জগদীশ চন্দ্র বসু (আচার্য) | রচনা ও জীবনী

2
3517

জগদীশ চন্দ্র বসু ও তার জীবনী

আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু কে বলা হয় বিশ্বের অন্যতম বিজ্ঞান পথিকৃৎ। বলা হয়ে থাকে তিনি নাকি সময়ের আগেই পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন। তার যথার্থ বৈজ্ঞানিক মূল্যায়ন এখনো করা সম্ভব হয়নি।


জগদীশ চন্দ্র বসু সাধারণ মানুষের মাঝে পরিচিত “গাছের প্রাণ আছে” এই আবিষ্কারের মাধ্যমে। এছাড়াও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার নিঃশঙ্ক পদচারণা আমাদের অবাক করে দেয়। একাধারে জগদীশ চন্দ্র বসু ছিলেন পদার্থবিদ এবং উদ্ভিদ বিজ্ঞানী। আমরা সাধারণত ভেবে থাকি, এই দুটি বিষয়ের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। জগদীশ চন্দ্র বসু কিন্তু প্রমাণ করেছিলেন বিজ্ঞানের সব বিষয়গুলি একে অন্যের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত।

আমাদের দুর্ভাগ্য, পরাধীন দেশের বিজ্ঞানী হওয়াতে বিজ্ঞান সভা আছে তাকে ঠিকমতো মূল্যায়িত করা হয়নি। এখন অবশ্য সারা পৃথিবী জুড়ে আবার নতুন করে ওই বিজ্ঞান শুরু তাপসের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের পর্যালোচনা হয়েছে। অনেকে বলেছেন, কেবল মার্কোনীকে আমরা বেতার তরঙ্গ উদ্ভাবনের জনক হিসেবে স্বীকৃতি দেবো না, এরই পাশাপাশি আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু্র নামও মনে রাখতে হবে।

গাছের প্রাণ আছে প্রমাণ করে যিনি বিশ্বের বিজ্ঞানী মহলে আলোড়ন তুলেছিলেন তিনি স্থাপন করেছিলেন “বসু বিজ্ঞান মন্দির”। সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায় স্থাপিত এই কেন্দ্রটি আজ ভারতের অগ্রণী বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।


আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর পরিবার

জগদীশ চন্দ্র বসুর আবির্ভাব ঘটেছিল ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ৩০ শে নভেম্বর তারিখে। জন্মেছিলেন তিনি বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্গত ময়মনসিংহ জেলার ওই একই নামের শহরে।

জগদীশ চন্দ্রের বাবার নাম ভগবান চন্দ্র বসু। ভগবান চন্দ্র ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেছিল। সেই বছরই জগদীশ চন্দ্রের জন্ম হলো আর সেই বছরই ভগবান চন্দ্র ময়মনসিংহ জেলার ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টরের পদে নিযুক্ত হলেন।

জগদীশচন্দ্রের মায়ের নাম বামাসুন্দরী। ভগবান চন্দ্রের আদি নিবাস ছিল ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগনার রাঢ়িখাল গ্রামে। বসু পরিবার ছিলেন সেখানকার সম্মানিত পরিবার। তখনকার দিনে বিক্রমপুর ছিল শিক্ষাতে অগ্রণী গ্রাম। ভগবান চন্দ্র ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান ব্রাহ্ম। তখনকার ব্রাহ্মসমাজে সকলেই ছিলেন স্বাধীনচেতা এবং প্রগতিমনের অধিকারী। ভগবান চন্দ্র এবং বামাসুন্দরী দুজনেই আধুনিক চিন্তাধারাযর মানুষ ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই জগদীশচন্দ্র মা ও তার বাবার কাছ থেকে এই গুণ অর্জন করেছিলেন।

