আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এর জীবনী রচনা

0
1638

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ছিলেন একজন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী । জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি দৃষ্টান্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। কখনোও তিনি বিজ্ঞানী হিসেবে তার জীবন বিকশিত করেছেন, কখনোও বা তিনি আমাদের সামনে আবির্ভূত হয়েছেন সমাজ সংস্কারকরূপে। আবার কখনো প্রবন্ধকার হিসাবেও চোখে ধরা পড়েছেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়।

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের বাল্য জীবন

এখনকার বাংলাদেশের খুলনা জেলার পাইকগাছি থানার রাড়ুলী গ্রামে প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের জন্ম হয়েছিল। ১৮৬১ সালের ২রা আগস্ট তারিখে।

বাল্য ও কৈশোর কালে তার একমাত্র আদর্শ ছিলেন তার বাবা হরিশ চন্দ্র রায়। বিদ্যানুরাগী মানুষ ছিলেন হরিশ চন্দ্র রায়। কমপক্ষে সাতটি ভাষায় তিনি সমান দক্ষতা অর্জন করেন। বাংলা, ইংরেজি, হিন্দ্‌ সংস্কৃত, আরবি-ফারসি এবং উর্দু ভাষায় তিনি সাবলীল ভাবে কথা বলতে পারতেন।

অন্য একটি কারণে প্রফুল্ল চন্দ্র রায় চিরদিন বাবাকে মনে রেখেছেন। হরিশচন্দ্র আজীবন ধর্মীয় কুসংস্কারের সাথে লড়াই করেছেন। বিধবা বিবাহ আইন সিদ্ধ হওয়ার পর তিনি ঠিক করেন যে রাড়ুলী গ্রামেও এই ধরনের বিবাহ প্রচলন করতে হবে।

অনেক খোঁজাখুঁজির পর অল্প বয়সী এক যুবককে পাওয়া গেল তার নাম মোহনলাল বিদ্যাবাগীশ। তিনি এক বিধবা কন্যাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলেন।

সমস্ত গ্রাম সেদিন ভেঙে পড়ে ক্ষোভে। গ্রামের মোড়ল মাতব্বররা একত্রিত হয়ে বলেছিলেন এসব বিধর্মী কাজ শহর কলকাতায় চলতে পারে কিন্তু রাড়ুলী গ্রামে এসব চলবে না। হরিশচন্দ্রের পিতা আনন্দমোহন রুখে দাঁড়িয়েছিলেন পুত্রের এই কর্মের বিরুদ্ধে।

শেষ পর্যন্ত হরিশচন্দ্রকে এই অসম লড়াইতে হার মানতে হয়েছিল। কিন্তু তিনি এভাবে প্রতিবাদে যে ভাষা সাধারণ মানুষের মুখে দিয়েছিলেন একদিন তার স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের উন্মত্ততায় ফেটে পড়ে।

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ছোটবেলায় ভিষণ দুরন্ত ছিলেন। তার মন ছিল দস্যিপনায়, খেলাধুলাতে আর অনিচ্ছা ছিল পড়াশোনা করতে। পড়াশোনা করতে মোটেই ভাল লাগত না তার।বাবা হরিশচন্দ্র তারই পুত্রটিকে আদর করে ডাকতাম ‘ফুলু’ বলে মা ভুবনমোহিনী ডাকতেন ‘ফুলো’ বলে।

মাত্র ৪ বছর বয়সে প্রফুল্ল চন্দ্রকে গ্রামের পাঠশালাতে ভর্তি করে দেয়া হয়েছিল। প্রফুল্ল চন্দ্র কিন্তু মোটেই বই নিয়ে বুঝতে চাইতেন না। দুপুরবেলা একটু করে পালিয়ে যেতেন পাঠশালার জানালার ফাঁকা দিয়ে। আম বাগানে বসে থাকতেন জামরুল চুরি করে খেতেন ধরা পড়লে অবশ্য শাস্তি ও জুটতো কপালে।

বাবা হরিশচন্দ্র রায় ছিলেন বিদ্যানুরাগী মানুষ। গ্রামের পাঠশালাতে উচ্চশিক্ষা সম্ভব নয় বলে তিনি নিজের খরচে একটি স্কুল বানিয়ে দিলেন এবং সেখান ছেলেদের পড়াশোনার সুব্যাবস্থা গড়ে উঠলো।

তারপরে মাথায় ভাবনার এল মেয়েরা চিরদিন অন্তঃপুরবাসিনী হয়ে থাকবে! নিজের নামটাও তারা সই করতে পারবে না। তাই মেয়েদের জন্য আলাদা করে একটু স্কুল গড়ে তুলেছিলেন তিনি নাম রেখেছিলেন ‘ভুবনমোহিনী বিদ্যালয়’।

হরিশচন্দ্র যে স্কুলটি ছেলেদের জন্য তৈরি করেছিলেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় সেই স্কুলেই ভর্তি হলেন। ন’ বছর বয়স পর্যন্ত এই স্কুলের আঙিনাতে তিনি বড় হয়েছিলেন। তারপর তাকে পড়তে পাঠানো হলো কলকাতাতে।

হরিশচন্দ্র রায়ের কলকাতা পাড়ি

১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে সপরিবারে হরিশচন্দ্র চলে এলেন শহর কলকাতায়। পিছনে পড়ে রইল কপোতাক্ষ নদ গ্রামের নিশ্চিত। স্বদেশী আন্দোলনের উন্মত্ত চেতনার মহালগ্নে। ১৩২ নম্বর ক্যামাক স্ট্রীটের এক বাড়িতে এসে উঠলেন।

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের বড়ো দাদা জ্ঞানেন্দ্র ভর্তি হয়েছিলেন হিন্দু স্কুলে, মেজো দাদা নলিনীকান্ত আর প্রফুল্ল এলেন হেয়ারে। চার দেয়ালের মধ্যে বসে থাকতে একদম ভালো লাগতো না সেদিনের সেই কিশোর প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের।

তবে পড়াশোনাকে একেবারে অবজ্ঞা করতেন না তিনি। ধীরে ধীরে বইয়ের প্রতি একটা অদ্ভুত ধরনের টান অনুভুত হতো তার মধ্যে। কোন কখনো রাত্রি জেগে বই পড়তেন। ভালো লাগতো নিউটনের জীবনী পড়তে। গ্যালিলিওর উপর যে সামাজিক অত্যাচার করা হয়েছিল সেই কাহিনী শুনে দুচোখ অশ্রু সজল হয়ে উঠত তার। আর ভালোবাসতেন শেক্সপিয়ারের নাটক পড়তে।

রাত জেগে পড়াশোনা করার ফল অচিরেই পেতে হল তাকে। এমনিতেই আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ছিলেন রুগ্ন আর দুর্বল। ভয়ংকার অনিয়মে অজীর্ণতা রোগ পেয়ে বসল তাকে। রোগের তারণও এতদুর পৌঁছেছে হরিশচন্দ্র আর তার এই ছেলেটিকে কলকাতায় রাখতে ভরসা পেলেন না। সিদ্ধান্ত নিতে হলো তাকে নিয়ে রাড়ুলী গ্রামে ফেরার। তখন তিনি হেয়ার স্কুলের ফোর্থ ক্লাসের ছাত্র।

ফিরে এলেন রাড়ুলী গ্রামের সেই চেনা মাঠ চেনা পরিবেশে। এখানে এসে যেন হাফ ছেড়ে বাচলেন ১৩ বছরের কিশোর প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। এবার আর দৌরাত্ম্য নয়, আম চুরি করা নয়, প্রফুল্ল চন্দ্রের চরিত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।

বাড়িতে অসংখ্য বই ছিল। বাবা বই পড়তে ভালোবাসতেন তাই সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। এবার সেই বইয়ের রাজত্বে ডুবে গেলেন প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। রাজেন্দ্রলাল মিত্র ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’ শেক্সপিয়ারের নাটক আরো কত কি-সবকিছু তিনি খুব মন দিয়ে পড়তে শুরু করলেন।

প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের কলকাতায় প্রত্যাবর্তন

বছর দেড়েক গ্রামে কাটাবার পর আবার কলকাতায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। সেটা ছিল ১৮৭৪ সালের কথা। হেয়ার স্কুলে আর তার জায়গা হয়নি এবার অ্যালবার্ট স্কুলে ভর্তি হলেন। এখান থেকে শেষ পর্যন্ত ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করলেন। প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন কিন্তু ফল আশা অনুরূপ হয়নি। মাস্টারমশাইরা ভেবেছিলেন প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ওই পরীক্ষায় প্রথম বা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করবেন।

প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের উচ্চ শিক্ষা ও রসায়নের প্রতি ভালোবাসা

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের জীবনী
আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের জীবনী

প্রবেশিকা পরীক্ষা হল এখনকার মাধ্যমিক পরীক্ষার মতো। এবার উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হবে। তখন একে বলা হতো ফার্স্ট আর্টস বা এফ এ।

কিন্তু কোন কলেজে ভর্তি হওয়া যায় এটি একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ালো। সবচেয়ে আগে প্রেসিডেন্সি কলেজের নাম তার মনে পড়ে। কিন্তু সেখানে পড়ার খরচ একটু বেশি। তাই তাকে ভর্তি করা হল বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে।

কলেজে এসে রসায়ন সাবজেক্ট তার খুব ভালো লাগতো। একটা জিনিসের সঙ্গে আরেকটা জিনিস মেশালে কি তৈরি হয় তা জানতে তিনি খুব আগ্রহী ছিলেন। রসায়নের মধ্যে একটা কেমন সবসময়ই রহস্যের গন্ধ অনুভব করতে পারতেন তিনি। মনের ভিতরে একটা নেশার জমে যায়।

১৮৮০ সালে এসে পরীক্ষার ফল হলো আরও খারাপ। দ্বিতীয় বিভাগে পাস করলেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়।

এদিকে হরিশচন্দ্রের আর্থিক অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে শুরু করেছে। জমিজমা বিক্রি করতে হয়েছে। মায়ের গহনা বিক্রি করে যে সম্পত্তি কেনা হয়েছিল তাও বেঁচে দিতে হলো। বাবার মুখ সবসময় থমথমে। মাকে আড়ালে-আবডালে কাঁদতে দেখেছেন সেদিনের তরুণ প্রফুল্ল চন্দ্র রায়।

প্রফুল্ল চন্দ্রের স্বানিরভর হওয়ার ইচ্ছা

এর মধ্যেই বিএ ক্লাসে ভর্তি হলেন তিনি। বাবার কাছ থেকে টাকা নিতে মন চাইত না তার। হরিশচন্দ্র ইতিমধ্যে একটি কাজ করেছিলেন। সংস্কৃত ইংরেজি অভিধান নিজের খরচে ছেপেছিলেন। কিন্তু প্রচারের অভাবে সেই বইটি ভালো ভাবে বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। বাড়িতেই পড়ে ছিল সেগুলি। পুরনো কাগজের ধরে সেগুলি মাঝেমধ্যে বিক্রি করে দেওয়া হতো সংসারের আর্থিক অনটন থেকে সামান্য পরিত্রাণের জন্য।

হঠাৎ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের মনে একটি একটি উপার্জনের পথ আবিষ্কার হলো। প্রফুল্ল চন্দ্র রায় এই বই গুলো দেখে অন্য কথা ভাবলেন। নষ্ট হয়ে যাওয়া বইগুলোকে নিজের হাতে বাধায় করলেন তিনি। প্রতিটি খন্ড ৬ টাকা করে বিক্রি হবে এই বিজ্ঞাপন সংবাদপত্রে দেওয়া হল। লোকে বই কিনতে শুরু করলেন। তিনি খুব উৎসাহী হয়ে উঠলেন। ভাবলেন এভাবে ইনকাম আসলে পড়াশোনা শেষ করে ব্যবসায় নামলেন কেমন হয়!

প্রফুল্ল চন্দ্রের বৃত্তি পেয়ে বিদেশ যাত্রা

ইংল্যান্ডের উত্তরদিকে স্কটল্যান্ড অবস্থিত। তার রাজধানী এডিনবার্গ। সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয় একটি বৃত্তি পরীক্ষার আয়োজন করেছিল। ওই পরীক্ষায় পাস করলে বিশ্ব বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনা পয়সায় পড়াশোনা করা যেতে পারে।প্রফুল্ল চন্দ্র রায় আরো জানতে পারলেন যে এই পরীক্ষায় পাস করতে গেলে একাধিক ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে হবে।

ইংরেজি ছাড়াও লাতিন, সংস্কৃত, গ্রিক, ফরাসি কিংবা জার্মান ভাষা শিখতে হবে। সংস্কৃত তিনি ভালভাবেই জানতেন। চলে এলেন স্কটল্যান্ডে। সেখানে এসে লাতিন ভাষা শিখেছিলেন তিনি।

স্টেটমেন্ট পত্রিকা থেকে জানা গেল যে ভারতবর্ষ থেকে মাত্র দুজন নির্বাচিত হয়েছেন ওই পরীক্ষায়। তাদের মধ্যে একজন প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। বন্ধুরা অবাক হয়ে গেল।

এরপর বিদেশ যাওয়ার তোড়জোড় চলতে লাগলো। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাস। ২১ বছরের তরতাজা সদ্য তরুণ প্রফুল্ল চন্দ্র রায় জাহাজে জাহাজে উঠে বসলেন স্কটল্যান্ডে পাড়ি দেওয়ার জন্য।

যে জাহাজে তিনি করেছিলেন সেই জাহাজের নাম ‘ক্যালিফোর্নিয়া’। কলকাতা বন্দর ছেড়ে সেটি সমুদ্র পাড়ি দিল। সমুদ্রযাত্রায় প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন প্রফুল্ল চন্দ্র। তার সী সিকনেস দেখা দেয়।

এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় বিএসসি ক্লাসে ভর্তি হয়েছিলেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। বিষয় হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন রসায়ন, পদার্থ বিজ্ঞান এবং প্রাণিবিজ্ঞান। এবার আর ফাঁকি দেওয়া নয়। ক্লাসে রসায়ন পড়াতেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী এ সি ব্রাউন। প্রফুল্ল চন্দ্র রায় তার ভাষণ মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতেন। অসাধারণ পাণ্ডিত্য আছে ভদ্রলোকের মধ্যে, কিন্তু কি সুন্দর ভাবে সবকিছু বুঝিয়ে দেন।

স্বদেশ প্রেমী প্রফুল্ল চন্দ্র রায়

দেখতে দেখতে পরীক্ষা চলে এল সামনে। পরীক্ষার আগে আর একটি ব্যাপার থাকে ভীষণভাবে আলোড়িত করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রবন্ধ লেখার একটি প্রতিযোগিতার কথা ঘোষণা করেছিল। এর বিষয় ছিল ‘সিপাহী বিদ্রোহের আগে আর পরে ভারতের অবস্থা’।

পরাধীন ভারতের তরুণ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের মন নেচে উঠল। এবার সুযোগ পাওয়া গেছে। দেখতে হবে ব্রিটিশ সরকার কিভাবে ভারতবাসীকে শোষণ করছে।

প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের লেখা ওই প্রবন্ধটি পুরস্কার পায়নি এ কথা সত্যি। কিন্তু যেভাবে তিনি অত্যাচারে ব্রিটিশ সরকারের স্বরূপ উদঘাটন করেছিলেন তা দেখে সকলে তার সৎ সাহসের প্রশংসা করেছিলেন। নিজে ইংল্যান্ডে থেকে কেউ এইভাবে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে অভিযোগ করতে পারেনি। কেউ তা ভাবতেও পারেননি।

স্বেচ্ছাচারী ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ জনমতের তোয়াক্কা না করে যেভাবে নিত্যনতুন কালা আইন চালু করেছিল তাকে সরাসরি অভিযুক্ত করে তিনি লিখেছিলেন- ‘ভারতবর্ষের প্রতি কর্তব্য পালনে ইংল্যান্ড এখনো পর্যন্ত ব্যর্থ এবং শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ!’

ভারতকে কিভাবে অত্যাচার ব্রিটিশ শাসন করেছে সে কথা লিখতে গিয়ে অকুণ্ঠচিত্তে প্রফুল্ল চন্দ্র বলেন-‘আজ তোমরা নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধাবে, কাল চীনের সঙ্গে। এই তোমাদের যুদ্ধ মিসরের সঙ্গে ওই আফগানদের সঙ্গে আর তার খেসারত দিতে হবে ভারতবাসী- সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের।’

তার জীবনধারা ছিল খুবই সহজ সরল কিন্তু চিন্তাভাবনা রাখতেন খুব উচ্চ মানের। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বেশভূষায় ছিলেন অতি সাধারন ধুতির সাথে কালো কোট পরে থাকতেন। চুল দাড়ি কাটার কথা মনে থাকত না তার।

মনেপ্রাণে তিনি স্বদেশী এবং ভারত মায়ের পুজারি ছিলেন। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বলতেন ভারতবর্ষের মানুষ গোলাম হয়ে কেন কাটাবেন এদের অধিকার আছে স্বাবলম্বী হওয়ার। স্বদেশপ্রেম তারমধ্যে সবসময় ভরা ছিল বিদেশে গিয়ে তার স্বদেশপ্রেম কোন অংশে কমেনি ।

বরং বিদেশ মাটি থেকে ঘুরে আসা সত্ত্বেও স্বদেশের প্রতি তার ছিল অত্যন্ত প্রীতি ও ভালোবাসা। তিনি কলেজে বাংলা ভাষাতে লেকচার দিতেন। তিনি ছিলেন ভীষণ উদার।

এর থেকে আত্ম উপলব্ধি করা যেতে পারে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় কতটা স্বদেশপ্রেমী ছিলেন।

প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের অধ্যাপনা ও পেশা

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ১৮৮৮ সালে ভারতে ফিরে আসেন এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার কাজ শুরু করেন। অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় মনোগ্রাহী বক্তৃতার মাধ্যমে তিনি রসায়ন সবার মনের মধ্যে যাতে প্রভাব সৃষ্টি করে সেদিকে খেয়াল রাখতেন। অত্যন্ত অল্প দিনের মধ্যে শিক্ষক হিসাবে তিনি সবার কাছে ভীষণ জনপ্রিয় ও খ্যাতি লাভ করেন।

সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাথ সাহা, পুলিনবিহারী সরকার, এ কে ফজলুল হক, রসিকলাল দত্ত, গোপাল চন্দ্র চক্রবর্তী এরা সবাই আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের লেকচার গুলি মনোযোগ দিয়ে শুনতেন এবং পরবর্তীতে বিজ্ঞান মহলে তারাও প্রভাব বিস্তার করেন।

গবেষক হিসাবে প্রফুল্ল চন্দ্র রায়

শিক্ষকতার পাশাপাশি আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় তাঁর গবেষণা চালিয়ে যেতেন। মারকিউরাস নাইট্রাইট তার একটি অবাক করা আবিষ্কার । মারকিউরাস নাইট্রাইট আবিষ্কারের পর তিনি ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের কাছে ‘মাস্টার অফ নাইট্রাইটস’ আখ্যায় ভূষিত হন।

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় রচনা
আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় রচনা

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ১৯০১ সালে “বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস” নামে একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। মাত্র ৮০০ টাকা হাতে নিয়ে তিনি বেঙ্গল কেমিক্যালস এর প্রতিষ্ঠাতা করেন। উল্লেখ্য বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস লিমিটেড ভারতবর্ষের প্রথম ঔষধ প্রস্তুতকারী সংস্থা। সেই সময় বিভিন্ন রাসায়নিক কারখানায় তিনি ঘুরে ঘুরে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতেন। ভারতীয় পুরাণকথা, চারক সংহত্‌ সুশ্রুত সংহতিতে উল্লেখিত বিভিন্ন সংকর ধাতু তৈরীর ফরমুলা বের করার চেষ্টা করতেন।

ভারতীয়রা যে কোন অংশে রসায়নবিদ্যা থেকে পিছিয়ে ছিল না সেসব তিনি বিভিন্ন সূক্ষাতিসূক্ষ যন্ত্র যেমন স্ক্যালপোল বা ল্যানসেট ইত্যাদির মাধ্যমে প্রমাণ করার চেষ্টা করতেন। এসব তথ্য তিনি তুলে ধরেছিলেন “দ্য হিস্ট্রি অফ হিন্দু কেমিস্ট্রি” বইটিতে। এইসব তথ্য উদ্ধারের জন্য তিনি সংস্কৃত ও পালি ভাষা শিখেছিলেন। এছাড়াও তিনি ক্যালকাটা পটারি ওয়ার্কস, বেঙ্গল এনামেল ওয়ার্কস, ন্যাশনাল ট্যানারি ওয়ার্কস্ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করার প্রধান উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করতেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে ও আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের অবদান ছিল অনবদ্য।

আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় একাধারে যেমন বিজ্ঞানী ছিলেন তেমনি তার মধ্যে সাহিত্যিকতা কোন অংশে কম ছিলনা। তার লেখা কিছু বই আজও পাঠকদের মন মুগ্ধ করে তোলে। তার লেখা গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগনশ “A history of Hindu chemistry for the earliest times of the middle of sixteenth century”, “হিন্দু রসায়ন বিদ্যা”, “সরল প্রাণিবিজ্ঞান”, “দ্য হিস্ট্রি অফ হিন্দু কেমিস্ট্রি”, “বাঙ্গালী মস্তিষ্ক ও তার অপব্যবহার” ইত্যাদি। আরও একটি বই তিনি লেখেন “India before and after the sepoy mutiny”।

অসাম্প্রদায়িক ও সমাজসেবী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়

সাম্প্রদায়িকতার ছোঁয়াছুত কখনো তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। বরং সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে তিনি সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারা বিলোপের চেষ্টা করে গেছেন। হাজার 925 সালে তিনি কুদরাত-এ-খুদা কে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে রসায়নের প্রথম বিভাগ পাইয়ে দেন। সেখানে কিছু বিরোধিতা ছিল বটেই। তা সত্বেও তিনি উপেক্ষা করেন এই বিরোধিতাকে। তিনি সমাজসেবা করতে কোন অংশে পিছুপা থাকতেন না। সারা জীবনের কষ্টে অর্জিত সঞ্চয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করে যান রসায়নের উন্নতি সাধনের জন্য।

যাইহোক স্বদেশপ্রেমী এই মহামানব আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় ১৯৪৪ সালের ১৬ ই জুন মৃত্যুবরণ করেন। ভারত বর্ষ তথা বিশ্বের ইতিহাসে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে যতদিন মানবসভ্যতা বেঁচে থাকবে। তার অবদান কখনোই ভোলার নয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here