চাণক্য নীতি কথা
চাণক্য পন্ডিত ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক অনন্য অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। চাণক্য নীতি বা বানীর জন্য তিনি আমাদের কাছে অবিস্মরণীয়। খ্রিস্টপূর্ব 370 থেকে 283 অব্দ পর্যন্ত ছিল তার জীবনকাল। একাধারে তিনি ছিলেন দার্শনিক, পন্ডিত, রাজনীতিবিদ ও কূটনীতিবিদ। এত বছর পুরনো কালেও চানক্য তার চানক্য নীতি কথা বানীর মধ্যে দিয়ে যে ভূমিকা আমাদের সমাজের জন্য রেখে গেছেন তা আজও আমাদের কাছে অনবদ্য। চাণক্যের আরেক নাম ছিল কৌটিল্য । কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ভারতবর্ষে এখনো পর্যন্ত অদ্বিতীয় একটি গ্রন্থ।চাণক্যের বাণী আজও আমাদের সামাজিক, মানসিক, রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয় জীবন সবদিক থেকেই আমাদের কে সুন্দর এবং সুপরিকল্পিত ভাবে বাঁচতে সাহায্য করে। নিচে চাণক্য নীতি র কিছু মূল্যবান বাণী উল্লেখ করা হলো।
ঋনকর্তা পিতা শত্রুর্মাতা চঃ ব্যভিচারিণী।
বার্তা রূপবতী শত্রুঃ সুত্রঃ শত্রুরপন্ডিতঃ।।
অনুবাদ: পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে চাণক্য নীতি র মধ্যে একটি অন্যতম শ্লোক ঋণগ্রহণকারী পিতা, অসতী মাতা, অধিক সুন্দরী স্ত্রী এবং অজ্ঞ পুত্র পারিবারিক জীবনের শত্রু।
সন্তানকে সুশিক্ষিত করার জন্য চাণক্য নীতি
প্রত্যেক পিতা-মাতার কাছে অমূল্য ধন তার সন্তান। সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা প্রত্যেক মা-বাবারই দায়িত্ব এবং কর্তব্য। সন্তানের প্রতি কখনো কঠোরতা, কখনো স্নেহশীল কখনো বা বন্ধুর মতো ব্যবহার করতে হয়। চাণক্য নিতি কথার মধ্য দিয়ে তা আমাদের কাছে স্পষ্ট ইঙ্গিত রেখে গেছেন। এবং চাণক্য নীতি দ্বারা আমরা আমাদের সন্তানকে সমাজের গুণী ব্যক্তি হিসেবে তৈরি করতে পারি।
লালয়েৎ পঞ্চবর্ষাণি দশবর্ষাণি তাড়য়েৎ।
প্রাপ্তে তু ষোড়শবর্ষে পুত্রং মিত্রবদাচরেৎ।।
অনুবাদ: সুশিক্ষিত সন্তান তৈরীর জন্য চাণক্য নীতি তে বলা হয়েছে– প্রথম পাঁচ বছর পুত্রকে স্নেহ দিয়ে লালন করবে। পরবর্তী ১০ বছর তাকে কঠোর ভাবে শাসন করবে। ১৬ বছর বয়সে তার সাথে বন্ধুর মতো আচরণ করবে।
লালনে বহবো দোষাস্তাড়নে বসবো গুণাঃ।
তস্মাৎ পুত্রং চ শিষ্যং চ তাড়য়েন্ন তু লালয়েৎ।।
অনুবাদ: অতিরিক্ত স্নেহ করার ফলে সন্তানের অনেক দোষ জন্মায়, কিন্তু কঠোরতায় সুন্দর চরিত্র গড়ে ওঠে। তাই সন্তানের প্রতি কোমল নয়, কঠোর হন।
একোহপি গুণবান পুত্র নির্গুণেন শ্যেন কিম্।
এক চন্দ্রো তমোঃন্তিন চঃ তারা সহস্রাঃ।।
বাংলায় চানক্য নীতি আনুবাদ: সদগুণ সম্পন্ন একজন পুত্র অযোগ্য শত শত পুত্রের চেয়েও শ্রেয়। যেমন একটি চাঁদই রাতের অন্ধকার দূর করে, অথচ হাজার হাজার তারকা তা করতে পারে না।
কিম তয় ক্রিয়তে ধেন্বাঃ যা ন দোগ্ব্রী ন গর্ভিণী।
কো হৃতঃ পুত্রেন যতেন য ন বিদ্বান না ভক্তিমান।।
অনুবাদ: যে গাভী গর্ভধারণ ও দুগ্ধ দান করতে পারে না, তার কি প্রয়োজন? যে পুত্র বিদ্বান বা ভগবদ্ভক্ত কোনোটিই নয়, তারই বা কি প্রয়োজন?