ভগবান চন্দ্রের মহানুভবতা তার কর্মজীবনের বিভিন্ন ঘটনা থেকে প্রতিফলিত হয়েছে। একটি ঘটনা থেকে বুঝতে পারা যায় কি ভীষণ আধুনিক মনের অধিকারী ছিলেন ওই ভদ্রলোক। একবার এক দুর্ধর্ষ ডাকাত ধরা পড়েছিল। ম্যাজিস্ট্রেট ভগবান চন্দ্রের এজলাসে তার বিচার হয়েছিল।সাক্ষ্যপ্রমাণে ঘটনার সঙ্গে ওই ব্যক্তির যোগসাজশ প্রমাণিত হলো। ভগবান যেন তাকে কঠিন কঠোর সাজা দিয়েছিলেন। জেল খাটার মেয়াদ শেষ হয়ে গেল। লোকটি নিজের গ্রামে ফিরে গেল। জেল খাটা আসামি, তার ওপর দুর্ধর্ষ ডাকাত। পাড়ার লোক তাকে ঢুকতে দিলো না। শেষ পর্যন্ত লোকটি এল ভগবান চন্দ্রের কাছে। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আসছে জেল খাটা আসামি এই ব্যাপারটা ভাবতেই পারা যায় না। সব শুনে ভগবান যেন তাকে নিজের বাড়িতে চাকরি দিয়েছিলেন।

জগদীশ চন্দ্রের বাল্য জীবন

সে ছিল শিশু জগদীশচন্দ্রের একান্ত সহচর। তার কাজ ছিল শিশু জগদীশ চন্দ্র বসুকে বিদ্যালয় নিয়ে যাওয়া এবং ছুটির পর বাড়িতে নিয়ে আসা। ডাকাতের কাঁধে চড়ে বালক জগদীশচন্দ্র প্রত্যেক দিন স্কুলে যেতেন। যেতে যেতে ওই ভদ্রলোক তার ডাকাত জীবনের অনেক গল্প বলতো। এভাবেই শিশু জগদীশচন্দ্র বড় হতে থাকেন।

সাধারণ মানুষের দুঃখ কষ্টের ম্যাজিস্ট্রেট ভগবান চন্দ্র খুবই অসহায় বোধ করতেন। তখন তিনি ফরিদপুরে ম্যাজিস্ট্রেট। সেখানে একটি মাত্র জেলা স্কুল ছিল। জেলার সাধারণ মানুষ এসে ভগবান চন্দ্রকে ধরল সেখানে একটি বাংলায় স্কুল স্থাপন করতে হবে। তাদের অনুরোধে ভগবান চন্দ্র একটি বাংলা স্কুল খুলেছিলেন।

সেই স্কুলেই পালক জগদীশচন্দ্র কে ভর্তি করে দেয়া হলো। তখনকার দিনে ম্যাজিস্ট্রেটের ছেলে সাধারন বাংলা মাধ্যমের স্কুলে পড়ছে এটি এক আশ্চর্য ঘটনা। উচ্চ শ্রেণীর সবাই তখন ইংরেজি শিক্ষার দিকে ঝুঁকছেন। সেই ঠুনকো আভিজাত্যের মায়া ত্যাগ করে জগদীশ চন্দ্র বসুকে বাংলা স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে ভগবান চন্দ্র প্রমাণ করলেন সব ব্যাপারেই তিনি নিজের পথেই হাঁটতে চান।

স্কুলে জগদীশচন্দ্রের ডাইনে বসতো তার পিতার এক মুসলমান চাপরাশির ছেলে। বাঁদিকে বসতো এক ধীবরের ছেলে। তাদের কাছে বালক জগদীশচন্দ্র পশুপাখি এবং অন্যান্য জীব জন্তুর জীবনবৃত্তান্ত শুনতেন স্তব্ধ বিস্ময়ে। এভাবে ছোট থেকেই তিনি প্রকৃতি পিয়াসী হয়ে উঠেছিলেন।

বিদ্যালয়ে যাতায়াতের পথে পড়তো অজস্র গাছপালা ও বন জঙ্গল। একদিন জগদীশচন্দ্র স্কুলে যাওয়ার পথে লজ্জাবতী লতা দেখতে পেলেন। তার সহপাঠী ম্যাজিক দেখাবার ছলে ওই লতাকে ছুঁয়ে দিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে ওই লতাটি নুয়ে পড়ল। এই ঘটনা বালক জগদীশচন্দ্রকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল। এরপর থেকে মাঝেমধ্যেই তিনি লজ্জাবতী লতাকে স্পর্শ করে দেখতেন গাছটি কেমন আচরণ করছে। এই ঘটনা দেখেই তার মনে প্রশ্ন জাগে তাহলে কি গাছেরও প্রাণ আছে ? তা না হলে গাছ এইভাবে স্পর্শ অনুভূতিতে সাড়া দিচ্ছে কি করে।

পরবর্তীকালে এই বিষয়ে গবেষণা করে তিনি বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাহলেই বুঝতে পারা যায় ছোটবেলার দু-একটি স্মৃতি কিভাবে আমাদের মনকে প্রভাবিত করে।

একবার ঠিক করলেন এবার থেকে আর কাঁধে চড়ে জগদীশচন্দ্র স্কুলে যাবেন না। তার জন্য পিতা একটা টাট্টু ঘোড়া কিনে দিলেন। ঘোড়ার পিঠে চড়ে বালক জগদীশচন্দ্র স্কুলে চলেছেন; এক মজার দৃশ্য বৈকি !

আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর অনুসন্ধিৎসা

গাছের প্রান আছে  জগদীশ চন্দ্র বসু
গাছের প্রান আছে

সারাদিন নানা কাজে ভগবান চন্দ্রকে ব্যস্ত থাকতে হত। ম্যাজিস্ট্রেটের ওপর একটা জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষার গুরুদায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়। তবু যত রাতই হোক বাড়ি ফিরে এসে জগদীশচন্দ্রের সাথে কথা বলতেন তিনি। ছেলের পড়াশুনার ব্যাপারটা তিনি নিজেই দেখাশোনা করতেন।রাতের খাওয়া শেষ হওয়ার পর তিনি পুত্রকে বিশ্ব বিজ্ঞানের নানা কাহিনী শোনাতেন গল্পের ছলে। সমস্ত দিন বালক জগদীশচন্দ্র যা দেখেছেন সব অকপটে বলতেন পিতার কাছে। এভাবেই বয়সের সীমা অতিক্রম করে তারা একে অন্যের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন।

জগদীশচন্দ্র প্রশ্ন করতেন “বনচাঁড়াল আর লজ্জাবতী গাছের লতা ছুয়েদিলে নুইয়ে পড়ে। কিন্তু আম জাম কাঁঠাল গাছের পাতা কেমন আচরণ করে না কেন?”

পিতা জবাব দিতেন ” হয়তো সব গাছের সাড়া দেওয়ার পদ্ধতি একরকম নয়। তবে মুনি-ঋষিরা বলে গেছেন মানুষ এবং পশু পাখির মধ্যে যেমন প্রাণ আছে গাছেরও তেমন প্রাণ আছে। তুমি বড় হয়ে ব্যাপারে আরও জানার চেষ্টা করো।” এভাবেই ভগবান চন্দ্র তার শিশুপুত্রের মনের মধ্যে অনুসন্ধিৎসার আগুন জালিয়ে দিয়েছিলেন।

গাছপালার পাশাপাশি জীবজন্তু সম্পর্কেও বালক জগদীশচন্দ্র অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। পথের ধারে ডোবায় সহপাঠীদের সঙ্গে তিনিও মাছ ধরতেন। বিশেষভাবে লক্ষ্য করতেন মাছ কেমন করে সাঁতার কাটে। সাঁতার কাটতে কাটতে মাঝেমধ্যে তারানকো খোলে আর বন্ধ করে। তাদের চোখের তারা কখনো বন্ধ হয় না।

বালক জগদীশ চন্দ্র বসুর আদর্শ

এরই পাশাপাশি দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি জগদীশচন্দ্রের অনুরাগ গড়ে উঠেছিল। ভগবান চন্দ্র কোন দিন চাননি যে তার পুত্র কেবল পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হোক। ভারত মহান সভ্যতার ধারক ও বাহক। ৫০০০ বছরের পুরনো এই সভ্যতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সকলেই এই সভ্যতা সম্পর্কে জানবে, একে ভালবাসবে— এটাই ছিল ভগবান চন্দ্রের ঐকান্তিক ইচ্ছে।

তাই তিনি ছোট থেকেই রামায়ণ মহাভারতের গল্প শোনাতেন জগদীশ চন্দ্র বসুকে। এইসব মহাকাব্য অবলম্বনে যে যাত্রা হতো সেখানে জগদীশচন্দ্রকে নিয়মিত নিয়ে যেতেন। বালক জগদীশচন্দ্রের কাছে রাম ছিলেন আদর্শ চরিত্র। রামের ছোট ভাই লক্ষণকে তার ভালো লাগতো।

মহাভারতের মধ্যে কোন চরিত্র কে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন জগদীশ চন্দ্র বসু। কর্ণের বীরত্ব তাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল। মাঝেমধ্যে গ্রামে যাত্রার আসর বসতো। সেখানে প্রত্যেকবার জগদীশচন্দ্র কর্ণ হয়ে অভিনয় করতেন। পরবর্তীকালে যখন তিনি বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী হিসেবে খ্যাতিমান হয়েছেন তখনও মাঝেমধ্যে কর্নের চরিত্রের সংলাপ বলতেন। কর্ণের পাঠ তিনি ঘোর বার্ধক্যেও গরগর করে মুখস্ত বলে যেতে পারতেন। এর থেকেই প্রমাণিত হয় ওই চরিত্রটি তাকে কিভাবে আকৃষ্ট করেছিল।

কর্ণের আদর্শ তিনি তার পিতার মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। দেশবাসীর কল্যাণের জন্য ভগবান চন্দ্র অকাতরে দান করে গেছেন। নিজের ভালো-মন্দ কথা চিন্তা করেননি। ভগবান চন্দ্র কে দেখে জগদীশচন্দ্রের মনে হয়েছিল সত্যি সত্যি ভগবান চন্দ্র হলেন এযুগের কর্ণ। কর্ণের পুরুষকার বীরত্ব মহত্ব এবং পরহিতকর ব্রত ভগবান চন্দ্র মনেপ্রাণে অনুসরণ করতেন।

বালক জগদীশ চন্দ্র বসুর কলকাতার জীবন

কর্মসূত্রে ভগবান চন্দ্র বর্ধমানে বদলি হয়ে যান। তখন বালক জগদীশ চন্দ্রের বয়স মাত্র ১০ বছর। ভগবান চন্দ্র ছেলেকে কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। পরে সেখান থেকে জগদীশ চন্দ্র বসুকে আনা হলো সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে। এই স্কুলে তখন সাহেবদের ছেলেরা পড়তো। পড়াশোনা হতো ইংরেজি ভাষাতে। তাই প্রথম প্রথম বাংলা ভাষায় অভ্যস্ত জগদীশচন্দ্রের খুবই অসুবিধা হতো।

কিন্তু ১০ বছরের বালক জগদীশচন্দ্রের নিজের উপর ছিল অসীম আত্মবিশ্বাস। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে তিনি ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। তখন জগদীশচন্দ্র থাকতেন একটি ছাত্রাবাসে। এই ছাত্রাবাসটি ছিল মির্জাপুরে। সেসময়কার ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলেরা এখানে থাকা পছন্দ করতেন না। ব্রাহ্ম ধর্মের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক আনন্দমোহন বসুর ছোট ভাই মোহিনী মোহন বসু জগদীশচন্দ্রের দেখাশোনার জন্য ভাড়া নিয়েছিলেন।

জগদীশচন্দ্রের উচ্চ শিক্ষালাভ

১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ বছর বয়সে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করলেন। ভর্তি হলেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে।সেখানে পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন ফাদার লাফোঁ। ফাদার লাফোঁ হাতে-কলমে পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্ব ছাত্রদের বুঝিয়ে বলতেন। তার ক্লাস করতে খুবই ভাল লাগত জগদীশচন্দ্রের। তিনি তন্ময় হয়ে ফাদার লাফোঁ ওর দিকে তাকিয়ে থাকতেন আর ভাবতেন আমি কবে উনার মত মহান বিজ্ঞানী হতে পারব।

জগদীশ চন্দ্র বসু একের পর এক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেন। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে এফ এ এবং ১৮৮০ সালে বিএ পাস করলেন। এইসব পরীক্ষাতে তিনি বিজ্ঞান বিষয়ে অসামান্য পারদর্শীতার পরিচয় রেখেছিলেন। তারই পাশাপাশি একটি প্রাচীন ভারতীয় ভাষার প্রতি ও তার অনুরাগ পরিলক্ষিত হয়। হ্যাঁ সত্যিই অবাক করার মত বিষয় সেই বিষয়টি ছিল সংস্কৃত ভাষা।

জগদীশ চন্দ্র বসুর বিলেত পাড়ি

এবার ঠিক করা হল জগদীশচন্দ্রকে বিলেতে পাঠাতে হবে। ভগবান চন্দ্রের আর্থিক সামর্থ্য তখন পড়তির দিকে। স্বাস্থ্যের কারণে তিনি দীর্ঘ দিনের জন্য ছুটি নিয়েছেন। বিলেতে পাঠাবার মতো স্বচ্ছলতা ভগবান চন্দ্রের ছিল না। জগদীশচন্দ্রের বয়স তখন মাত্র ২২ বছর। তখনই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে বাবাকে আর্থিক দিক থেকে সাহায্য করা উচিত। কি করা যায় ভাবতে ভাবতে তিনি ভাবলেন বিলেতে গিয়ে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।

ভগবান চন্দ্র নিজে ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি জানতেন পরাধীন সরকারের অধীনে চাকরি করা কত ঝামেলা। তাই তিনি পুত্রকে এই চাকরি করতে দিতে চাননি। এভাবে কাজ করতে গেলে বিবেকের সঙ্গে প্রতিমুহূর্তে লড়াই করতে হয়। বিদেশি শাসক শক্তি যা বলে তাই শুনতে হয়। একজন স্বাধীনচেতা ভারতবাসী হিসেবে এমন কাজ করতে হয় যা কখনোই করা উচিত নয়।

তখন জগদীশচন্দ্র প্রস্তাব দিলেন যে তিনি বিলেতে গিয়ে ডাক্তারি পড়বেন। এতে পিতা সম্মতি দিয়েছিলেন। কিন্তু অসুবিধা দেখা দিল আর্থিক দিক থেকে। তখনকার দিনে বিলেতে থেকে ডাক্তারি পড়ার খরচ অনেক বেশি ছিল। শেষ পর্যন্ত স্থির হল মায়ের কিছু গয়না বিক্রি করা হবে। মাও কিন্তু ছেলের বিলেতে যাওয়াতে প্রথমে মত দিতে পারেননি। তার ছোট ছেলেটি ১০ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছে। জগদীশ চন্দ্র বসু তখন মা-বাবার স্নেহ-একমাত্র সম্বল।

জগদীশচন্দ্র মায়ের আপত্তিতে খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত জগদীশচন্দ্রের বিলেত যাত্রাতে মত দেন। মায়ের অলংকার আর বিক্রি করতে হয়নি। কেননা ততদিনে ভগবান চন্দ্র সুস্থ হয়ে উঠে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন।

১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে জগদীশচন্দ্র বিলেতের পথে পাড়ি দিলেন। সমুদ্রযাত্রা তার কাছে সুখদায়ক হয়নি। বিলেত যাওয়ার আগে তিনি তার এক জমিদার বন্ধুর অনুরোধে আসামে গিয়েছিলেন বাঘ শিকার করতে। সেখানে পৌঁছানোর দ্বিতীয় দিনে জগদীশচন্দ্র মারাত্মক কালাজ্বরে আক্রান্ত হন। জ্বর এমন সাংঘাতিক হয়ে দাঁড়ালো যে সকলেসঙ্গে সঙ্গে তাকে কলকাতায় ফিরে যেতে বলল। কিন্তু আসার কোনো উপায় ছিল না। কোন গাড়ি বা পালকি পাওয়া গেল না।

শেষ অবধি এক অবাধ্য ঘোড়ায় চড়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে জগদীশচন্দ্র কলকাতায় এসে পৌছলেন।

ইংল্যান্ড যাওয়ার সময়ও তার জ্বর সম্পূর্ণ ছাড়েনি। সবাই ভেবেছিলেন সমুদ্রযাত্রা তাতে হয়তো তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। কিন্তু হল তার সম্পূর্ণ বিপরীত। জগদীশ চন্দ্র বসুর জ্বর ক্রমশই বেড়ে চলল। ডাক্তার দেখাতে গিয়ে একদিন তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন।

এই বিলেত যাত্রা সময় দুজন মহিলা তাকে সাহচর্য এবং সহানুভূতি দিয়েছিলেন। এদের কথা জগদীশ চন্দ্র বসু চিরদিন মনে রেখেছিলেন।

আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর বিলেতের লড়াই

লন্ডনে পৌঁছে তিনি মেডিকেল কলেজের প্রথম বার্ষিক শ্রেণীতে ভর্তি হলেন। জুওলজি, বোটানি এবং এ্যানাটমী নিয়ে পড়াশোনা শুরু হল। তার শরীর তখন একেবারে ভেঙে গেছে। তখনকার দিনে কালাজ্বরের কোন ওষুধ বের হয়নি। থিওরি ক্লাসের পাশাপাশি নিয়মিত প্রাকটিক্যাল ক্লাসে যেতে হতো। ল্যাবরেটরীতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে পরীক্ষা করতে হয়। শেষ অব্দি এ্যানাটমী অধ্যাপক বললেন তুমি ডাক্তারি পড়ার ধকল সহ্য করতে পারবেনা। বিদেশ বিভূঁইয়ে এসে তোমার শরীর আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। তুমি অন্য কোন বিষয়ে ভর্তি হও।

ডক্টর সিঙ্গার ছিলেন বিলেতের এক বিশিষ্ট চিকিৎসক। তিনিও নানাভাবে জগদীশচন্দ্রকে পরীক্ষা করে একই অভিমত পোষণ করলেন। হতাশে জগদীশচন্দ্র ঠিক করলেন যে তিনি লন্ডন শহর ছেড়ে দেবেন। ক্যামব্রিজে গিয়ে বিজ্ঞান পড়বেন। আনন্দমোহন বসু ছিলেন ক্যামব্রিজের প্রথম ভারতীয় রাংলার। তার সুপারিশ নিয়ে জগদীশ চন্দ্র বসু বিখ্যাত ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি হলেন। এই ঘটনাটি ঘটল হাজার ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে।

লন্ডন শহরের আবহাওয়া ছিল অত্যন্ত বিষাক্ত। সেখানে তখন জনবিস্ফোরণ ঘটে গেছে। বাতাস দূষিত হয়ে উঠেছে। তার পাশাপাশি ক্যামব্রিজ এক পরিচ্ছন্ন যুক্ত শহর। সেখানকার নির্মল প্রাকৃতিক পরিবেশে জগদীশচন্দ্র স্বস্তি পেলেন। তবে জ্বর আগের মতোই আসা-যাওয়া করতে লাগলো।

মাঝেমধ্যে তিনি নৌকা বাইতে শুরু করলেন। এতে প্রচুর পরিশ্রম হতে লাগল। খিদে বেড়ে গেল। শরীর সবল হলো। কিন্তু জ্বর একেবারে পালিয়ে গেল না। প্রথম সপ্তাহে একবার জ্বর হতে লাগলো। তারপর দুই সপ্তাহে একবার। ইংল্যান্ড প্রবাসের দ্বিতীয় বছর তিনি সম্পূর্ণ সেরে উঠেছিলেন।

মহান ব্যক্তিদের সান্নিধ্য

ক্যামব্রিজে এসে জগদীশচন্দ্র বিজ্ঞানের পাঠ নিয়েছিলেন। প্রথম বছর কারও সাথে মিশতেন না। দ্বিতীয় বছর তার ব্যক্তিত্ব বিকশিত হতে থাকলো। কলেজের অন্য ছাত্রদের সঙ্গে মেলামেশা করতে লাগলেন। কলেজের বাইরে যাতায়াত শুরু হল। যোগ দিলেন প্রকৃতিবিজ্ঞান ক্লাবে। সেখানে নিয়মিতভাবে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ পাঠ করতেন। বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনাতে তার বক্তব্য সকলে মন দিয়ে শুনতেন। এইভাবে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীর জীবন তার সম্ভাব্য পরিণতির দিকে এগিয়ে চলল।

বিজ্ঞানের কোন শাখায় পড়বেন সেটা জগদীশ চন্দ্র বসু প্রথমে ঠিক করতে পারেননি। বিজ্ঞানের সব বিষয়ে তার ভালো লাগতো। তিনি ঠিক করলেন সব অধ্যাপকের ক্লাস করবেন। পরীক্ষাগারে গিয়ে হাতে কলমে পরীক্ষা করবেন। শারীর বিদ্যার অধ্যাপক ছিলেন মাইকেল ফস্টার। ভ্রূণ বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন অধ্যাপক বালফুট। জিওলজি অর্থাৎ প্রাণিবিজ্ঞান অধ্যাপক হিউয়েস এবং তার স্ত্রী। এদের সাহচর্য পেয়ে জগদীশচন্দ্র তার জ্ঞান ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছিলেন।

ক্যামব্রিজে দ্বিতীয় বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে জগদীশচন্দ্র ঠিক করলেন যে, তিনি পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন এবং উদ্ভিদ বিজ্ঞান নিয়ে পড়বেন। পদার্থবিজ্ঞান পড়াতেন লর্ড ব্যালে, রসায়ন পড়াতেন লিভিং এবং উদ্ভিদ বিজ্ঞান পড়াতেন অধ্যাপক ভাইনস স্যার ফ্রান্সিস ডারউইন। এরা সকলেই স্ব-স্বক্ষেত্রে এক-একজন দিকপাল ছিলেন।

দ্বিতীয় বছরের শেষের দিকে আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার ব্যুত্পত্তির পরিচয় দিতে থাকেন। অধ্যাপকদের সঙ্গে তার সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিন বছর পর আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু ক্যামব্রিজ থেকে ট্রাইপোস পাস করলেন এবং একই সঙ্গে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি ডিগ্রি পেলেন।

বিলেতের পড়া শেষ হলো। এবার দেশে ফিরতে হবে।

জগদীশচন্দ্র বসুর ভারতে প্রত্যাবর্তন ও আবিষ্কার

দীর্ঘ চার বছর তিনি প্রবাসে ছিলেন। ইতিমধ্যে ভগবান চন্দ্রের আর্থিক অবস্থার তেমন একটা হেরফের ঘটেনি। জগদীশ চন্দ্র বসু চাকরি করবেন বলে ঠিক করলেন। দেশে ফিরে এসে তিনি তখনকার গভর্নর জেনারেল লর্ড রিপনের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। সেসব দিয়ে অনেক টালবাহানার পর আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। এইভাবে তার বাল্য এবং কৈশোর কাল অতিক্রান্ত হয়ে যায়।

এক নতুন জগদীশ চন্দ্র বসু জীবনের বিরাট প্রেক্ষাপটে উজ্জ্বল আলোর শেখার মতো জ্বলে উঠতে শুরু করলেন এবার। সার্থকতাও একদিন এলো। দীর্ঘ অক্লান্ত গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন তথ্যের আবিষ্কার করে বিজ্ঞানের ইতিহাসে আলোড়ন সৃষ্টি করলেন তিনি।

বিদ্যুৎ তরঙ্গ বিষয়ে তারা আবিষ্কার বিশ্বের বিজ্ঞানীদের বিস্মিত করেছিল। আধুনিক ভারতের বিজ্ঞান সাধনার প্রথম পথিকৃৎ আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু।

বেতার গবেষণার কাজেও আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু যখন ব্যস্ত ছিলেন একই সময়ে ইতালিয় বিজ্ঞানের গবেষণার বিষয় ছিল অভিন্ন।

বেতার আবিষ্কার করেছিলেন আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু। যদিও দুর্ভাগ্যবশত তার গৌরব লাভ করেছিলেন হাজার ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে ইতালীয় বিজ্ঞানী মার্কোনী।

জড়ের মধ্যেও জীবন–ভারতীয় দর্শনের এই মুল সত্যটি আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর বস্তুবাদী পরীক্ষার মাধ্যমে মূর্ত হয়ে উঠেছিল। পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বারা তিনি বেশ কিছু সাড়া জাগানো তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন। যেমন—-
নিজের তৈরি পেজোন্যান্ট যন্ত্রের সাহায্যে প্রাণী ও উদ্ভিদের দেহে বৈদ্যুতিক উত্তেজনায় সাড়া দেওয়ার বিষয়টা পরীক্ষা করে দেখান।

ফটোসিনথেটিক বাবলার ও রেকর্ডার যন্ত্রের সাহায্যে ব্যাখ্যা করলেন উদ্ভিদজগতের চিরকালীন সালোকসংশ্লেষ পদ্ধতি।

আবিষ্কার করলেন ক্রেস্কোগ্রাফ যন্ত্র। এই যন্ত্রে উদ্ভিদ দেহের সূক্ষ্মতম সঞ্চালনকে অনেক গুণ বড় দেখায়। গাছের বৃদ্ধির হারকে ১০ হাজার গুণ বাড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করা যায়। যুগান্তকারী এই আবিষ্কার তৎকালীন বিশ্বের প্রথম সারির বিজ্ঞানীদের স্বীকৃতি লাভ করে।

পোটোমিটার ও স্ফিগমোগ্রাফ যন্ত্র দিয়ে তিনি উদ্ভিদের মধ্যে প্রাণের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন

জগদীশচন্দ্র লেখা প্রথম গ্রন্থ”response in the living and nonliving” ১৯০৬ ও ১৯০৭সালে তিনি রচনা করলেন “উদ্ভিদের সাড়া” এবং “তুলনামূলক বৈদ্যুতিক শরীরবৃত্ত” নামে দুটি গ্রন্থ।

মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চা অন্যতম পথপরিদর্শক ছিলেন জগদীশ চন্দ্র বসু। বাংলায় রচিত তার নানা বিষয়ের বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ করে সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ রূপে স্বীকৃত। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ২৩ শে নভেম্বর সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর জীবন অবসান হয়।

image source i.pinimg

2 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here