থতা স্বীকার করলেও অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করতে অস্বীকার করেন।
ঘটনার শতবর্ষে দাঁড়িয়ে আমাদের স্মরণ করা দরকার কত আত্মত্যাগ ও রক্তপাতের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছি। ভারত আজ পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন দেশ, বিশ্বের পঞ্চম বৃহৎ অর্থনীতি, আজ আর কোনাে শত্রু আমাদের চোখ রাঙাতে পারে না, কিন্তু রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এই স্বাধীনতার মূল্য যদি আমরা না বুঝি তাহলে দাসত্বের সেই অন্ধকার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি অসম্ভব নয়।
তাই বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পুনর্বার সেই ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেওয়া আমাদের কর্তব্য।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের নায়ক কে ছিলেন
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের নায়ক ছিলেন পঞ্জাবের লেফটেনান্ট গভর্নর স্যার মাইকেল ও’ডায়ার।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের সময় ভারতের ভাইসরয় কে ছিলেন
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের সময় ভারতের ভাইসরয় ছিলেন লর্ড চেমসফোর্ড
জালিয়ানওয়ালাবাগের মাঠে কার নির্দেশে গুলি চলে
জালিয়ানওয়ালাবাগের মাঠে পঞ্জাবের লেফটেনান্ট গভর্নর স্যার মাইকেল ও’ডায়ারের নির্দেশে গুলি চলে ।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড কত সালে হয়
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড হয় ১৩ এপ্রিল ১৯১৯ সালে পঞ্জাবে।
জালিয়ানওয়ালাবাগ কোথায় অবস্থিত
জালিয়ানওয়ালাবাগ পাঞ্জাবের অমৃতসরের কাছে অবস্থিত। অমৃতসরের কাছেই ছিল প্রভাবশালী জালিয়ানওয়ালাবাগ পরিবার ও তাদের বাগান। 1919 সালে যে ভয়ঙ্কর কুখ্যাত জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল সেটি এই বাগানে হয়েছিল, যা জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত।