উৎসেচক| গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য| উৎসেচক কত প্রকার ও কাজ

0
1311


উৎসেচক বা এনজাইম

সূচীপত্র দেখতে ক্লিক করুন show


উৎসেচকের সংজ্ঞা


সজীব কোষে উৎপন্ন প্রোটিনধর্মী বৃহদাকার যে জৈব অণুঘটক কোষের ভিতরে এবং বাইরে রাসায়নিক বিক্রিয়ার হারকে বাড়িয়ে দেয় এবং বিক্রিয়ার শেষে অপরিবর্তিত থাকে তাকে উৎসেচক বলে।
উৎসেচক সবগুলো সরল ও যৌগিক হয়। সরল উৎসেচক কেবলমাত্র প্রোটিন দিয়ে তৈরি। কিছু উৎসেচক প্রোটিন ও অপ্রোটিন বস্তু মিলে তৈরি। এদেরকে যৌগিক উৎসেচক বলে। এইসব যৌগিক উৎসেচকের ও প্রোটিন অংশটিকে কো-ফ্যাক্টর বলে। উৎসেচক ক্রিয়ার জন্য অপরিহার্য এই কো-ফেক্টর অজৈব বস্তু অর্থাৎ ধাতব আয়ন অথবা জৈব বস্তু হতে পারে। কো-ফ্যাক্টর জৈব বস্তু হলে এবং যদি সেটি উৎসেচকের সক্রিয় স্থানে দৃঢ়ভাবে যুক্ত থাকে কিন্তু কোভ্যালেন্ট বন্ধন এর দ্বারা যুক্ত থাকে না তখন তাকে সহ-উৎসেচক বা কোএনজাইম বলা হয়।যৌগিক প্রোটিনের অপ্রোটিন অংশটি যখন প্রোটিনের সঙ্গে কোভ্যালেন্ট বন্ধন দ্বারা যুক্ত থাকে এবং প্রোটিনের কাজে সহায়ক হয় তখন তাকে প্রস্থেটিক গ্রুপ বলে। সেই ভিত্তিতে যখন সহ উৎসেচক উৎসেচকের প্রোটিনের সঙ্গে কোভ্যালেন্ট বন্ধনী দ্বারা দৃঢ়ভাবে যুক্ত থাকে, তখন তাকে অনেকে প্রস্থেটিক গ্রুপ বলে।

প্রোটিন ও অপ্রোটিন জৈব বস্তু দিয়ে তৈরি উৎসেচককে হোলো উৎসেচক বলে। এই উৎসেচকের প্রোটিন অংশটিকে অ্যাপো উৎসেচক এবং অপ্রোটিন অংশটিকে বলে সহ উৎসেচক। প্রায় 2000 বিভিন্ন উৎসেচক এর সন্ধান পাওয়া গেছে এবং এদের আণবিক ওজন 12000 ডালটন থেকে 1 মিলিয়ন ডাল্টনের বেশি হয়। পেপসিন, ট্রিপসিন হল সরল উৎসেচক। সাকসিনেট ডিহাইড্রোজিনেজ একটি যৌগিক উৎসেচক। এর অপ্রোটিন অংশ FAD। এটি উৎসেচকের প্রোটিনের অংশের সঙ্গে কভেলান্ট বন্ধনীর দ্বারা দৃঢ়ভাবে যুক্ত। তাই এর অপ্রোটিন অংশকে প্রস্থেটিক গ্রুপ বলা হয়। আবার অনেকে একে সহ-উৎসেচকও বলে। ল্যাকটেট হাইড্রোজেনেজ একটি যৌগিক উৎসেচক যার অপ্রোটিন অংশ হলো NAD+। এই অংশ দৃঢ়ভাবে প্রোটিন অংশের সঙ্গে যুক্ত কিন্তু কোভালেন্ট বন্ধনীর দ্বারা যুক্ত নয়। তাই একে সহ উৎসেচক বলে।
কিছু উৎসেচক ধাতব আয়ন এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করে। যদি ধাতব আয়ন উৎসেচক এর সঙ্গে আলগাভাবে যুক্ত থাকে তাহলে উৎসেচকটি ধাতব ক্রিয়াশীল উৎসেচক বলে। আর যদি ধাতব আয়ন উৎসেচক এর সঙ্গে দৃঢ়ভাবে যুক্ত থাকে তখন তাকে বলে ধাতব উৎসেচক।