পুত্রাংশ্চ শিষ্যাংশ্চঃ।।
অনুবাদ: পিতার (গুরুর) সম্পত্তির উপর পুত্র ও শিষ্য উভয়েরই সমান অধিকার রয়েছে।
একেনাপি সুবৃক্ষেণ পুস্পিতেন সুগন্ধিনা।
বাস্যতে তদ্বনং সর্বং সুপুত্রেণ কুলিং যথা।।
চানক্য নিতিকথার অনুবাদ: একটি উৎকৃষ্ট বৃক্ষের পুষ্প যেমন এর সুভাস দ্বারা সমগ্র বনকে সুবাসিত করে, তেমনি একজন সুপুত্র সমস্ত পরিবারের সম্মান বৃদ্ধি করে।
একেনাপি কু-বৃক্ষেণ দাহ্যমানেন বহ্নিনা।
দাহ্যতে তদ্বনং সর্বং কু-পুত্রেন কুলম্ যথা।।
অনুবাদ: একটিমাত্র বৃক্ষে লাগা আগুনের দ্বারা যেমন সম্পূর্ণ বন ভস্মে পরিণত হতে পারে তেমনি একজন কুপুত্রের দ্বারাও সম্পূর্ণ পরিবার ধ্বংস হতে পারে।
শত্রু সম্বন্ধে চাণক্য নীতিকথা
মানবজীবনে যতজন মিত্র আছে তার থেকে কয়েক গুণ বেশি শত্রুর সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়। চাণক্য পন্ডিত এটি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন কয়েক হাজার বছর আগেই। তাই চাণক্য নীতি কথা তে তিনি শত্রুর প্রতি আমাদের কি ব্যবহার হওয়া উচিত তা বর্ণনা করেছেন
দুর্জন পরিহর্তব্যো বিদ্যয়ালঙ্কৃতোহপি সন্।
মণিনা ভূষিতঃ সর্পঃ কিমসৌ ন ভয়ঙ্করঃ।।
চাণক্য নীতিকথার অনুবাদ: দুর্জন বিদ্বান হলেও যেকোনো মূল্যে তাকে এড়িয়ে চলা কর্তব্য। মনিভূষিত বিষাক্ত সর্প কি অধিক ভয়ঙ্কর নয়?
ঋণ শেষঃ অগ্নিশেষশ্চ ব্যাধিশেষ তথৈব চ।
পুনশ্চ বর্ধতে যস্মাৎ তস্মাৎ শেষম্ চ কার্যেত।।
অনুবাদ: অগ্নি, শত্রু এবং রোগব্যাধি সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা উচিত, অন্যথায় তা বাড়তেই থাকবে।
নখিনং চ নদীনাং চ শৃঙ্গিনাং শস্ত্রপাণিনং।
বিশ্বাসঃ নৈব কর্তব্যঃ স্ত্রীষু রাজকুলেষু চ।।
অনুবাদ: নখযুক্ত প্রাণী, নদী, শিংওয়ালা জন্তু, অস্ত্রধারী ব্যক্তি, নারী অথবা রাজনীতিবিদকে কখনোই বিশ্বাস করতে নেই।
সর্পঃ ক্রূরঃ খলঃ ক্রূরঃ সর্পাৎ ক্রূরতরঃ খলঃ।
মনন্ত্রৌষধিবশঃ সর্পঃ খলঃ কেন নিবার্যতে।।
চাণক্য নীতি অনুবাদ: দু’ধরনের হিংসুক প্রাণী আছে; যথা: সাপ এবং সাপের ন্যায় ক্রূর স্বভাববিশিষ্ট মানুষ। এই দুইয়ের মধ্যে সাপের মত ক্রূর স্বভাববিশিষ্ট মানুষ অধিক ভয়ানক। কারণ মন্ত্রের দ্বারা সাপকে নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও ক্রূর স্বভাবের মানুষকে বশীভূত করা যায় না।
দাক্ষিণ্যং স্বজনে দয়া পরজনে শাঠ্যং সদা দুর্জ্জনে। প্রীতি সাধুজনে স্ময়ঃ খলজনে বিদ্বজনে চার্জ্জবম্।
শৌর্য্যং শত্রুজনে ক্ষমা গুরুজনে নারীজনে ধূর্ত্ততা। ইত্থং যে পুরুষা কলাসু কুশলাস্তেস্বেব লোকস্থিতি।।
চাণক্য নীতি কথা অনুবাদ: সকলের সাথে সম ব্যবহার করা চলে না, শট এর সাথে শাঠ্যতা, খড়ের সাথে অহংকারে মনোভাব, নারীর সাথে ছলনা, সাধু জনের সাথে সম্প্রীতি, বিদ্বান এর সাথে সারল্য, শত্রুর সাথে বীরত্ব, আপনজনকে দাক্ষিণ্য গুরুজনকে ক্ষমা এবং পরজনকে দয়া করা কাম্য। এরূপ ব্যবহারে মানুষ সংসারে উন্নতি করতে পারে।
তক্ষকস্য বিষং দন্তে মক্ষিকায়া মুখে বিষম্।
বৃশ্চিকস্য বিষং পুচ্ছে সর্ব্বাঙ্গে দুর্জ্জনে বিষম্।।
অনুবাদ: চাণক্য নীতি শাস্ত্র এর মধ্যে অন্যতম একটি বাণী -সর্পের দন্তে যেমন বিষ থাকে, মাছির মুখে বিষ থাকে, বৃশ্চিকের বিষ থাকে তার লেজে কিন্তু দুষ্টু লোকের সারা দেহে বিষ থাকে, তাই সে বিষধর। সেজন্য সর্বদা দুষ্টু ব্যক্তির সঙ্গ ত্যাগ করা উচিত।
দুষ্টা ভার্যা শঠং মিত্রং ভৃত্যশ্চোত্তরদায়কঃ।
স-সর্পে চ গৃহে বাসো মৃত্যুরেব ন সংশয়ঃ।।
অনুবাদ: যার স্ত্রী অসতী, বন্ধু প্রতারক এবং ভৃত্য অবাধ্য , গৃহে তার সাপের বাস, অতএব মৃত্যু তার অনিবার্য।
কৃত প্রতিকৃতিম্ কুরাত হিংসিতে প্রতিহিংসিতে।
তত্র দোষম্ ন পশ্যামি তো দুষ্টে দুষ্টম আচরেত।।
অনুবাদ:দয়ার জবাব দয়ায়, আক্রমণের জবাব প্রতিআক্রমণের দ্বারা দিলে তাতে কোন দোষ থাকে না। প্রতারকের সাথে ব্যবহারে প্রতারণার আশ্রয় অবশ্যই নিতে হবে।
তুষ্যন্তি ভোজনে বিপ্রাঃ ময়ূরা ঘনগর্জ্জিতে।
সাধবঃ পরসম্পত্বো খলাঃ পরিবিপত্তিষু।।
অনুবাদ: ব্রাহ্মন ভোজনের দ্বারা তুষ্ট হয়, ময়ূর মেঘ গর্জনে আনন্দে নিত্য করে। সজ্জন ব্যক্তি পরের সুখে সুখী হয়। কিন্তু দুষ্টু বা অসৎ ব্যক্তি পরের দুঃখে ও বিপদে আনন্দ লাভ করে।
অরি- প্রযত্নাম্ অভিসমীক্ষতে।।
অনুবাদ: শত্রুর প্রতি কোমলতা প্রদর্শন করবেন না। তাকে সর্বদা বিপজ্জনক মনে করুন।
পয়ঃপানং ভুজঙ্গানাং কেবলং বিষবর্ধনম্।
উপদেশো হি মুর্খানাং প্রকোপায় ন শান্তয়ে।।
অনুবাদ: দুধ পান করার ফলে সাপের শুধু বিষই বৃদ্ধি পায়। তেমনই মূর্খকে সদুপদেশ দান করলে তারা ক্রুদ্ধ হয়। মানসিক প্রশান্তি লাভ করতে পারে না।
ন কশ্চিৎ কস্যচিন মিত্রম্ ন কশ্চিৎ কস্যচিদ্ রিপুঃ।
কর্ণেন হি জানাতিং মিত্রানি চ রিপুম্ তথাঃ।।
অনুবাদ: স্বভাবত কেউই আমাদের বন্ধু বা শত্রু নয়। একমাত্র কাজের দ্বারাই মানুষ আমাদের বন্ধু বা শত্রু বলে পরিগণিত হয়।
চরিত্র গঠনে চাণক্যের নীতি বাণী
আমাদের চরিত্রকে মসৃণ রাখতে চাণক্য নীতি অনুসরণ করা আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত।মানুষ সারা জীবন ধরে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে চাণক্য নীতি থেকে তা আমরা আগে থেকেই জানতে পারি।
ধনানী জীবিতং চৈব পরার্থে প্রাজ্ঞ উৎসৃজেত।
সৎ নিমিত্তাম বরং ত্যাগ বিনাশে নিয়তে সত্যি।।
অনুবাদ: কারও অধিকারে যা আছে তার সবই বরং সৎ উদ্দেশ্যে অর্থাৎ পরমেশ্বর ভগবানের উদ্দেশ্যে ব্যয় করা উচিত, কারণ মৃত্যুকালে কেউ তার সম্পদ সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে না।
মাতা যস্য গৃহে নাস্তি ভার্যা চাপ্রিয়বাদিনী।
অরন্যং যেন গন্তব্যং যথারণ্য তথাগৃহদ্।।
অনুবাদ: যে ব্যক্তির গৃহে স্নেহময়ী মা অথবা সুশীলা স্ত্রী কোনটাই নেই, তার উচিত তৎক্ষণাৎ সেই শূন্য গৃহ পরিত্যাগ করে বনে গমন করা। এমন ব্যক্তির কাছে বনবাস গৃহে বাস করার চেয়ে কিছুমাত্র খারাপ নয়।
ত্যজ দুর্জন সংসর্গং ভজ সাধুসমাগম্।
কুরু পুণ্যমহোরাত্রং স্মর নিত্যং অনিত্যতাম্।।
অনুবাদ: দুর্জনের সঙ্গ ত্যাগ করো। সাধুসঙ্গে ভজন করো। দিন-রাত শুধু পুণ্যকর্ম করো এবং সর্বদায এ জগতের অনিত্যতা স্মরণ রেখো
বিদ্যত্বম্ চ নৃপত্যম্ চ নৈব তুল্যম্ কদাচন।
স্বদেশে পূজ্যতে রাজা বিদ্বান সর্বত্র পুজ্যতে।।
অনুবাদ: বিদ্যা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার মধ্যে কোন তুলনা চলে না। রাজা শুধু তার নিজ রাজ্যে সম্মানিত হন কিন্তু বিদ্বান ব্যক্তি সর্বত্র সম্মানিত হন।
আয়ুষঃ ক্ষণ একোহপি ন লভ্যঃ স্বর্ণকোটিভিঃ।
স চেন্নিরর্থকং নীতঃ কা নু হানিস্ততোহধিকা।।
অনুবাদ :জীবনের একটি মাত্র মুহূর্ত যদি বৃথা ব্যয় হয়, তবে কোটি কোটি স্বর্ণ মুদ্রার বিনিময়েও তার ফিরে পাওয়া যায় না। সুতরাং বৃথা সময় নষ্ট করার চেয়ে বেশি ক্ষতি আর কি হতে পারে।।
উদ্যমের হি সিদ্ধান্তটি কার্যাদি না মনোরথৈঃ।
ন হি সুপ্তস্য সিংহস্য প্রবিশ্যন্তি মুখে মৃগঃ।।
অনুবাদ: শুধু ইচ্ছা করার মাধ্যমে কার্যসিদ্ধি হয় না, হয় প্রচেষ্টার মাধ্যমে। আহার হিসেবে কোন ঘুমন্ত সিংহের মুখে বনের প্রাণীরা আপনা-আপনিই প্রবেশ করে না।
বিষাদপ্যমৃতং গ্রাহং অমেধ্যাদপি কাঞ্চনম্।
নীচাদপ্যুত্তম্ জ্ঞানং স্ত্রীরত্নং দুষ্কুলাদপি।।
অনুবাদ: বিষের পাত্র থেকে অমৃত, অপবিত্র স্থান থেকে স্বর্ণ, সবচেয়ে নিচু ব্যক্তির কাছ থেকেও জ্ঞান এবং নীচু বংশের পরিবার থেকেও গুণবতী পত্নী গ্রহণ করা উচিত।
মূর্খাঃ যত্র না পূজ্যন্তে ধান্যং যত্র সুসঞ্চিতম্।
দম্পত্যোঃ কলহো নাস্তি তত্র শ্রীঃ স্বয়মাগতাঃ।।
অনুবাদ: সৌভাগ্যের অধিষ্ঠাত্রী লক্ষীদেবী সেখানেই বাস করেন, যেখানে দুষ্টু ব্যক্তিরা পূজিত হয় না, ধান্যাদি শস্য প্রচুর পরিমাণে সঞ্চিত থাকে এবং দাম্পত্য কলহো নেই।
মাতৃবৎ পরদারেষু পরদ্রব্যেষু লোষ্ট্রবৎ।
আত্মবৎ সর্বভূতেষু যঃ প্রতি স পন্ডিতঃ।।
অনুবাদ: যিনি পরস্ত্রীকে মায়ের মতো, পরের দ্রব্যকে মাটির ঢেলার মতো এবং সমস্ত জীবকে নিজের মতো দর্শন করেন, তিনিই প্রকৃত পন্ডিত।
নাত্যন্তং সরলৈভাব্যং গত্বপশ্যম্ বনস্হলীম্।
ছিদ্যন্তে সরলাস্তত্র কুব্জাস্তিষ্টন্তি পাদপাঃ।।
অনুবাদ: সংসারে সরল লোকদের উপর সকলে আঘাত হানে, কিন্তু বাঁকা চোরা লোকদের ওপর সহজে কেউ আঘাত হানতে চায় না। বনভূমির সোজা ও সরল বৃক্ষ গুলো কাটা হয়ে থাকে, বাঁকা বাঁকা গাছগুলো সহজে কেউ কাটে না। সারল্য ভালো তবে অতি সরলতা ক্ষতিকারক।
সুখার্থী চেৎ ত্যজেৎ বিদ্যাং বিদ্যার্থী চেৎ ত্যজেৎ সুখং।
সুখার্থীনঃ কুতো বিদ্যা কুয়ো বিদ্যার্থীনঃ সুখং।।
অনুবাদ: যদি পারমার্থিক উন্নতি চান, তবে আপনার ভাবা উচিত, মৃত্যু আপনার সন্নিকটে কিন্তু যদি জড়- জাগতিকভাবে সুখী হতে চান, তবে আপনার ভাবা উচিত, আপনি কখনোই মৃত্যুবরণ করবেন না।
গুণৈঃ উত্তমতাম্ যাতি নোর্চ্চৈ আসন সংস্থিতাঃ।
প্রাসাদ শিখরস্থোহপি কাকঃ কিম্ গরুড়ায়তে।।
অনুবাদ: মহৎ গুণের দ্বারাই কেউ মহৎ হয়, কেবল উচ্চপদ অধিকার করে নয়। কাক রাজপ্রাসাদের ছাদের উপর বসতে পারে, তাই বলে সে গরুড় হয়ে যায় না।
শ্বানপুচ্ছমিব ব্যর্থ জীবিতং বিদ্যয়া বিনা।
ন গুহ্যং গোপনে শক্তং ন চ বংশ নিবারণে।।
অনুবাদ: এটি চাণক্য নীতি গুলির মধ্যে অন্যতম একটি শ্লোক- বিদ্যাহীন মূর্খ ব্যক্তির জীবন কুকুরের লেজের মতো অচলমান। কারণ কুকুরের লেজ এমন যে সে তার গুপ্ত অঙ্গকেও ঢাকা রাখতে পারে না। সে মশা-মাছি গায়ে বসলে তাকে তাড়াতে পারে না। তেমন মূর্খ বা বিদ্যাহীন মানুষ নিজের খারাপ স্বভাবকে পরিবর্তন করতে বা নিজেকে রক্ষা করতে সমর্থ হয় না।
নির্গুণেষু অপি সত্ত্বেষু দয়াম কুর্বন্তি সাধবঃ।
ন হি সংহরন্তে জ্যোৎস্নাম্ চন্দ্রশ্চণ্ডাল-বেশ্যানি।।
অনুবাদ: সাধুগণ সকল জীবকে তাদের কৃপা প্রদান করেন, এমনকি যাদের সদগুণ নেই তাদেরও, ঠিক যেমন সমাজচ্যুত ব্যক্তির গৃহে আলো বিতরণ করতে চাঁদ বিরত হয় না।
নক্ষত্র ভূষণম্ চন্দ্রঃ নারীনাম্ ভূষণম্ পতি।
পৃথিবী ভুষণম্ রাজাঃ বিদ্যা সর্বস্য ভূষণম্।।
অনুবাদ: চাঁদ নক্ষত্ররাজির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে, সুশাসক পৃথিবীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে এবং পতি পত্নীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। কিন্তু বিদ্যা সবার এবং সমস্ত জিনিসের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।
একোদর সমুদ্ভূতা এক নক্ষত্র জাতকাঃ।
ন ভবন্তি সমাশীলে যথা বদরিকন্ঠকাঃ।।
অনুবাদ: একই মাতৃগর্ভে জন্মলাভ করে এবং এক হই নক্ষত্র যোগে জাত হয়েও সকলের হৃদয়বৃত্তি সমান হয় না। সমান পরিবেশে জন্মগ্রহণ করে সমান গুণী হওয়ার নিশ্চয়তা নেই। এই বৃক্ষে ফুল ও কাটা বিদ্যমান, কিন্তু সেই ফুল কাঁটার পার্থক্য অনেক।
কর্ম্মায়ত্ত ফলং পুংসা বৃদ্ধি কর্ম্মানুসারিণী।
তথাপি সুধীশ্চার্য্যাঃ সুবিচার্য্যেব কুর্ব্বতে।।
অনুবাদ: কর্মানুযায়ী বুদ্ধিপ্রাপ্ত হয় এবং তদনুসারে ফললাভ হয়ে থাকে। কুকর্মের ফলে কুবুদ্ধি লাভ ও সেরূপ কুফল হয়ে থাকে। সে কারণে জ্ঞানীগণ চিন্তাভাবনা করে কাজে লিপ্ত হন।
দাম্পত্যে কলহে চৈব বহুবারম্ভে লঘু-ক্রিয়া।
অজাযুদ্ধে মুনি- শ্রাদ্ধে প্রভাতে মেঘদম্ভকে।।
অনুবাদ: চাণক্য নীতি দাম্পত্য জীবনে সুখ এনে দেয়, যদি আমরা চাণক্য নীতি কথা অনুসরন করি। স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হয় কিন্তু দ্রুতই তারা তা ভুলে যায়। খুব হালকাভাবেই এদের গ্রহণ করা উচিত। ঠিক ছাগলের সাথে ছাগলের যুদ্ধের মতো, বনবাসী সাধুর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান কিংবা সূর্যোদয় মেঘের গর্জনের মতো।
অপুত্রস্য গৃহং শূন্যং দিশা শূন্যং তু অবান্ধবঃ।
মূর্খস্য হৃদয়ং শূন্যং সর্বশূন্যা দরিদ্রতঃ।।
অনুবাদ: সন্তানহীন গৃহ শূন্য, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়বর্গ ছাড়া ব্যক্তির দশদিক শূন্য, মূর্খ ব্যক্তির হৃদয় শূন্য, আর এসব শূন্যতার সম্মিলিত রূপই হলো দরিদ্রতা।
দূরতঃ শোভতে মূর্খো লম্ব- শাট- পটাবৃতঃ।
তাবৎ চ শোভতে মূর্খ যাবৎ কিঞ্চিন্ন ভাষতে।।
অনুবাদ: দূর থেকে কোনো সুন্দর লম্বমান পোশাক পরিহিত মূর্খ ব্যক্তিকে ততক্ষনই ভালো দেখায়, যতক্ষণ সে কথা না বলে।
উদ্যমের হি সিদ্ধান্তটি কার্যাদি না মনোরথৈঃ।
ন হি সুপ্তস্য সিংহস্য প্রবিশ্যন্তি মুখে মৃগঃ।।
অনুবাদ: শুধু ইচ্ছা করার মাধ্যমে কার্যসিদ্ধি হয় না, হয় প্রচেষ্টার মাধ্যমে। আহার হিসেবে কোন ঘুমন্ত সিংহের মুখে বনের প্রাণীরা আপনা-আপনিই প্রবেশ করে না।
হেলা হি কার্যনাশায় বুদ্ধিনাশায় হীনতা।
যাচঞা স্যাদ্ মাননাশায় সর্বনাশায় কুক্রিয়া।।
অনুবাদ: আলস্যের ফলে কার্য পন্ড হয়, দারিদ্র্য বুদ্ধি বিভ্রম ঘটায়,যাচঞার ফলে সম্মান নষ্ট হয়, কিন্তু কুকার্যের ফলে সবকিছু নষ্ট হয়।
অহো বৎ বিচিত্রাণি চরিত্রাণি মহাত্মণং।
লক্ষীং তৃণ্যা মন্যন্তে তৎ ভারেণ নমন্তি চ।।
অনুবাদ: মহৎ ব্যক্তিদের আচরণ কী বিস্ময়কর। ধন-সম্পদকে তারা তেমন গ্রাহ্যই করেন না, কিন্তু একে তারা দায়ভার হিসেবে গ্রহণ করেন।
শরীরস্য গুণানাং চ দূরম্ অত্যন্তং অনন্তরম্।
শরীরং ক্ষণবিধ্বংসী কল্পান্তস্হায়ীনো গুণাঃ।।
অনুবাদ: ব্যক্তির জড় দেহ ও সদ্গুণের মধ্যে পার্থক্য বিস্তর, দেহটি চোখের পলকেই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, কিন্তু খ্যাতি বা সুনাম চিরকাল থাকে।
কাম ক্রোধ তথা লোভং স্বাদ শৃঙ্গার কৌতুকে।
অতি নিদ্রাহতি সেবে চ বিদ্যার্থী হৃষ্ট বর্জ্জয়েৎ।।
অনুবাদ: কাম, ক্রোধ, লোভ, স্বাদযুক্ত আহার্য দ্রব্য ভোজনের ইচ্ছে, সেজেগুজে থাকার ইচ্ছে, কৌতুক, অতিসেবা,অতিনিদ্রা-বিদ্যার্থীগণের ত্যাগ করা বিধেয়, কারণ এই অষ্ট প্রকার প্রবণতা বিদ্যার্জনে বিশেষ বাধাস্বরূপ।
ধনিকঃ শ্রোত্রিয়ো রাজা নদী বৈদ্যস্তু পঞ্চমঃ।
পঞ্চযত্র না বিদ্যন্তে না তত্র দিবসং বসেৎ।।
অনুবাদ:যে স্থানে মহাজন, বিদ্বান, ব্রাহ্মণ, রাজা, নদী ও চিকিৎসক নেই, সে স্থানে একদিন ও অবস্থান করতে নেই।
দরিদ্র দোষো গুণ- রাশি- নাশি।
অনুবাদ: অনেক ভালো গুণ থাকলেও দারিদ্র্য সমস্ত গুণই নষ্ট করে দেয়।
ক্ষম-রূপং তপস্বীনম্।।
অনুবাদ: তপস্বীর তপস্যার শক্তি নিহিত তার ক্ষমা করার সামর্থ্যের মধ্যে।
ধনানী জীবিতং চৈব পদার্থে প্রাজ্ঞ উৎশ্রেয়ত।
সৎ নিমিত্তাম্ বরং ত্যাগ বিনাশে নিহ্যতে পতি।।
অনুবাদ: কারও অধিকারে যা আছে তার সবই বরং সৎ উদ্দেশ্যে অর্থাৎ পরমেশ্বর ভগবানের উদ্দেশ্যে ব্যয় করা উচিত, কারণ মৃত্যুকালে কেউ তার সম্পদ সাথে নিয়ে যেতে পারে না।
অর্নি আখ্যাবত।
অনুবাদ: যিনি গৃহত্যাগ করেন না এবং অঋণী, তিনিই সুখী।
আদৌ- মাতা গুরুঃ পত্নী ব্রাহ্মণী রাজ-পত্নীকা।
ধেনুর্ধাত্রী তথা পৃথ্বী সপ্তেতা মাতর স্মৃতা।।
অনুবাদ: গর্ভধারিনী মা, গুরুপত্নী, ব্রাহ্মণ, রাজপত্নী (রানী), গাভী, সেবিকা এবং পৃথিবী- এ সাতজন আমাদের মাতা বলে অভিহিত।
রূপ যৌবন সম্পন্ন বিশাল কুল-সম্ভবা।
বিদ্যা হীনা ন শোভন্তে নির্গন্ধ এবং কিংসুকা।।
অনুবাদ: রুপ-যৌবন সম্পন্ন উচ্চকুলোদ্ভূত ব্যক্তিও যদি জ্ঞানহীন হয়, তাকে উৎকৃষ্ট বলে মনে করা হয় না, ঠিক যেমন গন্ধহীন হওয়ায় কিংশুকা বৃক্ষের সুন্দর ফুলকে উৎকৃষ্ট বলে মনে করা হয় না।
ত্যজেধর্ম্ম দয়াহীনং বিদ্যা হীনং গুরু ত্যজেৎ।
ত্যজেৎক্রোধমুখী ভার্যান্নিঃ স্নেহাবান্ধবত্যজেৎ।।
অনুবাদ: চাণক্য নীতি অনুসারে বিদ্যাহীন গুরু, দয়াহীন ধর্ম, স্নেহহীন বন্ধু আর ক্রোধযুক্তা স্ত্রী পরিত্যাগ করা উচিত। কারণ বিদ্যাহীন গুরু শিষ্যকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারে না। প্রীতিহীন বন্ধুও কোনো উপকারে লাগে না। যে ধর্ম মানুষকে ধারণ করেন সেই ধর্ম যদি দয়াহীন হয়, সেই ধর্ম কোন কাজে লাগে না। প্রচন্ড ক্রোধযুক্ত স্ত্রী সংসারে অমঙ্গল ঘটায় তার ফলে সংসারে অশান্তি ঘটে।
কঃ কালঃ কানি মিত্রানি কো দেশঃ কৌ ব্যয়াগমৌ।
কস্যাহং কা চ মে শক্তিরিতি চিন্ত্যং মুহূর্মুহূ।।
অনুবাদ: কোন কাজ করার পূর্বে ভেবেচিন্তে করতে হবে। কাজ সম্পন্ন করার পর আর ভেবেচিন্তে লাভ নেই। কাজ করার পূর্বে ভাবতে হয় যে- কোন দেশ, কোন সময়, কে বা বন্ধু কিবা আয় কিবা ব্যয়- নিজেরই বা শক্তি কত?
মূর্খ শিষ্যোপদেশেন দুষ্টা স্ত্রী ভরনেন চ।
দুঃখিতে সংপ্রয়োগেন পন্ডিতোহপ্যসীদতে।।
চাণক্য নীতি অনুবাদ: মূর্খ শিষ্যকে উপদেশ দান করে কোন ফল হয় না। মূর্খ উপদেশের মর্ম উপলব্ধি করতে পারে না। দুষ্ট স্ত্রীর ভরণ পোষণ করা দুঃখের কারণ।
যে ধ্রুবানি পরিত্যাজ্য অধ্রুবং পরিসেবতে।
ধ্রুবানি তস্য নশ্যন্তি অধ্রুবং নষ্টমেব হি।।
অনুবাদ: যিনি নিশ্চিত বস্তু পরিত্যাগ করে অনিশ্চিতের পথে গমন করেন, তিনি নিশ্চিত অনিশ্চিত উভয় হারিয়ে ফেলেন।
যস্য নাস্তি স্বয়ং প্রজ্ঞা শাস্ত্রং তস্য করোতি কিম্।
লোচনাভ্যাং বিহীনস্য দর্পণং কিং করিষ্যতি।।
অনুবাদ: সাধারন বুদ্ধি না থাকলে- শাস্ত্র বেটে খাওয়ালেও কোনো লাভ নেই। দর্পণ অন্ধের কোন কাজে লাগবে?
একবৃক্ষা সমারূঢ়া নানা জাতি বিহঙ্গমাঃ।
প্রভাতে দশ দিশে যান্তি কা কস্য পরিবেদনা।।
চাণক্য নীতি কথা বানী অনুবাদ: রাতের বেলা একটা বৃক্ষে নানাজাতির পক্ষীকুল বাস করে আর তখন অনেক সম্বন্ধ স্থাপিত হয়। আবার সকাল হলে তারা যে কোথায় উড়ে চলে যায় আর দেখা যায় না। এটা চির সত্য; মানুষও তেমনি কয়েকদিনের জন্য সংসারে আসে, নানান পরিচয় আবদ্ধ হয় আবার শেষের দিনে কে কোথায় চলে যায় কারো সাথে আর সম্পর্ক থাকে না। তার জন্য শোক করা অকারণ।
বুদ্ধির্যস্য বলং তস্য নির্বুর্দ্ধেস্ত্ত কুয়ো বলম্।
বনে সিংহো মদোন্মত্তো জম্বুকেন নিপাতিতঃ।।
অনুবাদ: বুদ্ধিই শ্রেষ্ঠ বল, মূর্খ শারীরিক দিক থেকে শক্তিশালী হলেও তার দৈহিক বলের দ্বারা কার্যসিদ্ধি হয়। বুদ্ধিমান ব্যক্তি শারীরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী না হলেও অসাধ্য সাধন করতে পারে। যেমন শিয়ালের চালাকিতে মদগর্বিত সিংহের প্রাণ যায়।
শৈলে শৈলে না মাণিক্যং মৌক্তিকং না গজে গজে।
সাজবো না হি সর্ব্বত্র চন্দনং না বনে বনে।।
অনুবাদ: চাণক্য নীতি মতে সকল বনে চন্দন কাঠ পাওয়া যায় না, প্রত্যেক গজমতি থাকে না, প্রত্যেক পর্বতেই মানিক্য থাকে না, ঠিক তদনুরূপ প্রত্যেকের স্থানে সাধু ব্যক্তি অবস্থান করে না।
উপসর্গেহন্যচক্রে চ দুর্ভিক্ষে চ ভয়াবহে।
অসাধু জনসংসর্গে যঃ পলায়তি সঃ জীবতি।।
চাণক্য নীতি অনুবাদ: মহাদুর্ভিক্ষ,মহা উপদ্রব শুরু হলে অথবা শত্রু কর্তৃক ঘোরতরভাবে আক্রান্ত হলে- পলায়নই একমাত্র পথ। এ সকল ক্ষেত্রে পলায়ন করার ফলে প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হয়ে থাকে। এরূপ দুষ্টজনের স্বর্গ থেকে পালিয়ে যাওয়া উচিত, নতুবা প্রাণহানিকর বিপদ উপস্থিত হতে পারে।
দুর্ব্বলস্য বলং রাজা বালানাং রোদনং বলম্।
বলং মূর্খস্য মৌনিত্বং চৌরানামনৃতং বলম্।।
চাণক্য নীতি কথা অনুবাদ: দুর্বলের নিজ বল না থাকায় রাজা বা আইনের বলে রাষ্ট্রে নিতে হয়। মূর্খের বল নীরবতা কারণ কথা বললে তার বিদ্যার জাহির হয়ে পড়ে। শিশুর অন্য কোনো বল নেই, ক্রন্দনই তার একমাত্র বল। আর মিথ্যার আশ্রয় করে চুল ও অসাধু ব্যক্তি নিজেকে রক্ষা করে থাকে। সুতরাং তাদের একমাত্র বল।
ধনধান্য প্রয়োগেষু বিদ্যা সংগ্রহেণেষু চ।
আহারে ব্যবহারে চ ত্যক্ত লজ্জঃ সুখী ভবেৎ।।
অনুবাদ: ধনধান্য ও বিদ্যা লাভের ব্যাপারে লজ্জা থাকা কোনমতে উচিত হবে না। আহার ও ব্যবহারে লজ্জা করলে কষ্ট পেতে হয়। তাই সেরূপ লজ্জা অর্থহীন। যারা এ সকল ব্যাপারে লজ্জা করে না তারাই সুখ লাভ করে।
পরমস্ত্ত গুণো যস্ত্ত নির্গুণহপি গুতো ভবেৎ।
ইন্দ্রোহপি লঘুতাং যাতি স্বয়ং প্রখ্যাপিতৈগুণৈঃ।।
অনুবাদ: গুণবান ব্যক্তির কখনো আত্মপ্রশংসা করা উচিত নয়, নিজ গুণের বড়াই নিজে করলে দেবরাজ ইন্দ্রেরও সম্মান নষ্ট হয়। তাতে সামান্য মানুষ তো দূরের কথা, অপর লোকে যার প্রশংসা করে তাকে প্রকৃত গুণী বলা হয়ে থাকে।
দানার্থিনো মধুকরা যদি কর্ণতালৈ দুরীকৃতা করিবরেণ।
তস্যৈব গণ্ডযুগ মণ্ডন হানিরেব ভঙ্গাং পূর্ণবিকচ পদ্মবনে বসন্তি।।
অনুবাদ: চাণক্য নীতি অনুযায়ী– হাতি যেমন নিজের মদগন্ধে অন্ধ হয়ে কানের কাছে গুঞ্জরিত ভ্রমরকে তাড়াতে থাকে। তাতে ভ্রমরের কোন ক্ষতি হয় না, হাতির গন্ডস্হলই অশোভনমান হয়। তখন ভ্রমরা পদ্মবনে চলে যায়। এরূপ এ যদি কোন ব্যক্তি কোন গুণী ব্যক্তির সম্মান বা আদর না করে থাকে, তাতে গুণী ব্যক্তির কোন ক্ষতি হয় না। গুণীর আদর বা সম্মান করার অনেক লোক পাওয়া যাবে কিন্তু মূর্খ কোন দিন গুণী লোককে পাবে না। গুণীই গুণীজনকে লাভ করতে পারেন।
মামৈবাংশো জীবলোকে জীবভূতঃ সনাতন।
মনঃ ষষ্ঠানীন্দ্রিয়ানি প্রকৃতিস্হানি কর্ষতি।।
অনুবাদ: এই বদ্ধ জগতের জীবসমূহ আমার অতিশয় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ। তারা নিত্য এবং শাশ্বত। কিন্তু জীবনের জন্য তারা মনসহ ছটি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে কঠোর সংগ্রাম করছে। এই কথা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন।
ভগবান লাভে চাণক্য নীতি শাস্ত্র কথা
সমস্ত সাধু ব্যক্তিদেরই ঈশ্বরই একমাত্র সাধনা । সেই ঈশ্বর লাভের সুন্দর এবং সঠিকভাবে বর্ণনা আছে চাণক্যের চাণক্য নীতি তে।
একাদশী ব্রতং যে চ ভক্তিভাবেন কুর্ব্বতে।
গায়ন্তি মম নামানি জ্ঞেয়ান্তি বৈষ্ণবা জনাঃ।।
অনুবাদ: যে সকল ব্যক্তি ভক্তিভাবে একাদশী ব্রত পালন করেন ও শ্রীহরির নাম কীর্তন করেন তারাই বৈষ্ণব।
তুলসী মূল মৃত্তিকাশ্চ তিলকানি নয়ন্তি যে।
তুলসী কাষ্ঠ পঙ্কৈশ্চ বিজ্ঞেয়া বৈষ্ণবা জনাঃ।।
অনুবাদ: যে সকল ব্যক্তি তুলসী বৃক্ষের মূলদেশের মৃত্তিকা দ্বারা তিলক ধারন করেন, অথবা তুলসী কাষ্ঠ ঘর্ষিত পঙ্ক দ্বারা তিলক ধারন করেন তারাই পরম বৈষ্ণব।
ধারয়ন্তি না যে মালাং হৈতুকঃ পাপ বুদ্ধয়ঃ।
নরকান্ন নিবর্ত্তন্তে দগ্ধা কোপাগ্নিনা হরেঃ।।
অনুবাদ: যে সকল ব্যক্তি তুলসী মালা ধারণ করার আবশ্যকতা কি এই সকল হেতু দেখিয়ে বা হেতুবাদ বশত মালা ধারণ না করে, সেই সকল পাপ বুদ্ধি ব্যক্তিগণ অনন্ত নরক ভোগ করে এবং শ্রীহরির কোপানলে দগ্ধ হয়।
তুলসী কাষ্ঠ মালান্তু প্রেতরাজস্য দূতিকাঃ।
দৃষ্ট্বা নশ্যন্তি দূরেন বাতোদ্ধৃত যথাদলম্।।
অনুবাদ: যে ব্যক্তি তুলসী কাষ্ঠের মালা ধারণ করেন তাকে দেখে যমদূতগন বায়ুতাড়িত পত্রের ন্যায় সেই স্থান হতে পলায়ন করে।
নৃত্যং দত্তা তথাপ্নোতি রুদ্রলোকম্ সংশয়ঃ।
স্বয়ং নৃত্যের সম্পূজ্য তস্যৈবানুচর ভবেৎ।।
অনুবাদ: শ্রীভগবানের সামনে নৃত্য করা শাস্ত্রসম্মত। অপরের দ্বারা নৃত্য করালে যে নৃত্য করায় তার রুদ্র লোক প্রাপ্তি হয়। যে ভক্ত স্বয়ং নৃত্য করে সে ভক্ত শ্রীভগবানের অনুচর হয়ে থাকেন।
হরেঃ সঙ্কীর্তনং পূণ্যং মহাপাতক নাশনম্।
সর্বকাম প্রদং লোকেহ্যপবর্গ ফলপ্রদম্।।
অনুবাদ: শ্রীহরির নাম সংকীর্তন পুণ্যময় এবং মহাপাতক নাশকারী। এই মহাপুণ্যময় কীর্তন সর্বকাম ফলপ্রদ ও অপবর্গ দায়ক। নামে রুচি হলে প্রেমের উদয় হয়, আর প্রেমে হরিকে সহজে মেলে।
একং দেব্যা রবৌ সপ্ত ত্রীনি কুর্য্যাদবিনায়কে।
চত্বারি খেলবে কুর্যাৎ শিবেশ্চার্ধং প্রদক্ষিণং।।
অনুবাদ: স্ত্রী দেবতাকে একবার, সূর্যকে সাতবার, গনেশকে তিনবার, বিষ্ণুকে চারবার, শিবকে অর্ধবার প্রদক্ষিণ করবে।
স্ববামে প্রণমেদ্বিষ্ণুং দক্ষিণে শক্তি শঙ্করৌ।
প্রণমেচ্চ গুরুরগ্রে চান্যথা নিস্ফলং ভবেৎ।।
অনুবাদ: বিষ্ণুকে নিজের বামভাগে, শিবকে ও শক্তিকে ডানভাগে, গুরুকে নিজের অগ্রে রেখে প্রণাম করতে হয়, নতুবা প্রণাম নিষ্ফলা হয়।
কৃষ্ণনামং জগবন্ধুং জগদ্বীজং গুণং পরম্।
বিশ্বাধারং কৃষ্ণনামং জগতাং পাবনং পরম্।।
অনুবাদ: কৃষ্ণ নাম জগতের বন্ধু, জগতের বীজ ও পরম গুণযুক্ত। বিশ্বের আধার কৃষ্ণনামজগতের পরম পাবন স্বরূপ।
গোবিন্দ নাম সদৃশং না ম্যাংগো না ব্রতং মূলে।
ন সংকল্প নাপি শৌচং ন পূণ্যং ফলং তথা।।
অনুবাদ: গোবিন্দ নামের তুল্য ত্যাগ অর্থাৎ দান নেই, ব্রত নেই, সংকল্প নেই, শৌচ অর্থাৎ শুচিতা নেই এবং পূণ্যফলও নেই।
গোকোটি দানং গ্রহণে খগস্য প্রয়াগ গঙ্গাম্বু হি কল্পবাসঃ।
যজ্ঞাযুতং মেরু সুবর্ণ দানং গোবিন্দ কীর্তন সমং নং শতাংশৈঃ।।
অনুবাদ: গ্রহণকালে কোটি গো- দান করলে, প্রয়াগে গঙ্গাজলে অল্পকাল যাবৎ বাস করলে, অযুত সংখ্যক যজ্ঞানুষ্ঠান করলে, মেরুসদৃশ সুবর্ণ দান করলেও গোবিন্দ নাম কীর্তনের শতাংশের এক অংশ হয় না।
প্রাচীন ভারতের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিদ ছিলেন চাণক্য। চাণক্য নীতি মেনেই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সেই যুগের সেরা সম্রাট হয়েছিলেন। চাণক্য নীতি কথা আজও আমাদের সমাজে সমাদর পায়। চাণক্য নীতি কথা মেনে চললে আমাদের জীবন সুস্থ, স্বাভাবিক, সচ্ছল এবং সুখে যাপন করতে পারব।