উৎসেচকের প্রকারভেদ


উৎসেচকের প্রকারভেদ
বিভিন্নভাবে উৎসেচককে ভাগ করা হয়েছে এগুলি নিচে আলোচনা করা হল—


I) বিক্রিয়ার ধরন অনুসারে

বিক্রিয়ার ধারণা অনুসারে উৎসেচকের প্রকারভেদ নিম্নরূপ—


অক্সিডো-রিডাকটেজ


এই প্রকার উৎসেচক সাবস্ট্রেট এর জারণ বিজারণ ঘটায়। যেমন ল্যাকটেট ডিহাইড্রোজিনেজ। এটি পাইরুভিক এসিডকে বিজারিত করে ল্যাকটিক এসিডে পরিণত করে। অপরপক্ষে ল্যাকটিক অ্যাসিডকে জারিত করে পাইরুভিক এসিড তৈরি করে।


ট্রানস্ফারেজ


এই প্রকার উৎসেচক একটি নির্দিষ্ট মূলককে একটি সাবস্ট্রেট থেকে অন্য সাবস্ট্রেটে স্থানান্তর করে। যেমন উভয়মুখী প্রক্রিয়ায় গ্লুটামেট পাইরুভেট ট্র্যান্সআমিনেজ। এই উৎসেচক NH মূলককে গ্লুটামেট বা গ্লুটামিক অ্যাসিড থেকে পাইরুভেট বা পাইরুভিক অ্যাসিডে স্থানান্তরিত করে। এই প্রক্রিয়ায় গ্লুটামেট আলফা কিটোগ্লুটারেটে এবং পাইরুভেট, অ্যামিনো অ্যাসিড আলানিনে পরিবর্তিত হয়।

উৎসেচকের ধর্ম ও বৈশিষ্ট্য
উৎসেচকের ধর্ম ও বৈশিষ্ট্য

হাইড্রলেজ


এই প্রকার উৎসেচক আর্দ্র বিশ্লেষণ এর মাধ্যমে সাবস্ট্রেটের কোভেলান্ট বন্ধনীকে ভেঙে দেয়। যেমন মল্টেজ মলটোজকে ভেঙে গ্লুকোজে পরিণত করে।


লাইয়েজ


এই প্রকার উৎসেচক সাবস্ট্রেট এর কোভ্যালান্ট বন্ধনীকে ভেঙে একের অধিক বস্তু তৈরি করে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় আর্দ্র বিশ্লেষণ হয় না। যেমন হিসটিডিন ডিকার্বক্সিলেজ হিসটিডিনকে হিস্টামিন ও কার্বন ডাই অক্সাইডে পরিণত করে।


আইসোমারেজ


এই প্রকার এনজাইম সাবস্ট্রেটকে একটি আইসোমার থেকে অপর আইসোমারে পরিবর্তিত করে। যেমন উভয়মুখী প্রক্রিয়ায় ফসফোহেক্সোজ আইসোমারেজ গ্লুকোজ ৬ ফসফেটকে ফ্রুক্টোজ ৬ ফসফেটে পরিণত করে।


লাইগেজ


এই প্রকার এনজাইম দুটি বস্তুকে কোভ্যালেন্ট বন্ধনীর সাহায্যে পরস্পর যুক্ত করে। যেমন পাইরুভেট কারবক্সিলেজ পাইরুভিক এসিড বা পাইরুভেট ও কার্বন ডাই অক্সাইড যুক্ত করে অক্সালো এসিটিক এসিড বা অক্সালিক এসিটেট উৎপন্ন করে।

II) অ্যালোস্টেরিক পরিবর্তন অনুসারে

অ্যালোস্টেরিক পরিবর্তনের উপর নির্ভর করে উৎসেচককে অ্যালোস্টেরিক এবং নন অ্যালোস্টেরিক এই দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যেসব উৎসেচক অ্যালোস্টেরিক বস্তু দ্বারা প্রভাবিত হয় তাদের অ্যালোস্টেরিক উৎসেচক বলা হয়। আর যারা এসব বস্তু দিয়ে প্রভাবিত হয় না তাদের নন-অ্যালোস্টেরিক উৎসেচক বলা হয়।

III) উৎসেচক উৎপন্নকারী জিন অনুসারে

এনজাইম উৎপন্নকারী জিনের কার্যকারিতার উপর নির্ভর করে উৎসেচককে ইনডিউসিবল এবং রিপ্রেসিবল এই দুই ভাগে ভাগ করা যায়। সাবস্ট্রেট উপস্থিত থাকলে তবেই যেসব উৎসেচক উৎপন্ন হয় তাদের বলে ইনডিউসিবল উৎসেচক।

অপচিতি মূলক কাজের উৎসেচক এর ক্ষেত্রে এই ধরনের ঘটনা ঘটে।


উপচিতি মূলক বিপাক ক্রিয়ায় যেসব উৎসেচক লাগে তাদের ক্ষেত্রে উৎসেচক তৈরি করার দিনগুলি সবসময় কাজ করে এবং উৎসেচক উৎপন্ন করে। উৎসেচক এর কাজের ফলে যে বস্তু তৈরি হয় তা উৎসেচক উৎপন্নকারী জিনের কাজ কে বন্ধ করে দেয়। ফলে ঐ বস্তু আর তৈরি হতে পারে না। এদের রিপ্রেসিবল উৎসেচক বলে।

IV) উৎসেচকের ক্রিয়াস্থান অনুসারে

উৎসেচকের ক্রিয়া স্থান অনুসারে এদের দু’ভাগে ভাগ করা যায়

এক্সো উৎসেচক


যেসব এনজাইম কোষ থেকে ক্ষরিত হয় এবং কোষের বাইরে কাজ করে তাদের এক্সো উৎসেচক বলে। যেমন পেপসিন। এই উৎসেচক টি পেপসিনোজেন হিসাবে পাকস্থলীর রসে খরিত হয় এবং পাকস্থলীতে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের সাহায্যে পেপসিন এ পরিণত হয়ে প্রোটিন খাদ্য পাচিত করে।


এনডো উৎসেচক


যেসব এনজাইম কোষের মধ্যে ক্ষরিত হয় এবং কোষের ভিতরে অবস্থিত বস্তুর উপর কাজ করে তাদের এনডো উৎসেচক বলে। যেমন গ্লুকোকাইনেজ। ইহা কোষের মধ্যে গ্লুকোজ এর উপর বিক্রিয়া করে।

V) আণবিক আকারের তারতম্য অনুসারে

আণবিক আকারের তারতম্যের জন্য কোন উৎসেচক বিভিন্ন হতে পারে
কিছু উৎসেচক বিভিন্ন আণবিক আকারের হয়। এইসব উৎসেচকের অ্যামাইনো এসিডের পর্যাক্রম ভৌত রাসায়নিক প্রকৃতি এবং গতিও ধর্ম আলাদা কিন্তু তারা সকলেই একটি নির্দিষ্ট বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে। এদের আইসো উৎসেচক বলে। যেমন হেক্সোকাইনেজ I, II, III, IV। হেক্সোকাইনেজ হেক্সোজকে এটিপির সাহায্যে হেক্সোজ ফসফেটে পরিণত করে। হেক্সোকাইনেজ IV যকৃতে পাওয়া যায়। অন্যগুলি পেশী এবং মস্তিষ্কে পাওয়া যায়। এরা বিপাকক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।



উৎসেচকের ধর্ম ও বৈশিষ্ট্য

উৎসেচকের ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য আমরা মূলত দুটি ভাগে ভাগ করতে পারি

ক) ভৌত রাসায়নিক ধর্মসমূহ

  • উৎসেচক গুলির প্রোটিনজাতীয় বলে প্রোটিন ধর্মী।
  • উদ্ভিদ বীজের কিছু লিপিড বিশ্লিষ্টকারী উৎসেচক ছাড়া অন্যসব এনজাইম জল, গ্লিসারল ও লঘু অ্যালকোহলে দ্রবণীয়।
  • প্রতি উৎসেচকের একটি নির্দিষ্ট সমতড়িৎ বিন্দু আছে। এই বিন্দুতে ওই উৎসেচক টি সবচাইতে কম দ্রবণীয়।
  • বেশি উত্তাপে এনজাইম তঞ্চিত হয় এবং এর কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়।
  • এদের ঝিল্লি বিশ্লেষণ করা যায় না।
  • প্রোটিন অধঃক্ষেপকারি বস্তু উৎসেচকেও অধঃক্ষিপ্ত করতে পারে।
উৎসেচকের প্রকারভেদ
উৎসেচকের প্রকারভেদ

খ) জৈবিক ধর্ম

  • উৎসেচক অনুঘটক এর মত কাজ করে।অর্থাৎ এরা রাসায়নিক বিক্রিয়ার হার বাড়িয়ে দেয় কিন্তু নিজে অপরিবর্তিত থাকে।
  • উৎসেচক এর কাজ একমুখী বা উভয়মুখী হতে পারে।
  • উৎসেচক যে বস্তুর উপর কাজ করে তাকে সাবস্ট্রেট বলে। এনজাইম সুনির্দিষ্ট সাবস্ট্রেট এর উপর কাজ করে।একটি নির্দিষ্ট উৎসেচক একটি নির্দিষ্ট বিক্রিয়া কি সাহায্য করে।গ্লুকো কাইনেজ শুধুমাত্র গ্লুকোজকে গ্লুকোজ ৬ ফসফেটে পরিণত করে। তবে উৎসেচক এর ক্ষেত্রে নানা রকম সুনির্দিষ্টতা দেখা যায়।
  • সাবস্ট্রেটের ঘনত্বের ওপর উৎসেচকের কাজ নির্ভর করে। সাবস্ট্রেটের ঘনত্ব উৎসেচকের কাজের হারকে বাড়িয়ে দেয়।
  • উৎসেচকের কাজ হচ্ছে উৎসেচকের ঘনত্বের উপর নির্ভর করে। উৎসেচক এর ঘনত্ব বেশি হলে উৎসেচকের কাজের হার বেড়ে যায়।
  • উৎসেচকের কাজ তাপ নির্ভর।তাপ বাড়ালে উৎসেচক এর কাজের হার বাড়তে থাকে এবং একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় কাজের গতি সবচেয়ে বেশি হয়। একে বলে সর্বাধিক অনুকূল উষ্ণতা।
  • এনজাইম এর কাজ তাপের মত pH নির্ভর। একটি নির্দিষ্ট পিএইচএ উৎসেচকের কাজের গতি সবচেয়ে বেশি। একে সর্বাধিক অনুকূল সিএইচ বলে। বিভিন্ন উৎসেচকের অনুকূল পিএইচ বিভিন্ন হয়।
  • উৎসেচকের কাজে প্রতিযোগিতামূলক এবং অপ্রতিযোগিতামূলক প্রতিরোধ দেখা যায়। যে বস্তু অবদমন ঘটায় তাকে রোধক বলে। রোধক দু’প্রকার প্রতিযোগী রোধক এবং অপ্রতিযোগী রোধক।
  • প্রতিযোগী রোধকের গঠনের সঙ্গে উৎসেচকের সাবস্ট্রেট এর গঠন এর মিল থাকায় এই রোধকটি উৎসেচকের সক্রিয় স্থানে যেখানে সাবস্ট্রেট যুক্ত হয় সেখানে লাগে। ফলে সাবস্ট্রেট উৎসেচক এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে না এবং উৎসেচকের কাজ বাধা পায়।

উৎসেচক ও অজৈব অণুঘটক এর মধ্যে পার্থক্য


উৎসেচক ও অজৈব অণুঘটক এর মধ্যে পার্থক্য নিম্নরূপ—

উৎসেচকঅজৈব অণুঘটক
উৎসেচক অধিক আণবিক ওজন যুক্ত প্রোটিন ধর্মী জৈব বস্তু।অজৈব অণুঘটক আনবিক ওজন যুক্ত অজৈব বস্ত।
উৎসেচক সজীব কোষে তৈরি হয়।অজৈব অণু ঘটক সজীব কোষে তৈরি হয় না।
সুনির্দিষ্ট সাবস্ট্রেট এর উপর কাজ করে।এর কোন সাবস্ট্রেট সুনির্দিষ্টতা নেই।
পিএইচ তাপ, নির্দিষ্ট কোন বস্তু সঙ্গে সংযোগ, উৎসেচকের ত্রিমাত্রিক
গঠনের পরিবর্তন ঘটাতে পারে এবং উৎসেচকের কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে।
এদের কাজ এভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় না।
অধিক উত্তাপে বিনষ্ট হয় ও নিষ্ক্রিয় হয়।অধিক উত্তাপে নষ্ট হয় না।
উৎসেচক এর একটি গঠন যুক্ত নির্দিষ্ট স্থান আছে।অজৈব অণুঘটকে এরকম কোন বিন্যাস নেই।
উৎসেচক ও অজৈব অণুঘটক এর মধ্যে পার্থক্য



অ্যাপো-উৎসেচক এবং কোএনজাইম বা সহ-উৎসেচকের মধ্যে পার্থক্য

অ্যাপো-উৎসেচক এবং কোএনজাইম বা সহ-উৎসেচকের মধ্যে পার্থক্য নিম্নরূপ —-

অ্যাপো-উৎসেচককোএনজাইম বা সহ-উৎসেচক
অ্যাপো-উৎসেচক যৌগিক উৎসেচকের প্রোটিনের।যৌগিক উৎসেচকের জৈব অপ্রোটিন অংশ।
এই অংশটিতে উৎসেচকের ক্রিয়া স্থানে অবস্থিত।এই উৎসেচকের ক্রিয়া স্থানের সঙ্গে যুক্ত হয় কিন্তু কোভ্যালেন্ট বন্ড দিয়ে নয়।
অ্যাপো-উৎসেচক এবং সহ-উৎসেচকের মধ্যে পার্থক্য


এনজাইম ও কোএনজাইমের
(উৎসেচক ও সহ উৎসেচকের ) পার্থক্য

উৎসেচক ও সহ উৎসেচকের পার্থক্য নিম্নরূপ —–

উৎসেচকসহ উৎসেচক বা কোএনজাইম
অধিক আণবিক ওজনযুক্ত প্রোটিনধর্মী, জৈব অনুঘটক।কম আণবিক ওজনযুক্ত যৌগিক উৎসেচকের অপ্রোটিন জৈব অংশ।
তাপ সংবেদনশীল ও ঝিল্লি বিশ্লেষণ যোগ্য নয়।তাপ সহনশীল এবং ঝিল্লি বিশ্লেষণ যোগ্য।
উৎসেচকের কাজ সহ-উৎসেচক ছাড়াও হতে পারে। নির্দিষ্ট সাবস্ট্রেট এর উপর কাজ করে।কোএনজাইম বা সহ-উৎসেচকের কাজ উৎসেচক ছাড়া হতে পারে না। নিজে উৎসেচকের সাহায্য ছাড়া কাজ করতে পারে না।
এনজাইম ও কোএনজাইমের (উৎসেচক ও সহ উৎসেচকের ) পার্থক্য


এনজাইমের বা উৎসেচকের কার্যপদ্ধতি


এনজাইম ক্রিয়া দুটি ধাপে হয়। প্রথম ধাপে উৎসেচক E সাবস্ট্রেটS এর সঙ্গে যুক্ত হয় ES। পরের ধাপে সাবস্ট্রেট ভেঙে গিয়ে বিক্রিয়া লব্ধ বস্তু P তৈরি হয় এবং উৎসেচক বিযুক্ত হয়।

কোশের মধ্যে অভিস্রবণ

এনজাইম অনুর একটি বিশেষ স্থান উৎসেচক ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। এই বিশেষ স্থানকে ক্রিয়া স্থান বা অনুঘটন স্থান বলে। এই স্থানটির দুটি অংশ। একটির সঙ্গে সাবস্ট্রেট যুক্ত হয়। একে সাবস্ট্রেট সংযুক্তি স্থান বা অংশ বলে। আবার যে অংশটি অনুঘটন এর জন্য দায়ী তাকে অনুঘটন অংশ বলে। কোন কোন ক্ষেত্রে বিশেষ পদ্ধতিতে এই যৌগ কে আলাদা করা সম্ভব হয়।বিভিন্ন প্রকার নন-কোভ্যালেন্ট বন্ধনীর সাহায্যে সাবস্ট্রেট উৎসেচকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ES যৌগ তৈরি করে। কিছু ক্ষেত্রে কভালেন্ট বন্ধনীর সাহায্যেও সাবস্ট্রেট ও উৎসেচকের সংযুক্তি ঘটে। যেমন হাইড্রোজেন বন্ড, হাইড্রোফোবিক আন্তর বিক্রিয়া, ইলেকট্রোস্ট্যাটিক বন্ড, ভান্ডার-ওয়ালস শক্তি নামক non-covalent বন্ধনী এবং কভালেন্ট সীফ বেস, কভালেন্ট থায়ো এসটার অথবাকভালেন্ট থায়োঅ্যাসিটাল বন্ধনী নামক কোভ্যালেন্ট বন্ধনী। এই ES যৌগ অনুঘটন ক্রিয়াকে নানাভাবে সাহায্য করে। যেমন এই যৌগ হওয়ার জন্য অনুঘটন অংশটি সাবস্ট্রেট এর কাছে চলে আসে। সাবস্ট্রেটের বন্ধনীর ওপর এনজাইম সহজে কাজ করতে পারে। উৎসেচক ক্রিয়ায় মূলক স্থানান্তরের সুবিধা হয় ইত্যাদি।বলা হয় যে উৎসেচক এর সক্রিয় স্থানটির একটি নির্দিষ্ট আকার আছে এবং শরীরের যে অংশটি এর সাথে যুক্ত হয় তারও একটি বিশেষ আকৃতি আছে। এই দুটি গঠন পরস্পরের সঙ্গে সঠিকভাবে যুক্ত হয়। ঠিক যেমন একটি তালাতে একটি নির্দিষ্ট চাবি লাগানো যায়।

আবার অনেক উৎসেচকের ক্রিয়া এই ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। যেমন অ্যালোস্টেরিক পরিবর্তনকারী বস্তু সক্রিয় স্থানে বসে না কিন্তু উৎসেচকের ক্রিয়াকে প্রভাবিত করে।

অ্যালোস্টেরিজম


কোন কোন এনজাইম- এর ক্ষেত্রে বিপাক নিয়ন্ত্রণকারী ক্ষুদ্র কোন উৎসেচকের ক্রিয়া স্থানে না বসে পাশে অ্যালোস্টৈরিক স্থানের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং উৎসেচক ক্রিয়ার হার এর পরিবর্তন ঘটায়। এই এনজাইমগুলিকে অ্যালোস্টৈরিক উৎসেচক বলে। এই বস্তুকে অ্যালোস্টৈরিক পরিবর্তনকারী বস্তু বলে। এই পরিবর্তনের ফলে যদি উৎসেচক ক্রিয়ার হার বেড়ে যায় তাহলে অ্যালোস্টৈরিক অনুটিকে অ্যালোস্টৈরিক এফেক্টর বলে। আর যদি এই পরিবর্তন অনুবাদকের কাঁধের হাড় কে কমিয়ে দেয় তাহলে এই বস্তুটিকে অ্যালোস্টৈরিক রোধক বলে। যে উৎসেচক অ্যালোস্টৈরিক নিয়ন্ত্রক এর সঙ্গে যুক্ত হয় এবং সারা দেয় তাকে অ্যালোস্টৈরিক উৎসেচক বলে।


উৎসেচকের নিয়ন্ত্রণ


প্রধানত দুইভাবে উৎসেচক ক্রিয়ার হার নিয়ন্ত্রিত হয়।

উৎসেচক
উৎসেচক

অভিমুখে কোভ্যালেন্ট পরিবর্তন:


অনেক উৎসেচক সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় এই দুই অবস্থার মধ্যে থাকে।এদের সক্রিয় অবস্থায় পরিবর্তিত করলে উৎসেচক কার্যকরী হবে এবং এদের নিষ্ক্রিয় অবস্থায় পরিবর্তিত করলে এনজাইম এর কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। যেমন গ্লুকোজেন ফসফোরাইলেজ উৎসেচক ফসফেট এর সঙ্গে কভেনান্ট বন্ধন এর সাহায্যে যুক্ত হলে উচ্চশক্তির সক্রিয় হয় এবং গ্লুকোজেনকে আদ্র বিশ্লেষণ এর মাধ্যমে গ্লুকোজ ১ ফসফেট এর পরিবর্তিত করে। আবার এই এনজাইমকে ফসফেট মুক্ত করে দিলে এনজাইমটি কাজ করতে পারে না।বিপাক নিয়ন্ত্রণকারী জৈব বস্তু যেমন হরমোন এইভাবে উৎসেচককে সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় করে বিপাক ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে।উদাহরণস্বরূপ বলা যায় অ্যাড্রিনালিন বা গ্লুকাগন হরমোন এই প্রক্রিয়ায় গ্লুকোজেন ফসফোরাইলেজকে সক্রিয় করে গ্লাইকোজেন থেকে গ্লুকোজ ১ ফসফেট তৈরি অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়।

উৎসেচক সংশ্লেষ:


যে সমস্ত জিন এনজাইম তৈরি করে তাদের কাজের হারকে বাড়িয়ে দিয়ে বেশি এনজাইম তৈরি করা যায়। আবার তাদের কাজের হার কে কমিয়ে দিয়ে এনজাইম এর পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া যায়। বিপাক নিয়ন্ত্রণকারী বস্তু এইভাবেও উৎসেচকের ক্রিয়ার হার কে নিয়ন্ত্রণ করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় গ্লুকোজ ৬ ফসফাটেজ এনজাইম গ্লুকোজ ৬ ফসফেটকে গ্লুকোজে পরিণত করে।গ্লুকাগন হরমোন এই উৎসেচকের তৈরীর হারকে বাড়িয়ে দেয় ফলে এই উৎসেচক এর পরিমাণ বেড়ে যায় এবং গ্লুকোজ ৬ ফসফেট থেকে গ্লুকোজ তৈরি হওয়ার পরিমাণ বেড়ে যায়। এর ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়। অপরদিকে ইনসুলিন হরমোন এই উৎসেচক তৈরি হার কমিয়ে দেয়। এর ফলে এই এনজাইম এর পরিমাণ কমে যায়। এর ক্রিয়ার হার অনেক কমে যায় এবং রক্তে গ্লুকোজের মাত্রাও কমে যায়।

এছাড়াও বিপাকীয় বস্তু অ্যালোস্টেরিক পরিবর্তনকারী বস্তু হিসেবে কাজ করে ফলে সেগুলি অ্যালোস্টেরিক পদ্ধতির সাহায্যে উৎসেচকের ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে।

উৎসেচকের ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণকারি প্রোটিন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন ক্যালসিয়াম ক্যালমোডিউলিন যৌগ উৎসেচক এর সঙ্গে যুক্ত হয় তাকে সক্রিয় করে তোলে।

অনেক ক্ষেত্রে উৎসেচকটি প্রোউৎসেচক হিসাবে তৈরী হয় এবং তা নিষ্ক্রিয়। উপযুক্ত সময়ে এদের সক্রিয় করা হয়।যেমন পাকস্থলীর পাচক রসের উৎসেচক পেপসিন পেপসিনোজেন হিসাবে ক্ষরিত হয়। পেপসিনোজেন নিষ্ক্রিয়। পাকস্থলী রসের HCL একে সক্রিয় ব্যবসায় পরিণত করতে পারে।

image source: unsplash.com

content source:নির্মলা লাইব্রেরির “উচ্চমাধ্যমিক সমকালীন জীব বিদ্যা”

শক্তির রূপান্তর| শক্তির প্রকারভেদ| শক্তির নিত্যতা সূত্র| শক্তির উৎস সম্বন্ধে জানতে ক্লিক করুন।


ব্যাপন ও অভিস্রবণ | পার্থক্য এবং গুরুত্ব | প্রকারভেদ see more

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here